প্রকাশ : ১৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৮:৩৭
ক্ষমা, উদারতা ও আরবদের যুদ্ধ বন্ধে রাসূল (সাঃ)-এর অনন্য উদ্যোগ

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবুয়ত লাভের আগে থেকেই আরবের অস্থিতিশীল পরিবেশে শান্তি, ভারসাম্য ও সাম্য প্রতিষ্ঠায় কাজ করেছেন। ভালোবাসার সমাজ নির্মাণে তিনি অন্যকে ক্ষমার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন বারবার। নবুয়ত প্রাপ্তির আগেই ‘হিলফুল ফুযুল’ কল্যাণ সংস্থা গঠন করে মানবতাকে ফিজার যুদ্ধ পরবর্তী ভয়াবহ বিপর্যয় থেকে রক্ষা করেছেন তিনি। তার অনন্য এই গুণের বর্ণনা আম্মাজান খাদিজা (রাঃ) বর্ণনা করেছেন এভাবে, আল্লাহ কখনোই আপনাকে লাঞ্চিত করবেন না। আপনি তো সম্পর্ক রক্ষাকারী, দুর্বলের বোঝা বহনকারী, অসহায়ের ত্রাতা, অতিথির সেবাকারী এবং মানুষের বিপদের আশ্রয়স্থল।
নির্মম নিপীড়নের পরেও তায়েফবাসীকে ক্ষমা এবং দাউস গোত্রের লোকদের জন্য হেদায়াতের দোয়া করা রহমতের নবী ক্ষমা দিয়ে, দয়া দিয়ে মানুষের হৃদয়ে এমনই আসন জয় করে নিয়েছিলেন যে, বদরে, উহুদে, হুদায়বিয়াতে সাহাবাদের আত্মোৎসর্গের হাজারো ঘটনা পৃথিবীবাসী প্রত্যক্ষ করেছে।
‘আপনার নির্দেশ পালনে আমরা সমুদ্রে ঝঁাপিয়ে পড়তেও সামান্য দ্বিধা করব না’— ইতিহাসের কিতাবগুলোতে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত সা'দ ইবনে উবাদাহ রা.-এর এই ঐতিহাসিক ভাষণটি আত্মোৎসর্গের অতি ক্ষুদ্র একটি উদাহরণ।
আরবের গোত্রগুলোতে শতাব্দীকাল ধরে চলা ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধের অবসান করতে আলোর নবী রহমাতুল লিল আলামীন মানুষের মাঝে ভালবাসার এমনই প্রাণ সঞ্চার করেছেন যে, কোরআন সে ঘটনাকে এভাবে স্মরণ করছে, েেতোমরা ছিলে এমনই শতধা বিভক্ত যে, ধ্বংসের কিনারে পেঁৗছে গিয়েছিল। কিন্তু পরস্পরে ভ্রাতৃত্ব গড়ে দিয়ে তিনি তোমাদেরকে রক্ষা করেছেন।
যাতুর রিকার যুদ্ধ থেকে প্রত্যাবর্তনকালে খুনের নেশায় মত্ত দুসুর নামের এক বেদুঈনের চরম ধৃষ্টতার জবাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম ক্ষমার যে অনন্য নজির স্থাপন করেছিলেন ইতিহাস তা এভাবে স্মরণ করে, রাসূল যুদ্ধ সফরে দীর্ঘ পথচলার ক্লান্তি এবং অবসাদ ঘোচাতে ছায়া মতন একটি জায়গায় বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। অদূরে কঁাটাদার একটি গাছে ঝুলিয়ে রাখলেন খাপবদ্ধ তরবারি। এক বেদুঈন-লোকমুখে নিন্দামন্দ শুনে যে নবীজীর প্রতি বিদ্বেষী হয়ে উঠেছে- রাসূলকে নিরুদ্বেগ ঘুমন্ত দেখে বদ-মতলব চরিতার্থ করার মোক্ষম সুযোগ মনে করল।
কোষমুক্ত তরবারি হাতে আক্রমণ উদ্ধত হয়ে বুদ্ধু লোকটি রাসূলকে চ্যালেঞ্জ ছূড়ে দিল, আসো মুহাম্মদ এবার, দেখি, আমার হাত থেকে কে বঁাচায় তোমায়? রাসূল নিরুত্তাপ। সামান্য ভয়হীন, দরাজ গম্ভীর কণ্ঠে তিনি জবাব দিলেন, কেন? আল্লাহ বঁাচাবেন।
খাপমুক্ত তরবারির সামনে অস্ত্রবিহীন এক ব্যক্তিকে নিরুদ্বেগ দঁাড়িয়ে আছে দেখে বেদুঈন ভড়কে গেল। হতাশা এবং ভীতি বিহ্বলতায় তার হাত থেকে তরবারি খসে পড়ে গেল। এবার রাসূল তরবারি উচিয়ে বললেন, বল দেখি, এবার তোমাকে কে বঁাচায়? হত্যা করতে এসে বিধ্বস্ত, ধরাশয়ী বুদ্ধু ব্যক্তি নিরুত্তর। তবে রাসূল তাকে ছেড়ে দিলেন। দৃষ্টতার চূড়ান্ত করা সত্ত্বেও দয়ার নবী বেদুঈনকে ক্ষমা করে দিলেন।
ইতিহাস আমাদেরকে আরও জানায়, রাসূলের দয়া, ক্ষমা এবং মহানুভবতা দেখে দুসুর পরে ইসলাম গ্রহণ করেছিল।
