মঙ্গলবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০২৫
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৯:১৭

মহাকালের মহাসমাপ্তি: জিয়া-খালেদার চিরস্থায়ী মিলন, ইতিহাসের এক বিষাদময় অধ্যায়

"বিদেশে নেই ঠিকানা, অঙ্গীকার রেখে নিজ দেশের মাটিতেই শেষ শয়ানে জননী"

“১৯৮১-তে বিচ্ছেদ, ২০২৫-এ মিলন; চন্দ্রিমা উদ্যানে পাশাপাশি দুই সমাধি বলবে এক ত্যাগের মহাকাব্য।”

মো. জাকির হোসেন

শিরোনাম: ঠিকানা যার বাংলাদেশ: চন্দ্রিমা উদ্যানে জিয়া-খালেদার চিরস্থায়ী মিলন

ইতিহাসের এক বিষাদময় পূর্ণতা: ইতিহাসের এক দীর্ঘ পরিক্রমা শেষে যেন বৃত্ত পূর্ণ হলো। যে বিশাল শূন্যতা নিয়ে ১৯৮১ সালের ৩০ মে এক বৃষ্টিভেজা রাতে যাত্রা শুরু হয়েছিল, ২০২৫-এর এই বিদায়লগ্নে চন্দ্রিমা উদ্যানের সেই চিরচেনা প্রাঙ্গণে তার অবসান ঘটতে যাচ্ছে। মহান স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বীর উত্তমের পাশেই চিরনিদ্রায় শায়িত হতে যাচ্ছেন দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী ও গণতন্ত্রের আপসহীন নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। দীর্ঘ ৪৪ বছরের বিরহ শেষে দুই জীবনসঙ্গীর এই শেষ মিলন কেবল একটি দাফন নয়, বরং এটি একটি রাজনৈতিক ও আবেগীয় যুগের পূর্ণতা।

অঙ্গীকারের চার দশক: ভিডিওর সেই সাহসী উচ্চারণ: আজকের এই বিষাদময় বিদায়ে বারবার ফিরে আসছে ভিডিওতে থাকা সেই অকুতোভয় কণ্ঠস্বর। রাজনৈতিক জীবনের প্রতিটি সংকটে যখন তাঁকে দেশত্যাগের জন্য চাপ দেওয়া হয়েছে, যখন অন্ধকার প্রকোষ্ঠে তাঁকে বন্দি রাখা হয়েছে, তিনি হিমালয়ের মতো অটল ছিলেন তাঁর সিদ্ধান্তে। ভিডিওতে তাঁকে অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বলতে শোনা যায়, "দেশের বাইরে আমি যাব না। কারণ দেশের বাইরে আমার কোন ঠিকানা নাই। আমার কোনো কিছু নাই। এই দেশেই আমি থাকবো... এই দেশেই আমার মৃত্যু হবে।" এই অঙ্গীকার রক্ষায় তিনি বিসর্জন দিয়েছেন জীবনের সব সুখ, হারিয়েছেন তাঁর প্রিয় সন্তানদের সান্নিধ্য। ভিডিওর শেষে তাঁর সেই করুণ অথচ সাহসী উক্তি— "যার জন্য আমার ছেলে দুইটাকে নির্যাতন করা হয়েছে"—আজ প্রতিটি দেশপ্রেমিকের হৃদয়ে নতুন করে হাহাকার তৈরি করছে। তিনি প্রমাণ করে গেছেন, আপসহীনতা কেবল একটি শব্দ নয়, এটি একটি জীবনদর্শন।

