শনিবার, ০৬ ডিসেম্বর, ২০২৫
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ১৫ নভেম্বর ২০২৫, ০৯:৩৯

ধারাবাহিক উপন্যাস-১৫

নিকুঞ্জ নিকেতন

রাজীব কুমার দাস
নিকুঞ্জ নিকেতন

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

১০.

বাসায় এখন আর যেতে মন চায় না কারণ বউ-ছেলেদের তিক্ততা ভালো লাগে না। একটা মানুষকে যদি গলা টিপে না মারা যায় তাহলে তাকে প্রতিনিয়ত অভিশাপ বা তিক্ত ব্যবহার করলেই সে ধীরে ধীরে মারা যাবে। নরেন্দ্র দা ঠিকই বলেছিলÑতোমার পরিশ্রমের অর্জন তোমার কাছে যতটা মূল্যবান সেটা সন্তানদের কাছে থাকবে না কারণ সে সেটা অর্জন করেনি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে। সম্পর্কগুলো এমন কেন? রক্তের টান বা মায়ার বন্ধন বলতে কিছুই নেই যা আছে তা লেনদেন, আদান-প্রদান। পরিবারে মানুষগুলোর মাঝে ভালোবাসার বন্ধন যদি না থাকে তাহলে আপন আর পরের মধ্যে পার্থক্য কোথায়। আড্ডায় গেলে নিজেকে লুকিয়ে রাখি কারণ আমার সমস্যাগুলো অন্যের কাছে প্রকাশ করতে পারি না। বাবারা সারাজীবনের ত্যাগ, পরিশ্রম, বির্সজনে গড়ে তোলে সন্তানদের আর সে সন্তান যখন অচেনা হয়ে যায় তখন সারাজীবনের এই ত্যাগ হয়ে যায় বৃথা। জীবনের শেষটা সন্তানদের নিয়ে গর্ব করার বয়স। কিছু মানুষ যখন একসাথে জড়ো হয় তখন একে অপরের সন্তানের সফলতাগুলো তুলে ধরে আর আমার মতো যারা আছে তারা শুধু মুখ লুকিয়ে যায়। আমি গড়তে পারিনি তাই ব্যর্থতার দাবিদার আমি নিজেই। দুপুর গড়িয়ে বিকেল প্রায় এখনো তো আমাকে কেউ খাবার জন্য ডাকতে আসেনি। তাদের অভিমান আজও ভাঙ্গেনি যাক আমি নিজে গিয়ে খেয়ে আসি, টেবিলে হয়তো সবকিছু রেখে দিয়েছে। বিছানা থেকে উঠে চলে আসি ডাইনিং টেবিলের কাছে। দেখি যার যেমন খেয়ে দেয়ে সবকিছু গুছিয়ে দিয়েছে। টেবিলে কিছুই রাখা নেই পানির জগ-গ্লাস ছাড়া, কিচেনেও সবকিছু গোছান। মনটা ভেঙে গেল কিছুতেই খেতে ইচ্ছে করছে না এ পরিস্থিতি দেখে তবুও কিছু না কিছু খেতে হবে। ডায়াবেটিক রোগী ক্ষুদার্থ থাকলে সুগার ফল করলে বিপদ আবার ভাবি হয়ে গেলে একপ্রকার ভালোই হয়। এই অভিশপ্ত জীবন থেকে মুক্তি তো পাব! অন্যদিকে নতুন করে গড়ে ওঠা সম্পর্কটার জন্যও মায়া হয়। যেখানে আপনজনেরা অচেনা হয়ে গেছে সেখানে তিনটা মানুষ আপন না হয়েও আমার অনেকটা আপন। তাদের গ্রহণযোগ্যতা, মূল্যায়ন, ভালোবাসা আমায় নুুতন করে বেঁধে দিয়েছে। ফ্রিজটা খুলে দেখি একটা বাটিতে কিছু ভাত রাখা যা ঠান্ডা হয়ে আছে আর একটু সব্জি। প্লেটটা নিয়ে একটু ভাত মেখে মুখে দিলাম। একটা সময় এই টেবিলের চারপাশ থাকত ছেলে-বউÑনাতি-নাতনি অথচ আজ চেয়ারগুলো ফঁাকা আমার জীবনটার মতো। চাইলেও এখন আর শূন্য চেয়ারগুলো আমার জন্য ভরাট হবে না। ফ্রিজের ঠান্ডা ভাত ভালো লাগছে না তবু বেঁচে থাকার জন্য হলেও খেতে হবে। থালাবাসন ধুয়ে জায়গামতো রেখে আমার রুমে চলে আসি। বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই কেমন যেন নিস্তেজ হয়ে আসছে দেহ। সময়মতো খাবার না খাওয়ায় শরীরে কঁাপুনি ধরে গেছে ব্লাড সুগার ডাউন হয়ে। বড় করে বঁাধাই করা তাদের মায়ের ছবিটা দেওয়ালে ঝুলছে আমি তাকিয়ে আছি অপলক যেন সে আমার সামনেই আছে। তার কাছে অভিযোগ দেইÑকেন চলে গেলে একা। দুজনে একসাথে গেলে কী এমন ক্ষতি হত? অবশ্য ভালোই হয়েছে আর কিছুদিন থাকলে হয়তো আমার মতো তোমারও অভিযোগ থাকত। জীবনের এ কঠিনতম বাস্তবতা থেকে অন্তত: তুমি অজানা থাকলে, ভালোই হলো। নয়তো সন্তানকে জন্ম দেওয়ায় একটা দুঃখ থেকে যেত ব্যর্থতার জন্য। যখন চলে আসব তোমার কাছে তখন জানতে চাইবে না ওদের বিষয়ে। আমি বাবা হয়ে সন্তানদের তিক্ততা তোমায় বলতে পারব না। পরবতর্ী কয়েকদিন বাসায় এভাবেই চলে তারপর একদিন বিকেলে চলে আসি আড্ডায়। এখন আমি আড্ডার নিয়মিত ছাত্র। সময়ের আগেই এসে বসে থাকি কারণ এখানে আড্ডার মাঝে হালকা-পাতলা নাশতা করা হয় সকলে মিলে। আমার দুপুরে কখনো ব্রেড আবার কখনো এটা সেটা খেয়ে থাকতে হয়। বাসায় এখন হয়তো আমার জন্য রান্নাও করা হয় না। এটা সেটা খেলেও ক্ষুধা মিটে না তাই বিকেলের নাশতাটার জন্য বসে থাকি আবার কখনো নরেন্দ্রদার বাসায় আড্ডা জমে গেলে রাতের খাবারটাও খাওয়া হয়ে যায়। আমি বেশ কয়েকটা রাত কোনো রকম খেয়ে কাটিয়েছি বাসায়। নাতি-নাতনিরা লুকিয়ে এটা সেটা এনে দিয়ে যায়। প্রথমে নিতাম না অভিমানে এখন আমার প্রয়োজনেই নিয়ে নেই। দিনে দিনে শরীরটা বেশ দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। তারপর একদিন বিকেলে নরেন্দ্রদার বাসায় জমেছিল আড্ডা। আমি অপেক্ষায় ছিলাম কখন নাশতাটা আসে কিন্তু সেদিন নাশতা আর কেহ আনছে না এদিকে ক্যারামের গুটিতে আমার খেয়াল নেই। তখন সইতে না পেরে বলে ফেলিÑতোমাদের কী খিদে পায়নি, চা টা কিছু খাবে না? সকলে আমার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। নিজেকে কেন যেন এলোমেলো করে ফেলছি। কী করলাম তা নিজেও জানি না। তাপর হঠাৎ নরেন্দ্রদা বলে উঠলেনÑ

