রবিবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০২৫
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ২৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১:৪৩

সভ্যতার আলোতে নৈতিকতার অন্ধকার

সুধীর বরণ মাঝি
সভ্যতার আলোতে নৈতিকতার অন্ধকার

মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। কোটি বছরের সভ্যতার ইতিহাস তার হাতের ছেঁায়ায় জ্বলে উঠেছে অসংখ্য আলোয়Ñচাকার আবিষ্কার, আগুনের দখল, বিজ্ঞানের বিস্ময়, ভাষার জন্ম, শিল্পের রূপকথা। মানুষের কল্পনা, বুদ্ধি ও সৃজনশীলতা প্রকৃতিকে নতুন করে সাজিয়েছে, সময়কে দিয়েছে নতুন মানে।সভ্যতার ইতিহাস মানুষের কৃতিত্বে পরিপূর্ণ : আবিষ্কার, বিজ্ঞান, শিল্প, ভাষা, দর্শনÑসবই মানুষের চিন্তাশক্তি, কল্পনা ও সৃজনক্ষমতার ফল। কিন্তু সমস্ত অর্জনের ভেতরেই লুকিয়ে আছে এক গভীর সংকটÑবিশ্বাসের সংকট। আমরা গর্ব করিÑমানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, শিল্প, সাহিত্যÑসবক্ষেত্রেই বিস্ময়কর সফলতা মানুষের। ছোটবেলা থেকেই আমরা শিখেছি, মানুষ যুক্তিবোধ, বিবেক, নৈতিকতা ও সৃজনশীলতার কারণে অন্য প্রাণী থেকে আলাদা। আজ মানুষই মানুষের কাছে সবচেয়ে অনিরাপদ। প্রতারণা, লোভ, সহিংসতা, স্বার্থ, মিথ্যাচারÑএগুলো যেন আমাদের সামাজিক জীবনের পরিচয় হয়ে উঠছে। যেখানে মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব হওয়ার গৌরব বহন করে, সেখানে মানুষই মানুষকে বিশ্বাস করতে পারে না। কিন্তু সমাজের বাস্তবতায় চোখ ফেরালেই দেখা যায় এক ভিন্ন সত্য। মানুষ মানুষকে বিশ্বাস করতে পারছে না; মানুষের কাছেই মানুষ অনিরাপদ। সমাজে সন্দেহ, প্রতারণা, কপটতা ও ভণ্ডামি এমনভাবে বিস্তৃত হয়েছে যে মানুষের মৌলিক গুণ ‘বিশ্বাস’Ñআজ গভীর সংকটে। অন্যদিকে আমরা যাদের ‘পশু’ বলে তাচ্ছিল্য করি, তাদের জীবনযাত্রায় নেই মুখোশ, নেই কপটতা, নেই হিসাবি প্রতারণা। তারা স্বভাবের নিয়মে চলে; সত্যের সরলতায় বঁাচে। এই বৈপরীত্য আমাদের প্রশ্ন করতে বাধ্য করেÑমানুষ কি সত্যিই সৃষ্টির সেরা জীব, নাকি সে নিজের অর্জনের অহংকারে নৈতিকতার মূল শিকড় ভুলে গেছে? এরিক ফ্রম দেখিয়েছেনÑআধুনিক মানুষ নিঃসঙ্গ। সম্পর্কগুলো অস্থায়ী, ক্ষণস্থায়ী ও স্বার্থনির্ভর।একাকিত্ব মানুষকে সন্দেহপ্রবণ করেÑআর সন্দেহ বিশ্বাসকে হত্যা করে।

মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব একটি বহুল আলোচিত ধারণা, কিন্তু দার্শনিকদের মাঝে এ বিষয়ে কখনোই পূর্ণ ঐকমত্য তৈরি হয়নি।এরিস্টটল মানুষকে বলেছেন ‘ৎধঃরড়হধষ ধহরসধষ’Ñযে যুক্তিবোধ দিয়ে নিজের জীবন সাজায়। হবস মত দিয়েছেন, মানুষ স্বভাবগতভাবে স্বার্থপর; সমাজ না থাকলে সে ‘সকলের বিরুদ্ধে সকলের যুদ্ধে’ লিপ্ত হতো। রুশো বলেন, মানুষ জন্মগতভাবে ভালো; সমাজই তাকে নষ্ট করে। ডারউইন দেখিয়েছেন, মানুষও অন্য প্রাণীর মতোই বিবর্তনের ধারায় গঠিত; তার আচরণও জৈব-প্রবৃত্তির ভিত্তিতে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। এই ভিন্ন মত প্রমাণ করেÑমানুষের ‘সেরা’ হওয়ার ধারণা মোটেই সরল নয়। তার বুদ্ধিমত্তা যেমন তাকে উঁচুতে তুলেছে, তেমনি সেই বুদ্ধিই তাকে করেছে প্রবঞ্চনার কারিগর, মুখোশধারী এক জটিল প্রাণী।

