মঙ্গলবার, ০৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫  |   ২৯ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৮:৩৪

আমার প্রিয় শিক্ষক

সামিরা মেহনাজ নুসরাত
আমার প্রিয় শিক্ষক

শিক্ষা হলো মূলত মিথ্যার অপনোদন এবং সত্যের আবিস্কারক। অর্থাৎ শিক্ষা মিথ্যাকে ধ্বংস করে আর অন্যদিকে সত্যকে নতুন করে আবিস্কার করে। যে ব্যক্তি অন্যের সম্পর্কে জানে সে শিক্ষিত আর যে তাঁর নিজের সম্পর্কে জানে সে হলো জ্ঞানী। আর এই জ্ঞান ছাড়া শিক্ষা কোনো কাজে আসে না। এই শিক্ষা এমনি এমনি কেউ অর্জন করতে পারে না। প্রত্যেকটি শিক্ষিত ব্যক্তির জীবনে একজন না একজন প্রিয় শিক্ষক থাকেনইÑযাঁর দ্বারা সে অনুপ্রাণিত হয়ে থাকে। ছাত্রজীবনে যাঁরা আমাদের শিক্ষাদানের মাধ্যমে আলোর পথ দেখান তাঁরাই আমাদের শিক্ষক।

একজন শিক্ষক হলেন মূলত মানুষ গড়ার কারিগর। তাঁরা অক্লান্ত পরিশ্রমে জ্ঞানের আলো বিলিয়ে দেন। একটি সাধময় সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার ক্ষেত্রে একজন আদর্শ শিক্ষকের ভূমিকা থাকে সর্বাগ্রে। বলা হয়ে থাকে, ‘জাতিকে তিনজন ব্যক্তি সফলতা দিতে পারেÑবাবা, মা এবং শিক্ষক।’ পিতা-মাতার বাহিরে, পরিবারের বাহিরে আমাদের ঠিকভাবে পরিচালনা করার মহৎ দায়িত্ব শিক্ষকেরাই নিয়ে থাকেন। আমরা শিক্ষার্থীরা একেক রকমের, একেক ধরনের পরিবার থেকে উঠে আসি শিক্ষকদের নিকট। চলমান ১৩ বছরের শিক্ষাজীবনে আমি অনেক শিক্ষকের সংস্পর্শে এসেছি। তাঁদের প্রত্যেকের কাছ থেকেই কিছু না কিছু শেখার চেষ্টা করেছি। এসকল শিক্ষকদের মাঝে বিশেষ কিছু গুণাবলির কারণে কোনো কোনো শিক্ষক আমাদের হৃদয়ে আলাদাভাবে স্থান করে নেন। হয়ে ওঠেন আমাদের প্রিয় শিক্ষক, প্রিয় মানুষ। আমার চলমান শিক্ষাজীবনেও তেমনি একজন প্রিয় শিক্ষক আছেন।

‘প্রিয় শিক্ষক’ শব্দযুগল মনে পড়লে যাঁর মুখ আমার চোখের সামনে ভেসে বেড়ায়, যাঁর সাথে কাটানো এক একেকটা স্মৃতি আমার স্মৃতিপটে আজও অক্ষত রয়েছে তিনি হলেন মো. মাসুদুর রহমান স্যার, মাতৃপীঠ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের দিবা শিফটের ‘ইংরেজি’ বিষয়ের শিক্ষক।

আমি যখন উক্ত বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী তখন স্যারের সান্নিধ্য লাভ করি। স্যার তখন সপ্তাহে ১ দিন আমাদের ইংরেজি বিষয়ের ক্লাস নিতেন। শ্রেণিকক্ষে এসে প্রথমেই তিনি জিজ্ঞেস করতেন, ‘আমরা কেমন আছি?’আমাদেত খোঁজখবর নিয়ে তারপর তিনি পড়ানো শুরু করতেন। অন্যান্য শিক্ষকদের চেয়ে তাঁর পড়ানোর কৌশলটা ছিল ভিন্ন এবং আকর্ষণীয়। তাঁর পাঠদানের ভঙ্গিটাই ক্রমে ক্রমে আমার মনটাকে জয় করে নিল। তিনি হয়ে ওঠলেন আমার সবচেয়ে প্রিয় শিক্ষক।

আমার প্রিয় শিক্ষক মো. মাসুদুর রহমান স্যার ছিলেন আদর্শ ব্যক্তিত্বের অধিকারী। উচ্চ ডিগ্রিধারী হয়েও তিনি শিক্ষকতার মতো মহান পেশাকে বেছে নিয়েছেন। সাধারণ মানুষের মাঝে শিক্ষাদানের মাধ্যমে সত্যিকারের মানুষ হিসেবে সচেতন করে তোলাই ছিল আমার প্রিয় শিক্ষকের একমাত্র ব্রত। তিনি ছিলেন সদালাপী এবং মিষ্টিভাষী। তবে শিক্ষার্থীদের পাঠদানের ক্ষেত্রে আমার এই প্রিয় শিক্ষক যেমনি ছিলেন কঠোর, তেমনি দরদিও। আর ব্যক্তিত্বের নানান গুণাবলি আমাকে মুগ্ধ করে।

একজন আদর্শ শিক্ষকের গুণাগুণ বিচারের ক্ষেত্রে তাঁর দায়িত্ববোধ ও কর্তব্যবোধ বিশেষভাবে বিবেচ্য। আমার প্রিয় শিক্ষকের মধ্যে এই দুটি প্রধান গুণ ছিল। তিনি যথাযথভাবে দায়িত্ব এবং কর্তব্য পালন করতেন। তিনি বিদ্যালয়ের বাইরে শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সমস্যা নিয়েও কথা বলতেন।

