মঙ্গলবার, ০৫ আগস্ট, ২০২৫  |   ২৭ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ০৫ আগস্ট ২০২৫, ১৪:১৬

কর্তৃত্ববাদী সরকার পতন-পরবর্তী এক বছর

রাষ্ট্রসংস্কারের অভূতপূর্ব সম্ভাবনা সত্ত্বেও অর্জনের পথ কণ্টকাকীর্ণ : টিআইবি

অনলাইন ডেস্ক
রাষ্ট্রসংস্কারের অভূতপূর্ব সম্ভাবনা সত্ত্বেও অর্জনের পথ কণ্টকাকীর্ণ : টিআইবি

অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক বহুবিধ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়া সত্ত্বেও কর্তৃত্ববাদী সরকার পতনের পর এক বছরে বিচার, সংস্কার, নির্বাচনপ্রস্তুতি ও রাষ্ট্র পরিচালনার বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। তবে সুশাসনের আলোকে অপ্রাপ্তি বিশেষ করে একদিকে আইনের শাসন ও স্বচ্ছতার ঘাটতি, স্বার্থের দ্বন্দ্ব ও এড-হক ভিত্তিতে সরকার পরিচালনা এবং অন্যদিকে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের একাংশের দলবাজি, দখলবাজি, চাঁদাবাজি, মামলা-বাণিজ্য, গ্রেফতার ও জামিন বাণিজ্যের স্বাভাবিকতার চাপে রাষ্ট্রসংস্কারের অভীষ্ট অর্জনের পথ কণ্টকাকীর্ণ হচ্ছে। ‘কর্তৃত্ববাদী সরকার পতন-পরবর্তী এক বছর : প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি’ শীর্ষক ঘটনাপ্রবাহ পর্যবেক্ষণভিত্তিক প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষ্যে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ মন্তব্য করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। একই সঙ্গে রাষ্ট্র সংস্কারের মৌলিক ক্ষেত্রসমূহের বেশিরভাগ বিষয়ে ক্ষমতাপ্রত্যাশী বড়ো দলসমূহের শর্তসাপেক্ষ ঐকমত্য সংস্কার অঙ্গীকার বাস্তবায়নের সাংবিধানিক ও আইনগত বাধ্যবাধকতা ও সুনির্দিষ্ট পথরেখা অমীমাংসিত থাকায় সংস্কারের প্রত্যাশা পূরণের সম্ভাবনা ঝুঁকির সম্মুখীন বলেও মন্তব্য করেছে সংস্থাটি।

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর যে সকল উদ্যোগ নিয়েছে, তার মধ্যে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় সারা দেশে দায়ের করা প্রায় সব হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার, গণঅভ্যুত্থানে হত্যায় জড়িতদের বিচার কার্যক্রম শুরু, গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক কনভেনশনে স্বাক্ষর, দুই পর্যায়ে খাত ও প্রতিষ্ঠানভিত্তিক ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন, ৫০টি আইন প্রণয়ন, সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল পুনর্বহাল, সুপ্রীম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ, ২০২৫-এর খসড়া চূড়ান্তকরণ, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদ পরিবার এবং জুলাই যোদ্ধাদের কল্যাণ ও পুনর্বাসন অধ্যাদেশ, ২০২৫ জারি; বিদ্যমান আইন অনুসরণ করে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন এবং আর্থিক খাত সংস্কারের লক্ষ্যে বিভিন্ন কমিটি ও টাস্কফোর্স গঠন এবং প্রতিবেদন প্রণয়ন উল্লেখযোগ্য।

টিআইবির পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণে অ্যাড-হক প্রবণতা, প্রশাসন পরিচালনায় অনেক ক্ষেত্রে সরকারের দৃঢ়তা ও সুস্পষ্ট কর্মপরিকল্পনার ঘাটতি এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারে দায়িত্বশীলদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা লক্ষ করা যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তহীনতা বা সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর পরিবর্তন করা, যার অন্যতম প্রতিফলন। প্রশাসনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের ক্ষেত্রে প্রধানত উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের অপসারণের মাধ্যমে দলীয়করণ থেকে মুক্ত করার প্রচেষ্টা লক্ষ করা গেলেও একইসাথে একদলের স্থলে অপর দলীয়করণ প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে কার্যত দলীয়করণের ধারাই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ ছাড়া পুলিশ-প্রশাসনসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অস্থিরতা, নতুন রাজনৈতিক বলয় তৈরির প্রয়াস এবং ব্যাপক রদ-বদলের কারণে প্রাতিষ্ঠানিক অকার্যকারতা লক্ষ করা যায়, এ সকল ক্ষেত্রে সরকারের নিয়ন্ত্রণহীনতা দৃশ্যমান ছিলো। সর্বোপরি প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের উদ্যোগ ভেতর থেকে বাধাগ্রস্ত হয়েছে, ফলে সংস্কারের আকাকঙ্ক্ষা প্রত্যাশিত পর্যায়ে বাস্তবায়িত হয়নি।

গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, নিজস্ব এজেন্ডাকে গুরুত্ব দেওয়ার ফলে অভ্যুত্থানে জড়িত বিভিন্ন অংশীজনের মধ্যে মতভেদ ও দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছে, যা গণঅভ্যুত্থান থেকে উদ্ভূত রাষ্ট্র সংস্কারের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলেছে। মৌলিক সংস্কারের প্রশ্নে সুস্পষ্ট বিভাজন পরিলক্ষিত হয়েছে এবং নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়ার ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির কোনো মৌলিক পরিবর্তন হয়নি-- দলবাজি, চাঁদাবাজি, দখলবাজি ও আধিপত্য বিস্তারের সংস্কৃতি এখনো চলমান। যা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন, রাষ্ট্র সংস্কারের মূল চেতনা ধারণ, রাষ্ট্রসংস্কার এবং নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের অভীষ্ট অর্জনের ক্ষেত্রে একটি বড়ো চ্যালেঞ্জ।

তথ্য প্রকাশ ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা এখনো চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে সহযোগিতা ও সমালোচনার সুযোগ সার্বিকভাবে মুক্ত পরিবেশ ও বাক-স্বাধীনতার পরিচায়ক বিবেচিত হলেও একদিকে কোনো কোনো মহলের অতিক্ষমতায়ন ও তার অপব্যবহার, এবং চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা যায়, যা অসাম্প্রদায়িক সম-অধিকারভিত্তিক ও বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশের অভীষ্টের পথে অন্তরায়। এক বছরে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিকাশ ও প্রভাব প্রকটভাবে দৃশ্যমান হয়েছে।

অনেক ক্ষেত্রে সহিংসতা ও বলপ্রয়োগের কারণে জেন্ডার, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও নৃতাত্ত্বিক বৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে, যা বৈষম্যবিরোধী চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক। সংস্কার কমিশনগুলোর আশু করণীয় সুপারিশ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাস্তব কোনো অগ্রগতির তথ্য নেই। অনেক ক্ষেত্রে এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় পতিত, কোনো কোনো সুপারিশ ‘বেছে নেওয়ার’ প্রবণতা দৃশ্যমান। অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর অর্পিত দায়িত্ব তথা বিচার, রাষ্ট্র সংস্কার ও নির্বাচনে সুস্পষ্ট ও সুপরিকল্পিত কৌশল ও রোডম্যাপ প্রণয়ন ও প্রকাশ না করার ফলে সরকারের ওপর বিভিন্ন অংশীজনের আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে বিভিন্ন সময়ে।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘বিশাল সম্ভাবনা নিয়ে শুরু করলেও রাষ্ট্রসংস্কারের যাত্রাপথে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মূল চেতনার প্রতিফলনে অনেক অপ্রাপ্তি, স্থবিরতা, এমনকি পশ্চাদমুখিতা দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক সংস্কৃতির মৌলিক কোনো পরিবর্তন দৃশ্যমান হয়নি। যারা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ফলে নিজেদের ক্ষমতায়িত ভাবছেন, তাদের অনেকেই একেবারে শুরু থেকেই দলবাজি, চাঁদাবাজি, দখলবাজি গ্রেফতার-বাণিজ্য, মামলা-বাণিজ্য, জামিন-বাণিজ্য ও আধিপত্য বিস্তারের অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত রয়েছেন। শুরু থেকে সরকারের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের জন্যে সুনির্দিষ্ট কৌশল প্রণীত হয়নি, সরকার পরিচালনা হয়েছে এড-হক ভিত্তিতে, আত্মবিশ্বাসের ঘাটতির কারণে সিদ্ধান্তহীনতা এবং অনেক ক্ষেত্রে সরকারের পেছনের কোনো কোনো শক্তির বা অতিক্ষমতায়িত কোনো কোনো আন্দোলনকারীর চাপের মুখে সিদ্ধান্তের পরিবর্তন হয়েছে। সংস্কার কমিশনসমূহের আশুকরণীয় সুপারিশ বাস্তবায়ন অভ্যন্তরীণ আমলাতান্ত্রিক প্রতিকূলতার হাতে জিম্মি রয়ে গেছে। কর্তৃত্ববাদের মেয়াদে যারা প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা বলয়ের বাইরে ছিলেন তারা মূলত দলীয়করণ প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে দলীয়করণের ধারা অব্যাহত রেখে ‘‘এবার আমাদের পালা’’- এই সংস্কৃতির চর্চায় লিপ্ত হয়েছেন, যার বিস্তৃতি সচিবালয় থেকে শুরু করে মাঠপর্যায়ে সকল ক্ষেত্রে দৃশ্যমান রয়েছে।’

নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘অসাম্প্রদায়িক সম-অধিকারভিত্তিক ও বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশের অভীষ্টের পথে অন্তরায় হয়ে এসেছে ধর্মের নামে অপশক্তির বিকাশ। অনেক ক্ষেত্রে ধর্মীয় উসকানিনির্ভর সহিংসতা ও বলপ্রয়োগের কারণে নারী অধিকার, জেন্ডার, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও নৃতাত্ত্বিক বৈচিত্র্যভিত্তিক সমতা হুমকির মুখে পড়েছে, যা বৈষম্যবিরোধী চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সংসদে নারী আসন নিয়ে যে ধরনের ঐকমত্য হয়েছে, তাতে নারীর কার্যকর প্রতিনিধিত্বের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। গণমাধ্যম, তথ্যপ্রকাশ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত ও সকল জনগণের সমঅধিকারের যে প্রত্যাশা ছিলো, গত এক বছরে তা পূরণ হয়নি। উদ্বেগজনক বিষয় হলো, বাংলাদেশে গত এক বছরে তথ্য কমিশন ও মানবাধিকার কমিশনের অনুপস্থিতি। যা একধরনের নজিরবিহীন রেকর্ড। এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি কেন অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে প্রাধান্য পেল না, তা বোধগম্য নয়। র‌্যাব বিলুপ্ত করার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সুপারিশের বিষয়ে সরকারের অবস্থান অস্বচ্ছ। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সংস্কার নিয়ে কোনো আলোচনা হচ্ছে না। যে কর্তৃত্ববাদের চর্চা গত ১৬ বছরে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, তা পরিবর্তনে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার অপরিহার্য ছিলো। রাজনৈতিক দলের সংস্কারও বিবেচনার বাইরে, যার উদ্যোগ রাজনৈতিক দলগুলোকেই নিতে হবে।’

ড. জামান বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অন্তর্বর্তী সরকারের সবচেয়ে দুর্বলতম দিক। পুলিশ-প্রশাসনসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অস্থিরতা, বিচারের নামে প্রতিশোধমূলক ঢালাও মামলা, বিনা বিচারে আটক, আদালত প্রাঙ্গণে সহিংসতা প্রকৃত অপরাধীর বিচারের পথে ঝুঁকি সৃষ্টি করছে। কর্তৃত্ববাদী সরকার পতনের পরে যে অভূতপূর্ব সুযোগের সৃষ্টি হয়েছে, যে সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে ঐকমত্য কমিশনের উদ্যোগে সংস্কারবিষয়ক রাজনৈতিক আলোচনা হয়েছে, পৃথিবীর খুব কম দেশেই, এই বিরল দৃষ্টান্ত দেখা যায়। এই অভাবনীয় সুযোগ কাজে লাগিয়ে প্রত্যাশিত পর্যায়ের ইতিবাচক পরিবর্তন অর্জনে ব্যর্থ হলে, তার দায় আমাদের সকলের।’

সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের এবং গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মুহাম্মদ বদিউজ্জামান। প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন টিআইবির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো শাহজাদা এম আকরাম ও মো. জুলকারনাইন। টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম সংবাদ সম্মেলনটি সঞ্চালনা করেন।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়