মঙ্গলবার, ০২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫  |   ২৯ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৮:৫১

দস্তয়েভস্কির উপন্যাসে প্রবীণ

হাসান আলী
দস্তয়েভস্কির উপন্যাসে প্রবীণ

রুশ কথাসাহিত্যিক ফিওদর দস্তয়েভস্কির উপন্যাসে প্রবীণ চরিত্রগুলোকে অনেক সময় অসহায়, নিঃসঙ্গ, ধর্মভীরু, আবার কখনো কৌশলী ও কর্তৃত্বশালী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। নিচে কয়েকটি উপন্যাসের সংক্ষিপ্ত আলোচনা পাঠকের জন্যে তুলে ধরা হয়েছে।

১. The Brothers karamazov (ভাতৃদ্বয়- কারামাজভ) এই উপন্যাসে পাঁচটি চরিত্র ক. Fyodor Povlovich Karamazov (ফিয়োদর)-কামুক, লোভী, নীতিহীন বৃদ্ধ পিতা।

খ. দিমিত্রি (Dimitri)- জ্যেষ্ঠ পুত্র আবেগপ্রবণ, ভোগবিলাসে আসক্ত কিন্তু গভীর মানবিকতা বোধ রয়েছে।

গ. ইভান(Ivan)-মধ্যম পুত্র, বুদ্ধিজীবী, যুক্তি বাদী, ঈশ্বর ও নৈতিকতার প্রতি সংশয়ী।

ঘ. আলেয়শা(Alyosha)-কনিষ্ঠ পুত্র, ধর্মভীরু, দয়ালু এবং খ্রিস্টান ধর্মের অনুশাসন দ্বারা পরিচালিত।

ঙ. স্মেরদিয়াকভ (Smerdzkov)-বৃদ্ধ ফিয়োদরের অবৈধ সন্তান, পিতার চাকর। ভেতরে ভেতরে চাপা রাগ আর প্রতিশোধের আগুন বহন করে। উপন্যাসে পিতা ও পুত্রের দ্বন্দ্বই প্রধান। বৃদ্ধ পিতা ফিয়োদর অসভ্য, নিষ্ঠুর, লালসাপূর্ণ মানুষ।

তিনি গ্রুশেঙ্কা নামক এক নারীর প্রতি আকৃষ্ট হন, যাকে তার বড়ো পুত্র দিমিত্রিও ভালোবাসে। গ্রুশেঙ্কাকে কেন্দ্র করে পিতা-পু্ত্েরর দ্বন্দ্ব চরমে উঠে। একরাতে বৃদ্ধ পিতাকে হত্যা করা হয়। সন্দেহ তীব্র হয় পুত্র দিমিত্রির ওপর, কিন্তু খুন করে অবৈধ পুত্র স্মেরদিয়াকভ। স্মেরদিয়াকভ ফিয়োদরকে হত্যা করে এবং নিজেও আত্মহত্যা করে। দিমিত্রি প্রকৃত খুনি না হয়েও সমাজ, আইন ও সাক্ষীর দুর্বলতায় দোষী সাব্যস্ত হয়ে কারাদণ্ড পান।

ফিয়োদর একজন বৃদ্ধ পিতা, কিন্তু বয়সের সঙ্গে জ্ঞান, প্রজ্ঞা বা সম্মান অর্জন করতে পারেন নি, বরং লোভ, কামনা, বাসনা, অসভ্যতা এবং দায়িত্বহীনতার পরিচয় দেন। লেখক দেখান প্রবীণ বয়স সবসময় মর্যাদার প্রতীক নয়।মানুষ যেমন জীবন কাটায় বার্ধক্যেও সেই চরিত্র প্রকট হয়। ফিয়োদর বার্ধক্যেও নারী লোলুপ, কামপ্রবণ ও অসংযমী। তার স্বভাব, লোভ, প্রতারণা ও কুআচরণ তাকে সমাজ বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। সমাজে প্রবীণদের প্রতি বিতৃষ্ণা প্রকাশ পেয়েছে।