আমরা যাদের ‘পশু-প্রবৃত্তি’ বলে অবমাননা করি, তাদের জীবনযাত্রায় রয়েছে এক ধরনের নির্মল সত্য। একটি সিংহ শিকার করেÑবন্ধুত্বের ভান করে ধেঁাকা দেয় না। একটি হরিণ পালায়Ñকিন্তু ভয়কে ঢাকতে কোনো ছলনা করে না। একটি নেকড়ে তার দলে বিশ্বাসঘাতকতা করে না, কারণ তার আচরণ নির্ধারিত হয় সহজ জীবনীশক্তির নিয়মে।

জীববিজ্ঞানী কনরাড লরেঞ্জ, ডায়ান ফসি, জেন গুডলÑএরা গবেষণায় দেখিয়েছেন, প্রাণীরা অনেক সময় কৌশল ব্যবহার করে, কিন্তু ইচ্ছাকৃত মিথ্যা বা পরিকল্পিত প্রতারণার ক্ষমতা তাদের নেই। তাদের প্রবৃত্তি সীমিত, কিন্তু স্বচ্ছ; তারা যা, তাইÑমুখোশ নেই, দ্বিচারিতা নেই। পশুরা প্রবৃত্তির নিয়মে চলেÑক্ষুধা, ভয়, নিরাপত্তা ও প্রজননকে কেন্দ্র করে তাদের আচরণ। কিন্তু তাদের সমাজে নেই মানুষের মতো ভণ্ডামি বা পরিকল্পিত বিশ্বাসঘাতকতা। আধুনিক গবেষণার আলোকে মানুষের অবিশ্বাস শুধু নৈতিকতার অবক্ষয় নয়, এটি সামগ্রিক সামাজিক কাঠামোর সংকট।

মানুষের ঠিক বিপরীত চিত্র ফুটে উঠে সমাজেÑ মুখে এক কথা, মনে আরেক। সামনে এক আচরণ, আড়ালে অন্য। ভালোবাসায় সুবিধার হিসাব। সম্পর্কের আড়ালে ব্যক্তিস্বার্থের বাণিজ্য। এই বৈপরীত্যই মানুষের নৈতিক সংকটকে উন্মোচিত করে। সমাজবিজ্ঞানী রবার্ট পুটনাম দেখিয়েছেনÑসমাজে পারস্পরিক বিশ্বাস কমে গেলে ‘ঝড়পরধষ ঈধঢ়রঃধষ’ ভেঙ্গে পড়ে; অপরাধ বাড়ে, জনগণের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়। আজকের সমাজে সেই বিচ্ছিন্নতার ছায়া স্পষ্ট।

স্বার্থ, সাফল্য ও প্রতিযোগিতার চাপ মানুষকে করেছে আরও হিসাবি। মানুষের কাছে মানুষ হয়ে উঠছে প্রতিদ্বন্দ্বী; মানবিকতা ও আস্থার স্থান নিচ্ছে সন্দেহ। ডুর্খেইম-এর মতে, নৈতিক মূল্যবোধ ভেঙ্গে গেলে সমাজ ‘ধহড়সরব’Ñঅস্তিত্বশূন্যতায় পড়তে থাকে। আজ পরিবার ছোট; সম্পর্ক দ্রুত ভাঙ্গে; মানবিক শিক্ষা কমে গেছে। এ শূন্যতা মানুষের মধ্যে সন্দেহ বাড়ায়, বিশ্বাস কমায়। মনোবিশ্লেষক ফ্রয়েড ও জং বলেছেন, মানুষের ভেতরে থাকে বহু মুখÑঅবচেতন, অচেনা সত্তা। এই বহুমাত্রিক মনই তাকে করে তোলেÑ প্রতারণাশীল মুখোশধারী হিসাবি দ্বৈত চরিত্রের অধিকারী, যে প্রবৃত্তি পশুর নেই। মানুষের বুদ্ধি তাকে দিয়েছে অনন্য শক্তিÑ সৃজনশীলতা, আবিষ্কার, সভ্যতা, প্রযুক্তি, কিন্তু একই বুদ্ধি তাকে শিখিয়েছেÑ মিথ্যে বলা সম্পর্কের হিসাব রাখা সুবিধার জন্যে বিশ্বাস ভাঙ্গা আবেগকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা।একটি পশু জানে না কীভাবে কৌশল করে বিশ্বাস ভাঙতে হয়। মানুষ জানে এবং চর্চাও করে।পশুরা স্বভাবসিদ্ধ; মানুষ স্বার্থসিদ্ধ।