রাজনৈতিক সাফল্যের আলোকবর্তিকা: বেগম খালেদা জিয়া কেবল একজন গৃহবধূ থেকে দেশের প্রধানমন্ত্রী হননি, বরং তিনি হয়ে উঠেছিলেন গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী। তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের উল্লেখযোগ্য অর্জনসমূহ বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে: ১৯৯১ সালে স্বৈরাচার পতন পরবর্তী নির্বাচনে জয়লাভ করে তিনি দেশে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনেন। নারী শিক্ষাকে ত্বরান্বিত করতে দশম শ্রেণি পর্যন্ত মেয়েদের অবৈতনিক শিক্ষা ও উপবৃত্তি চালু তাঁর এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। শিশুদের ঝরে পড়া রোধে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ কর্মসূচি এবং যমুনা বহুমুখী সেতু নির্মাণ সম্পন্নকরণে তাঁর সরকারের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। 'সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়'—এই নীতিতে অটল থেকে তিনি আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের মর্যাদা বৃদ্ধি করেন।

বিয়োগান্তক জীবনগাথা: ত্যাগের এক মহাকাব্য: বেগম জিয়ার জীবন যেন এক ত্যাগের সমুদ্র। ১৯৮১ সালে স্বামী হারানোর পর দুই অবোধ শিশুকে নিয়ে যে সংগ্রামের শুরু, তা শেষ হলো আজ। বড় ছেলে তারেক রহমান প্রবাসে নির্বাসিত, ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর অকাল মৃত্যু—সব শোককে পাথর করে তিনি দেশের মানুষের কথা ভেবেছেন। চন্দ্রিমা উদ্যানের মাজার কমপ্লেক্সে আজ সেই ত্যাগেরই চূড়ান্ত স্বীকৃতি। শহীদ জিয়ার কবরের ঠিক পাশেই তৈরি হয়েছে তাঁর শেষ ঠিকানা

নিঃস্ব উত্তরাধিকার ও বিষণ্ণ জনপদ: যিনি শৈশবে বাবাকে হারালেন, প্রবাস জীবনে হারালেন ভাইকে, আজ তিনি মা-কেও হারালেন। রিক্ত হাতে দাঁড়িয়ে থাকা সেই উত্তরসূরির জন্য পৃথিবীটা আজ বড্ড বিষণ্ণ। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের দুই অতন্দ্র প্রহরী একে একে চলে গেলেন, কিন্তু রেখে গেলেন এক অপরাজেয় আদর্শ। যাঁর জীবন ছিল গণতন্ত্র রক্ষার নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম, যাঁর সাহসে বারবার মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে এই দেশ—তাঁর বিদায় মানে একটি প্রদীপ্ত অধ্যায়ের চিরস্থায়ী অন্তর্ধান।

শোকবার্তা: এক নক্ষত্রের প্রয়াণে শোকার্ত জাতি: বেগম খালেদা জিয়ার প্রয়াণে দেশজুড়ে নেমে এসেছে গভীর শোকের ছায়া। বিএনপির পক্ষ থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে জানানো হয়, "তিনি ছিলেন বাংলাদেশের গণতন্ত্রের মা। তাঁর মৃত্যুতে দেশপ্রেমের রাজনীতির এক অপূরণীয় ক্ষতি হলো। শত প্রলোভন ও নির্যাতনের মুখেও তিনি দেশত্যাগ না করে যে নজির গড়েছেন, তা বিশ্ব ইতিহাসে বিরল।" বিশিষ্টজনরা তাঁদের বার্তায় বলেছেন, তাঁর অসিয়ত পূর্ণ হলো—তিনি নিজ দেশের মাটিতেই মিশে গেলেন।

চন্দ্রিমা উদ্যানের এক কোণে এখন দুটি সমাধি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকবে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে। বিদায় আপোষহীন দেশনেত্রী। আপনি থাকবেন সংগ্রামের স্মৃতিতে, সাহসের প্রেরণায়, আর ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের স্বপ্নে। শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও অশ্রুসিক্ত বিদায়

স্লোগান: "ঠিকানা যার বাংলাদেশ, মৃত্যুতে তার নেই তো শেষ।"

প্রতিবেদক : মো. জাকির হোসেন, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, চাঁদপুর জেলা বিএনপি।

ডিসিকে /এমজেডএইচ

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়