২. দ্য ইডিয়ট (The Idiot)-কাহিনি হলো, নায়ক মিশকিন একজন তরুণ সৎ, সরল এবং নৈতিকভাবে নির্মল মানুষ, কিন্তু মৃগীরোগী। তার অতিরিক্ত সহজ সরলতাকে সমাজ ইডিয়ট হিসেবে আখ্যায়িত করে। সুইজারল্যান্ডে দীর্ঘ চিকিৎসা শেষে রাশিয়ায় ফিরে এসে সুন্দরী নাস্তাসিয়া এবং অভিজাত শ্রেণীর তরুণী আগলয়ার জীবনে প্রবেশ করেন। নাস্তাসিয়া মিশকিনকে গভীরভাবে ভালোবাসে এবং তার সহজ সরলতার প্রতি আকৃষ্ট হয়। আগলয়া মিশকিনকে গভীরভাবে ভালোবাসে, কিন্তু তার সহজ সরলতা এবং নাস্তাসিয়ার সাথে সম্পর্কের জটিলতা তাকে হতাশ করে। মিশকিনের সাথে সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়ে রগোঝিন নামে এক আসক্ত পুরুষের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলে। শেষ পর্যন্ত রগোঝিন নাস্তাসিয়াকে হত্যা করে। উপন্যাসের শেষ দিকে মিশকিন মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন এবং চিকিৎসার জন্যে আবার সুইজারল্যান্ডে ফিরে যান।

উপন্যাসে জেনারেল এপাচিনের স্ত্রী পরিবারে মাতৃতান্ত্রিক প্রভাব ও কর্তৃত্ব বজায় রাখেন। প্রবীণ বয়সে বুদ্ধি, প্রজ্ঞা ও নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা ব্যবহার করে পরিবারকে বেঁধে রাখার বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।

সার কথা : জেনারেল এপাচিনের প্রবীণ স্ত্রী পরিবার ও সমাজের রক্ষণশীল প্রতিনিধি।

তরুণী আগলয়া নতুন প্রজন্মের স্বপ্ন ও সংশয়। আর নাস্তাসিয়া হলো ভগ্ন সমাজ ও নারীর ট্র্যাজিক অবস্থান।

৩. ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট - (অপরাধ ও শাস্তি) উপন্যাসে প্রবীণ নারী চরিত্র আলিওনা ইভানোভানা একজন সুদখোর। তিনি কৃপণ, নিষ্ঠুর ও অমানবিক। আলিওনাকে হত্যা করে রোদিওন রাস্কলনিকভ নামে এক দরিদ্র সাবেক ছাত্র, যিনি সেন্ট পিটার্সবার্গে বসবাস করেন। তিনি বিশ্বাস করেন, পৃথিবীতে দু ধরনের মানুষ রয়েছে। সাধারণ মানুষ আইন মানবে। অসাধারণ মানুষ যারা আইন ভাঙ্গতে পারে মানব জাতির কল্যাণে। এই চিন্তার পরীক্ষায় তিনি আলিওনা নামের এক সুদখোর বৃদ্ধাকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেন, যিনি সমাজের কোনো উপকারে আসেন না। আলিওনার চরিত্রের মধ্যে অমানবিকতা, লোভ, কৃপণতা ও সমাজবিচ্ছিন্নতা প্রকাশ পায়। এখানে দস্তয়েভস্কি প্রবীণ নারীকে ইতিবাচক নয় বরং সমাজে ভয় ও ঘৃণার প্রতীক হিসেবে দেখিয়েছেন। আলিওনাকে খুন করার পর রাস্কলনিকভ হত্যাকাণ্ডের শাস্তি পাবার আগেই অপরাধবোধে ভেঙ্গে পড়ে। জেলের শাস্তির চেয়ে বিবেকের যন্ত্রণা প্রবল হয়ে উঠে।

৪. ডেমনস (Demons) -উপন্যাসে প্রবীণ নারী ভার্ভারা স্ভাভরোগিন অভিজাত শ্রেণীর প্রতিনিধি। তিনি সমাজের পুরানো কাঠামোকে প্রতিনিধিত্ব করেন, কিন্তু নতুন প্রজন্মকে ঠেকাতে পারেন না।লেখক এখানে দেখিয়েছেন বার্ধক্য শুধু দুর্বলতা নয়, প্রভাবশালী রাজনৈতিক অবস্থানও হতে পারে।

