মঙ্গলবার, ০২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫  |   ২৯ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৮:৩৬

বিএনপির ৪৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী : রক্ত, ত্যাগ ও গণতন্ত্রের অঙ্গীকার

মো. জাকির হোসেন
বিএনপির ৪৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী : রক্ত, ত্যাগ ও গণতন্ত্রের অঙ্গীকার

আজ ১ সেপ্টেম্বর। চার দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক আকাশে এক অমলিন নক্ষত্র হিসেবে উজ্জ্বল থাকা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) আজ তাদের ৪৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করছে। জন্ম হয়েছিল তখন, যখন দেশের রাজনৈতিক আকাশ অন্ধকারে ঢাকা পড়ে ছিলো—একদলীয় শাসনের শ্বাসরুদ্ধকর সময়ে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ ধারণার আলোয় একটি নতুন রাজনৈতিক শক্তি প্রতিষ্ঠা করেন। বিএনপি শুধুই একটি দল নয়, এটি গণতন্ত্রের আকুতি, সাধারণ মানুষের আশা, নির্যাতিত ও উপেক্ষিত মানুষের আস্থার প্রতীক। স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে দলটি সর্বদা ছিলো বহুদলীয় গণতন্ত্রের অগ্রদূত। ১৯৯১ সালে প্রথম অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে জয়ী হয়ে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় দলের নেতৃত্ব দেখিয়েছে আপসহীন ধৈর্য, দায়িত্ববোধ ও দূরদর্শী নেতৃত্ব।

১৯৭৮ সালে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ দর্শনের ভিত্তিতে দলটি গঠন করেন। তখন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিলো অস্থির। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ক্ষমতার শূন্যতা, একদলীয় শাসন ও সামাজিক বিভাজনের মধ্যে দেশের মানুষের মধ্যে নতুন নেতৃত্বের জন্যে তীব্র তৃষ্ণা ছিলো। সেই চাহিদার মধ্য দিয়ে জন্ম নেয় বিএনপি। জিয়াউর রহমানের দর্শনের মূল নীতি ছিলো—বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয় শুধুমাত্র ভাষাভিত্তিক নয়, বরং ভৌগোলিক অখণ্ডতা, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, ঐতিহাসিক চেতনা এবং মুক্তিযুদ্ধের অর্জনের সম্মিলিত প্রকাশ। দলটি দ্রুত গ্রামীণ, শহুরে, কৃষক, শ্রমিক ও পেশাজীবীদের মধ্যে সমান গ্রহণযোগ্যতা পায়। বিএনপি ১৯৭৯ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করে এবং দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এই সময়ে দেশের কৃষি ও শিল্প খাতে নানা কর্মসূচি শুরু হয়। উল্লেখযোগ্য উদ্যোগগুলো হলো : খাল কাটা কর্মসূচি, দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, গ্রামের মেয়ে ও ছেলে শিক্ষার্থীদের জন্যে শিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণ, বেসরকারি উদ্যোগ ও ব্যবসায়িক বিনিয়োগে উৎসাহ প্রদান এবং মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন ও দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়াতে সার্ক (ঝঅঅজঈ) গঠনে ভূমিকা। এই পদক্ষেপগুলো বিএনপিকে দেশের বৃহত্তম গণভিত্তিক রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।

বিএনপির ইতিহাস শুধু উন্নয়ন আর অর্জনের নয়, বরং সংগ্রাম ও ত্যাগেরও ইতিহাস।

১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমানের হত্যার পর বেগম খালেদা জিয়া নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তিনি শুধু দলকে চালনা করেননি, বরং স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে আপসহীন গণআন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় রচিত হয়। দেশব্যাপী কোটা সংস্কার আন্দোলন যখন শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে গণআন্দোলনে রূপ নেয়, তখন বিএনপি এই গণদাবির প্রতি সমর্থন জানায়। এই আন্দোলনে হাজার হাজার সাধারণ মানুষ ও তরুণদের সাথে বিএনপি, ছাত্রদল, যুবদল ও অন্যান্য অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরাও রাজপথে নেমে আসে। সরকারের কঠোর দমন-পীড়ন সত্ত্বেও এই আন্দোলন দেশের রাজনৈতিক অচলাবস্থা ভেঙ্গে গণতন্ত্র ও ভোটাধিকারের দাবিতে এক নতুন মাত্রা যোগ করে। এই আন্দোলনে দেশের বিভিন্ন স্থানে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ও প্রতিবাদকে কঠোরভাবে দমন করা হয়, যেখানে শত শত আন্দোলনকারী প্রাণ হারায় এবং হাজারো আহত হয়। সেই ত্যাগ আজও তৃণমূল নেতাকর্মীর রক্তে মিশে আছে। এই আন্দোলন প্রমাণ করে যে, গণতন্ত্র কোনো স্বাভাবিক অধিকার নয়, এটি অর্জন করতে হয়, রক্ষা করতে হয় এবং কখনো ছাড়তে হয় না।

বিএনপির সংগ্রাম শুধু দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। আন্তর্জাতিক মহলও এই রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রতি মনোযোগ দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ও মানবাধিকার রক্ষায় উদ্বেগ প্রকাশ করে। জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিল বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই আন্তর্জাতিক চাপ বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিএনপির জন্যে একটি বড়ো সুযোগ তৈরি করতে পারে। এই আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া বিএনপিকে শুধু শক্তি দেয়নি, বরং দেশের জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা আরও দৃঢ় করেছে।

৪৭ বছরের পথচলা বিএনপির জন্যে গর্ব, সংগ্রাম, ত্যাগ এবং আবেগের এক মহাকাব্য। এটি শুধুই একটি রাজনৈতিক দল নয়, এটি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতীক। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী শুধুই অতীত স্মরণ নয়, বরং নতুন ভবিষ্যতের শপথ। ‘গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনব, ভোটাধিকার জনগণের হাতে ফিরিয়ে দেব।’এই শপথে আছে রক্ত, আছে ত্যাগ, আছে প্রত্যাশার অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। বিএনপি যে পথ বেছে নিয়েছে, তা সহজ নয়, কিন্তু এটি বাংলাদেশের জনগণের অধিকার, গণতন্ত্র ও ন্যায়ের প্রতি অঙ্গীকার। ৪৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে সেই অঙ্গীকার আরও দৃঢ় ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়ে এসেছে।

লেখক : তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, চাঁদপুর জেলা বিএনপি।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়