প্রকাশ : ০৩ আগস্ট ২০২৫, ১৪:৫০
ছোট্ট ঝুপড়ি ঘরে রহিমা-হাওয়া নুরের মানবেতর জীবন
তাদের ঘর দরকার

আঙ্গো (আমাদের) ছবি তুইলা (তুলে) কী করবেন? কেউ আঙ্গরে (আমাদের) কিছুই দেয় না। আঙ্গোরে (আমাদের) একখান (একটা) ঘর করি দেন। খুব কষ্টে এইহানে (এই জায়গা) থাহি (থাকি)। দেহেন (দেখেন) না? কারেন্ট (বিদ্যুৎ) নাই, পানি নাই, হাগনের জায়গা (ল্যাট্রিন) নাই। এই দেশে বড় লোকেরা নিজেগো (নিজেদের) নিয়াই চিন্তা করে। আইজকা (আজ) চাইর (চার) বছর ধইরা (ধরে) এইহানে (এই জায়গা) ঘর বানাইয়া (তৈরি) থাহি (থাকি)। মাইনসের (মানুষের) বাইত (বাড়িতে) ভিক্ষা করি খাই, যেদিন কইরতাম (করতে) হারিনা (পারি না) হেদিন (সেদিন) কষ্ট অয় (হয়)। এই প্রতিবেদককে দেখে কথাগুলো বলেন লক্ষ্মীপুরের রায়পুরে মেঘনা-ডাকাতিয়ার পাড়ে বসবাস করা রহিমা ও কুলসুমা বেগম।
|আরো খবর
রায়পুরের মেঘনা ও ডাকাতিয়া উপকূলের বাসিন্দারা ভালো নেই। জীবন চলে অতি কষ্টে। ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, দুর্যোগের সঙ্গে তাদের নিত্য দিনের বসবাস। প্রতিনিয়ত দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকে উপকূলবাসী। আবার অনেকের ভিটেমাটি না থাকায় সরকারি জমিতে থাকেন। এখানকার গুটি কয়েক বিত্তশালী দালানে থাকলেও অধিকাংশ বাসিন্দাই টিন, খড়, বাঁশ দিয়ে বানানো ঝুপড়ি ঘরে বসবাস করছেন। বিদ্যুৎ, সুপেয় পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা না থাকলেও এতেই তাদের শান্তি। শুধু ঘূর্ণিঝড় নয়, অল্প বাতাসেই ঘর ভেঙ্গে যায়।
রায়পুরের মেঘনার বেড়ি বাঁধ ঘুরে এসে :
‘খড়কূটার এক বাসা বাঁধলাম বাবুই পাখির মত, এই হৃদয়ের ভালোবাসা দিলাম আছে যত/ একটা ময়না পাখি/ সেই বাসায় পুষি কত ভালোবাসায়, তারে চোখে চোখে রাখি’ গীতিকার মনিরুজ্জামান মনিরের লেখা ও শিল্পী মনির খানের কণ্ঠে গাওয়া গানটির কথার সঙ্গে রহিমার জীবনের যেন মিল রয়েছে। চার পাশে বাঁশ দিয়ে তার ওপর পলি মোড়ানো বেড়া।
রহিমার একমাত্র মেয়েকে ও অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে এখানেই বসবাস। একটা সময় গ্রামের পর গ্রাম খড়ের ঘর দেখা যেত। মাটির দেয়াল, ওপরে খড়ের চাল। এখন তা ইতিহাস হয়ে গেছে। একই অবস্থা আকন বাজার এলাকার পাশে নদীর পাড়ে দিনমজুর হাওয়া নুরের (৩৫)।
বর্তমান প্রজন্ম মাটির বা খড়ের ঘরের গল্প শুনলে বিশ্বাসই করবে না। তবে প্রান্তিক জনপদে এখনো বিশ্বাস করার মতো মাটি আর খড়ের ঘর চোখে পড়ে। রহিমা-হাওয়া-কুলসুমারা সেই খড় ও টিনের ঘরেই বসবাস করছেন।
ঝড়, বৃষ্টি থেকে বাঁচার পাশাপাশি ডাকাতিয়া নদীর পাড়ে রহিমা, হাওয়া নুর ও কুলসুমা বেগমের ছোট্ট কুঁড়েঘর।
রায়পুর উপকূলীয় উপজেলার উত্তর চরবংশী ইউনিয়নের প্রান্তিক জনপদের চরবংশী, চরইন্দ্রিয়া ও আকনবাজার গ্রাম। যেখানের ৯৫ ভাগ মানুষই মাছ শিকার ও দিনমজুরির কাজে নিয়োজিত। দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে রহিমা, হাওয়া নুর ও কুলসুমার মতো অসংখ্য বাসিন্দা। সন্তান ও অসুস্থ স্বামী। বেড়িবাঁধের পাশে বসবাস করা রহিমার স্বামীর যতটুকু জমি ছিল তা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। তাই তো রহিমা তিন বছর ধরে বেড়িবাঁধের পাশে নদীর পাড়ে বসবাস করছেন ঝুপড়ি ঘরে। ভিক্ষা আর অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে সংসার চালান তিনি। মানবেতর জীবন যাপন করছেন। সরকারিভাবে এবং বেসরকারিভাবে যে সহযোগিতা পেয়েছেন তা দিয়েই চলছে।
সরেজমিনে উত্তর চরবংশী ইউনিয়নের চমকা বাজার ও আকন বাজার গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, রহিমা ও হাওয়া নুরের ছোট্ট একটি কুঁড়ে ঘর। ঘরের দু পাশে চাটাইয়ের বেড়া, এক পাশে পলিথিন দিয়ে মোড়ানো আর উপরে খড়ের চাল। মাঝেমধ্যে পুরাতন কাপড় দিয়ে ছাউনি। চাটাইয়ের বেড়ার একাধিক জায়গা ছিদ্র। নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করার মতো নয়।
কথা হয় রহিমা বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, স্বামী খুব অসুস্থ। একমাত্র মেয়ে মায়াকে নিয়ে দিনযাপন করছেন। কষ্টেই তাদের জীবন চলে। স্বামীর যা জমি ছিল নদীতে গ্যাছে, আমার কেউ নেই। বেড়িবাঁধের পাশে কোনো রকম থাহি। অন্যের বাড়িতে কাম কইরা খাই, আর কাম না পাইলে খয়রাত (ভিক্ষা) কইরা দিন চলে। কথা হয় হাওয়া নুরের সঙ্গে, তিনিও বলেন, আমি রাস্তার শ্রমিক। তিন সন্তান ও অসুস্থ স্বামী নিয়ে ঝুপড়ি ঘরে জীবন কাটছে। ইউএনওর কাছে একটা সরকারি ঘর চাইছি। কিন্তু তিনি দেন না।
রায়পুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইমরান খান বলেন, আমাদের পর্যবেক্ষণ রয়েছে ‘জমি আছে ঘর নাই’ সরকারের প্রকল্পের আওতায় আনার চেষ্টা করবো। সরকারি সহায়তা আসলে কিছু দেওয়া হয়। যাদের ঘর নেই, তাদের দেওয়ার চেষ্টা করবো।