এই রাজনৈতিক উপন্যাস, যেখানে ঊনিশ শতকের বিপ্লবী আন্দোলন, নাস্তিকতা, নৈতিক সংকট ও ধ্বংসাত্মক মতবাদের প্রভাব তুলে ধরা হয়েছে।

বিপ্লবীরা সমাজকে মুক্ত করতে চায়, কিন্তু তাদের কার্যকলাপ ধ্বংস ডেকে আনে। উপনাস্যের চরিত্ররা ঈশ্বর, নৈতিকতা, কর্তব্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ঈশ্বরহীনতায় মানুষ কীভাবে দানব বা ডেমন দ্বারা পরিচালিত হয় সেটিই মূল থীম।

৫. The Insulted and the injured ( অপমানিত ও আহত)-উপন্যাসে প্রবীণ চরিত্র প্রিন্স ভ্যালকোভস্কি এক জটিল চরিত্র। তিনি এই চরিত্রের মধ্য দিয়ে জীবনের এক অন্ধকার দিককে তুলে ধরেন। তিনি এক বৃদ্ধ অভিজাত প্রিন্স, যার জীবনে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা রয়েছে। সেই অভিজ্ঞতা তাকে প্রজ্ঞাবান না করে ধূর্ত, চালাক, স্বার্থপর করে তুলেছে। প্রবীণ বয়সে এসে তিনি তরুণদের ব্যবহার করেন নিজের ক্ষমতা ও ধনসম্পদ বৃদ্ধির জন্যে। ভ্যালকোভস্কি প্রবীণ বয়সেও একেবারে নৈতিকভাবে দেউলিয়া। নিজের ছেলেকে দরিদ্র কিন্তু সৎ ( নাতাশা) ভালোবাসা থেকে টেনে এনে ধনী পরিবারের মেয়ের সাথে বিয়ে দিতে চান। একজন বাবা হিসেবে তিনি ব্যর্থ। ছেলের ভালোবাসার অনুভূতির প্রতি কোনো শ্রদ্ধা নেই। তাকে প্রবীণ প্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।

৬. Notes from the House of the dead (মৃতদের গৃহ থেকে নোটস) উপন্যাসে প্রবীণ বন্দিজীবনকে তুলে ধরা হয়েছে।

উপন্যাসে দেখা যায়, অনেক বৃদ্ধ বন্দি যাদের বয়স হয়ে গেছে, কিন্তু শাস্তির ভারে এখনো শ্রমে নিযুক্ত। তাদের শারীরিক দুর্বলতা, যন্ত্রণা এবং নিঃসঙ্গতা প্রবীণ জীবনের করুণ রূপ প্রকাশ করে। দস্তয়েভস্কি একসময় নিজে কারাগারে বন্দি ছিলেন। কারাগারে প্রবীণ বন্দির সীমাহীন দুঃখ-কষ্ট নিজের চোখে দেখেছেন। তিনি দেখিয়েছেন কারাগারে প্রবীণরা প্রায় অদৃশ্য অস্তিত্বে পরিণত হয়। তারা বেঁচে থাকেন, কিন্তু জীবনের কোনো স্বপ্ন বা আশা থাকে না। প্রবীণরা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন, নিঃসঙ্গ, শৃঙ্খলিত ও অমানবিক পরিসরে বেঁচে থাকেন। প্রবীণ বয়সেও মুক্তির আকাঙ্ক্ষা এখানে আরও বেশি তীব্র।

রুশ কথাসাহিত্যিক দস্তয়েভস্কি’র উপন্যাসগুলো প্রায় বহু বছর আগে লেখা, কিন্তু এখনো এই উপন্যাসের আবেদন এবং প্রাসঙ্গিকতা অটুট রয়েছে বলে মনে হয়েছে।

হাসান আলী : প্রবীণ বিষয়ে লেখক, গবেষক ও সংগঠক।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়