আমার প্রিয় শিক্ষক জনাব মো. মাসুদুর রহমান স্যার ছিলেন অসাধারণ চরিত্রের অধিকারী। মানবিক গুণাবলিকেও তিনি কখনোই ভাসিয়ে দেননি। বরং তিনি ছিলেন সুন্দর এবং আনন্দের পূজারি। স্যারের যেই গুণটি তাঁকে আমার প্রিয় শিক্ষকের আসনে অধিষ্ঠিত করেছে তা হলোÑতিনি কখনোই অন্যায়কে প্রশ্রয় দেননি। অহংকার তাঁর সবচেয়ে অপচ্ছন্দনীয় ছিল। তিনি সর্বদা আমাদের বলতেন কখনো অহংকার করতে নেই। অহংকার মানুষকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। তিনি যা যা বলতেন তাঁর প্রতিফলন ঘটাতেন তাঁর নিজের জীবন ও কর্মে।

আমার প্রিয় শিক্ষক একজন সৎ ব্যক্তিত্বের অধিকারীও ছিলেন। তিনি সৎ থেকে পরিশ্রমের মাধ্যমে অর্থ উপার্জনকে ইবাদত হিসেবে জ্ঞান করতেন। আর তাই আমাদের সুশিক্ষা দানের জন্য তিনি আমাদের চেয়ে বেশি অধ্যয়ন করতেন। ছাত্র-ছাত্রীদের কোনো সমস্যায় তিনি বিরক্তবোধ না করে বরং যত্নসহকারে জটিল বিষয়সমূহ বুঝিয়ে দিতেন। তাঁর আদর্শনিষ্ঠ জীবন আমার মতো হয়তো আরও অনেকেরই জীবনচলার পথে প্রেরণা হয়ে থাকবে।

আমার এই প্রিয় শিক্ষকের সাধারণ মানুষদের প্রতি ভালোবাসাও ছিল অকৃত্রিম। ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবাইকে তিনি একই স্রষ্টার সৃষ্টি হিসেবে ভালোবাসতেন। ধর্মানুরাগী এই শিক্ষক ধর্মের নানান বিধিনিষেধ শিক্ষার্থীদের প্রসঙ্গক্রমে স্মরণ করিয়ে দিতেন। তাঁর সহজ-সরল জীবনযাপন যে কারও মনকে আলোড়িত করে থাকে।

আমার প্রিয় শিক্ষক ছিলেন একজন সুসাহিত্যিকও। গল্প, কবিতা, প্রবন্ধসহ নানান বিষয়ে লেখালেখি করে ইতোমধ্যে তিনি বেশ সুনাম কুড়িয়েছেন। তাঁর লেখাতে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনদর্শন প্রকাশ পেয়েছে। সদ্য হাস্যোজ্জ্বল আমার এই প্রিয় শিক্ষক দেশ ও জাতির জন্যে নিঃসন্দেহে অনেক গর্বের।

আমার প্রিয় শিক্ষক ছিলেন একজন পণ্ডিত ব্যক্তি। তিনি নানান বিষয়ে পারদর্শী ছিলেন। প্রচুর অধ্যয়নের ফলে তাঁর মধ্যে নিজস্ব বোধের জন্ম হয়েছে। তাঁর শিক্ষাদান পদ্ধতি ছিল বিজ্ঞানসম্মত। সিলেবাস এবং কোর্স সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে তিনি যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। ক্লাসে পঠিত নানান বিষয়াবলিকে সহজ এবং গ্রহণযোগ্য করার জন্যে বাস্তব জীবনের নানান বিষয় টেনে আনতেন। এতে আমার পাঠের প্রতি আগ্রহ এবং কৌতূহল বেড়ে যেত।

জনাব মো. মাসুদুর রহমান স্যার শুধু আমার প্রিয় শিক্ষকই নন, একইসাথে তিনি অকৃত্রিম বন্ধু এবং নির্ভুল উপদেষ্টাও। তিনি নিজের ব্যক্তিত্বকে কখনোই বিন্দুমাত্র ক্ষুন্ন করেন না। তাঁর মধ্যে আমি সত্যÑসুন্দরের পরম প্রকাশকে খুঁজে পেয়েছি সর্বদা। তিনি একজন আদর্শ শিক্ষক। তিনি আমার চলমান শিক্ষাজীবনের অপরিসীম প্রেরণার উৎস। আমার মনের মণিকোঠায় তিনি চিরদিন অম্লান হয়ে থাকবেন।

বিদ্যালয় থেকে বিদায় নিলেও স্যার এর সাথে আমার বিদায়বেলা কখনোই না আসুকÑসেটাই চাই। পাশাপাশি স্যার এবং তাঁর পরিবারের সুস্থতা কামনা করি।

পরিশেষে আমার লেখা ‘প্রিয় শিক্ষক’ কবিতার কয়েকটি চরণÑ‘প্রিয় শিক্ষক/আপনার স্নেহে পরিপূর্ণ হয়েছে আমার শৈশব,/আপনার শিক্ষায় আলোকিত হয়েছে আমার ভবিষ্যৎ।/কখনও আপনি ছিলেন পথপ্রদর্শক,/কখনো বন্ধু, কখনো অভিভাবক।/প্রিয় শিক্ষক,/আপনার অনুপ্রেরণায় বদলেছে আমার দিগন্ত,/আপনার ধৈর্য, আপনার সহানুভূতি,/আমার জীবনের অমূল্য রত্ন,/প্রিয় শিক্ষক, আপনিই আমার জীবনের/অনন্য এক কারিগর।’

সামিরা মেহনাজ নুসরাত : একাদশ শ্রেণি, চাঁদপুর সরকারি কলেজ।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়