‘আরে সত্যি তো। খেলায় এতটা মেতে গেছি যে নাশতার দিকে খেয়ালই নেই। মনমোহন আমাদের সকলের জন্য নাশতার ব্যবস্থা করে নিয়ে আস তাড়াতাড়ি, বেশ খিদে পেয়েছে।

‘আজ্ঞে বাবু আপনি না বললেও আমি তৈরি করছিলাম আর অল্প কিছু সময় লাগবে।

কিছু সময়ের মধ্যেই নাশতা নিয়ে হাজির হলো মনমোহন। আমার দেরি সহ্য হচ্ছে না কিন্তু লোকলজ্জায় আমি নিজেকে দমিয়ে রাখলাম। আজ দুটো টোস্ট খেয়ে লাঞ্চ সেরেছিলাম। ক্ষুধা এতটাই বেড়েছিল যে কিছুই ভালো লাগছিল না। আমরা সকলেই নাশতা করছি কিন্তু আমার নাশতার দিকে মনযোগটা বেশি ছিল। একপর্যায়ে তাকিয়ে দেখি আমার দিকে সকলে সন্দেহর চোখে তাকিয়ে আছে। বুঝতে বাকি নেই ওরা সবকিছু বুঝতে পারছে। আমি থেমে যাই, এই বুঝি হেরে গেলাম। তখনি অনিমেষ বলে উঠলÑ

‘আচ্ছা নরেন্দ্র দা আমাদের এই গতানুগতিক জীবন থেকে বেড়িয়ে আমরা নতুন কিছু ভাবতে পারি না?’

‘অবশ্যি পারি। কী করতে চাইছ সেটা বলে ফেল। কোনো প্ল্যান মাথায় আছে নাকি?’

‘আমরা বাইরে কিছুদিনের জন্য কাটাতে পারি না?’

‘বাহ্ পার্টনার ভেবেই নিয়েছ যখন তখন সবাই মিলে একটা প্ল্যান করে ফেলি কী বল পিটার।’

‘আমার বোধ হয় যাওয়া হবে না তোমরা না হয় গিয়ে ঘুরে আস।’

‘কোথাও যদি যাওয়া হয় তাহলে চারজন একসাথে যাব, নয়তো না। কী বল সারোয়ার?’