এই প্রশ্ন আবেগে আঘাত হানে। তবু সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে তা উপেক্ষা করা যায় না। পশুর আচরণ সরলÑপ্রবৃত্তির কাছে সত্য। মানুষ বহুরূপীÑমুখোশে মোড়া। পশুর সমাজে নেই ছলনা ।মানুষের সমাজে ছলনা প্রায় স্বাভাবিক। পশুরা যা, তাই থাকে। মানুষ যা নয়, তা-ও দেখায়। তাহলে মানুষ কোথায় শ্রেষ্ঠ?উত্তরÑতার সক্ষমতায়। মানুষ সচেতনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে, নৈতিকতা বেছে নিতে পারে, নিজের ভুল সংশোধন করতে পারে।এই সচেতনতার ক্ষমতাই মানুষকে পশুর চেয়ে মহান করেÑযদি সে তা কাজে লাগায়।

মানবিকতা, সততা, দায়িত্ববোধÑশিশুর মনে এগুলো গড়ে উঠে পরিবারে। নৈতিকতার শিক্ষা যত কমে, তত বাড়ে সামাজিক সংকট।প্রশাসন, কর্মক্ষেত্র, রাজনীতিÑসব জায়গায় স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা না হলে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানÑকোনোটিই বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না। শিক্ষা শুধু ডিগ্রি নয়, শিক্ষার উদ্দেশ্য হওয়া উচিতÑ সহমর্মিতা, নৈতিকতা, দায়িত্ববোধ, মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি। এসব শেখানো না হলে সমাজ আরও যান্ত্রিক হবে, আরও অবিশ্বাস বাড়বে। প্রত্যেক মানুষকে নিজের কাছে প্রশ্ন করতে হবেÑআমি কি সত্যবাদী?আমি কি অন্যকে নিরাপদবোধ করাই? আমার মুখে ও মনে কি একই কথা?সুবিধার জন্যে কি আমি মূল্যবোধ বিসর্জন দিই?

নিজেকে না বদলালে সমাজ বদলায় না।

সভ্যতার আলো আমাদের পথ দেখিয়েছে, কিন্তু মানুষের নৈতিক অন্ধকার সেই আলোকে বারবার ম্লান করে দেয়। বিশ্বাস ভেঙ্গে গেলেÑসম্পর্ক থাকে না, সমাজ টেকে না, মানুষ তার মানবত্ব হারায়।বনের পশুরা শেখায় মুখোশহীন থাকার পাঠ; তারা যা, তাই। মানুষই একমাত্র প্রাণী যে সত্য জানে, তবু ছলনা বেছে নেয়। তাই প্রশ্নটি সহজÑমানুষ কি সত্যিই সৃষ্টির সেরা জীব?উত্তর আরও সহজÑহ্যঁা, কিন্তু শুধু তখনই, যখন মানুষ সততার পাশে দঁাড়ায়, আস্থাকে রক্ষা করে এবং মানবিকতাকে সিদ্ধান্তের কেন্দ্রে রাখে। মুখোশ নয়, সত্যই মানুষকে মহান করে। প্রবৃত্তি নয়, নৈতিকতাই মানুষকে মানুষ প্রমাণ করে। এবং বিশ্বাসই মানুষকে মানুষের কাছে নিরাপদ করে তোলে। মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব জন্মগত নয়, এটি প্রতিদিনের নির্বাচন।সভ্যতার আলো আমাদের উজ্জ্বল করে তোলে ঠিকই, তবে মানুষের নৈতিক অন্ধকার সেই আলোকে ক্ষীণ করে দেয়।মানুষ মানুষকে বিশ্বাস করতে না পারলে সম্পর্ক ভাঙ্গে, সমাজ দুর্বল হয়, মানবতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।বনের পশুরা শিক্ষা দেয়Ñস্বভাবের সরলতা, সত্যের স্বচ্ছতা, মুখোশহীন অস্তিত্বের পাঠ। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীবÑকেবল তখনই, যখন সে সততা, আস্থা ও মানবিকতার পথ ধরে হঁাটতে পারে। নির্মল সত্য, উন্মুক্ত স্বচ্ছতা ও বিশ্বাসই মানুষকে মানুষ করে তোলে; সভ্যতার মুখোশ নয়। মানুষ যদি তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে চায়, তবে তাকে ফিরতে হবে সত্যের স্বচ্ছতায়, আস্থায় মানবিকতায়। তবেই মানুষ মানুষকে নিরাপদ করে তুলতে পারবে এবং সত্যিকার অর্থেই প্রমাণ করতে পারবেÑসে সৃষ্টির সেরা জীব।

সুধীর বরণ মাঝি : শিক্ষক, হাইমচর সরকারি মহাবিদ্যালয়, হাইমচর, চাঁদপুর।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়