‘ঠিক বলেছ নরেন দা। গেলে চারজন নয়তো না। টাকা পয়সা নিয়ে কেহ কিছু ভেব না পকেট ঝেড়ে যা আসবে তাতেই ঘুরে আসব। টাকা বেশি হলে বিলাসিতা নয়তো গরিবের মতো ঘুরব কিন্তু ঘুরতে যাওয়া চাই। পিটার শোন, আমরা যেখানে আছি সেখানে কোনো টেনশন তোমার করা লাগবে না তাই যাওয়ার বিষয়ে আর কোনো এক্সকিউজ দেখাবে না প্লিজ।’

‘এক কাজ করÑপিটার তুমি বল কোথায় যাওয়া যায়?’

‘আগে বাজেট হোক তারপর না হয় স্থান ঠিক করা যাবে দাদা।’

‘বাজেট হয়ে যাবে। সারোয়ার বলেছে তোÑপকেট ঝেড়ে যা আসবে তাতেই ঘুরে আসব। টাকা বেশি হলে বিলাসিতা নয়তো গরিবের মতো ঘুরব। তুমি বল কোথায় যাওয়া যায়? আচ্ছা তোমার কোন জায়গাটা যাওয়া হয়নি এখনো।’

‘আমি সমুদ্র দেখিনি। প্রায়ই ইচ্ছে হতো কক্সবাজার গিয়ে ঘুরে আসি কিন্তু সময়ের কারণে হয়ে উঠেনি আর এখন তো আমি পেনশনার তাও শুধু মেডিকেল প্রাপ্য। চাইলেও যেতে পারব না।’

‘তাহলে তোমাদের আর কোনো প্ল্যান আছে?’

‘আমিও প্রস্তুত কক্সবাজারের জন্য। কী বল সারোয়ার তোমার কী মতামত?’

‘মতামত! যেখানে যাবে আমায় সাথে রাখবে আর কোনো চাহিদা নেই জনাব।’

‘হা হা হা... তাহলে আমাদের জায়গা ঠিক হলো আমরা কক্সবাজার যাচ্ছি। তা কবে নাগাদ যেতে পারি সেটা ঠিক কর সকলে।’

‘আগামী শুক্রবার হলে খারাপ হয় না।’

‘আমরা প্রায় চার-পঁাচদিন বাইরে কাটাব সে অনুযায়ী সবকিছু গুছিয়ে নিবে সকলে।’

‘অনিমেষ তুমি তোমার নাতি নাতনির স্কুলের বিষয়টা ম্যানেজ করে গুছিয়ে নাও আর আমি আমার পেনশন ফান্ড থেকে টাকা উঠিয়ে নিব। আমাদের হাতে আছে দুটো দিন তারপর বৃহঃস্পতিবার রাতে রওয়ানা দিব। এই দুই দিনে আমাদের যার যার কাজ গুছিয়ে নিব, নিজেদের চেকআপ করানো থাকলে তা করিয়ে নিব, যার যেমন সাধ্য টাকা-পয়সা নিয়ে নিব। এর মধ্যে আমাদের অনলাইনে বীচ রিসোর্টে বুকিং দিতে হবে।’

‘দাদা আমি যে অপারক।’

‘তুমি অপারককে বলেছে। আমাদের চারজনের জুটি তোমাকে ছাড়া অসম্ভব তাছাড়া এত সুন্দর একটা জায়গা নির্বাচন করলে তাতেই চলবে। পিটার, আমাদের সম্পর্ক শুধু চা খাওয়া আর ক্যারাম খেলাই নয় এর চাইতেও বেশি কিছু।’

‘আমরা গতানুগতিক জীবন থেকে বেড়িয়ে নিজেদের মাতিয়ে রাখতে চাই। যার যেমন ইচ্ছে আছে সেগুলো সাধ্যের ভেতর পূরণ করব। টাকা তোমার নাই আমার আছে, আমার নেই তার আছে, আছে তো। এটা নিয়ে মাথা না ঘামালেও চলবে।’

‘আমাদের বুকিং আর ট্রান্সপোর্ট খরচ বাদ দিয়ে যে টাকাটা থাকছে সেটা ঘোরাফেরায় কাজে লাগাব। পিটার এই দু দিন অনেক কাজ করতে হবে আমি একা করতে পারব না তুমি আমার সাথেই থাকছ। কাল ভোরে ব্যাগটা নিয়ে আমার বাসায় চলে আসবে। আমরা দু ভাই মিলে সবকিছু গুছিয়ে নিব।’

‘আরে নরেন দা শুধু পিটার কেন আমিও থাকছি তোমার সাথে। তোমার কী কাজ আছে আমায় বল তুড়ি বাজিয়ে শেষ করে দিব।’

‘ধন্যবাদ সারোয়ার, পিটার হলেই যথেষ্ট আমার আর অন্য কাউকে প্রয়োজন হবে না। পিটার তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে তুমি একটু দেরি করে যাবে।’ [পরের পর্ব আগামী সংখ্যায় দেখুন]

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়