মদীনার পার্শ্ববর্তী ইয়ামার বিশিষ্ট ব্যক্তি সুমামার ইসলাম গ্রহণ পরবর্তী অভিব্যক্তিও সিরাতের কিতাবগুলোতে বিশেষ গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করা হয়।
হে আল্লাহর রাসূল, ইসলাম গ্রহণের আগে ‘মুহাম্মদ’ নামের চেয়ে ঘৃণিত কিছু আমার কাছে ছিল না। কিন্তু -আমার সমগ্র সত্ত্বা উৎসর্গিত হোক- ইসলাম গ্রহণের পরে আপনার নামের চেয়ে মধুর কিংবা আপনার শহরের চেয়ে প্রিয় কিছু এখন আর আমার কাছে নেই। অবশ্য রাসূলের সদাচারের আরও উত্তম নমুনাটি ইতিহাস আমাদেরকে জানাচ্ছে পরবর্তী ঘটনাবলী থেকে।
এককালে শিবে আবি তালিবে রাসূল এবং তার অনুসারীদের বয়কট করে খাদ্যকষ্টে নিপতিত করা পাষাণ প্রাণ কোরায়েশদের থেকে কঠিন প্রতিশোধের হুমকি দিলেন ইয়ামামার গোত্রপতি সুমামাহ বিন আসলাব। রাসূলের অনুমতি ছাড়া ইয়ামামাহ হয়ে একটি খাদ্যকণা বা শস্যদানাও মক্কায় প্রবেশ করবে না বলে হুশিয়ারি জারি করলেন ইসলামে নব দীক্ষাত সুমামাহ। তবে রাসূলের কাছে এ খবর পেঁৗছুলে তিনি চিন্তিত এবং দয়াপরবশ হয়ে পড়েন। 'রাহমাতুল লিল আলামীন' যার উপাধি, তিনি তো প্রতিশোধপরায়ন হতে পারেন না। এটা তো তার খুলুকে আযিম ভূষণকে কলঙ্কিত করবে।
সুমামাহকে পত্র লেখে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম তড়িৎ নির্দেশ দিলেন, এ কাজ করতে যেও না সুমামাহ। অবরোধ উঠিয়ে নাও। এরা তো আল্লাহর বান্দা। কাউকে খাদ্যভাবে রাখা শোভন কিছু নয়।
সদাচারের সর্বোত্তম দৃষ্টান্তটি স্থাপিত হয়েছে পৃথিবীর ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা তাৎপর্যপূর্ণ মক্কা বিজয়ের গৌরব অর্জন করার দিন।
‘আজ চূড়ান্তু যুদ্ধের দিন। আজ শত্রুদের দখল থেকে কাবাকে অবমুক্ত করার দিন'-এক আনসারি সাহাবির জবানে এমন ঝঁাঝালো, কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারিত হতে শুনে কোমল প্রাণ, দয়ার নবী ছোট্ট একটি সংশোধন এনে বললেন,
‘আজ দয়া ও ভালবাসার দিন। আজ কুরায়শের সম্মানিত হওয়ার দিন’।
মুক্তির বার্তাবাহক দয়ার নবীকে জন্মভূমিতে থাকতে না দেওয়া পাষাণ দিল কাফেরের দলকে কাবা ঘরের সামনে জড়সড় কম্পিত দণ্ডয়মান দেখে নবীজীর হৃদয়ে ক্ষমা এবং মায়ার জোয়ার উঠল।
আত্মম্ভরিতা এবং শয়তানের প্ররোচনায় এক সময় সত্য দ্বীনের বিরুদ্ধবাদীদের কোমল সম্ভাষণে জিজ্ঞেস করলেন, হে কোরায়শ, তোমাদের কী আশা, আজকের দিনে তোমাদের সাথে কেমন আচরণ করা হবে?
উপস্থিত জনতা মধুবর্ষণে বিমুগ্ধ হয়ে উত্তরে জানালো- আমরা তো ভালো কিছুরই আশা করি। আপনার ব্যক্তিত্ব সম্ভ্রান্ত। আপনি তো সম্মানিত ভাই এবং কূলীন ঘরের সন্তান।
অতঃপর রহমাতুল লিল আলামীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আজ আমি তাই বলব, ইউসুফ আলাইহিস সালাম যা তার ভাইদের বলেছিলেন, ‘আজকের দিনে তোমাদের প্রতি কোনো অনুযোগ নেই। যাও তোমরা সবাই মুক্ত’।
এর আগেই মক্কায় প্রবেশের সময়ই ঘোষণা করা হয়েছিল, আবু সুফিয়ানের ঘরে যে আশ্রয় নিবে সে নিরাপদ। যে নিজ ঘরে আশ্রয় নিবে তাকেও কিছু করা হবে। হারামে আশ্রয়গহণকারীদেরও দেওয়া হবে পূর্ণ নিরাপত্তা।
এছাড়াও ইকরিমা, হিনদা, ওয়াহশিসহ অল্প যে কয়জনের ব্যাপারে ঘোষণা করা হয়েছিল- তাদের ক্ষমা নাই- তাদেরও সবাই প্রায় ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় লাভ করেছিলেন।
তবে রাসূল কেবল স্থানের জয় করেননি। জগতের জন্য রহমত হিসেবে যাকে পাঠানো হয়েছে আলোর নবী মুহাম্মাদ রাসূল দয়া, মমতা এবং সম্ভমতা দিয়ে সমস্ত মানুষের হৃদয় জয় করলেন।
মক্কা বিজয়ের দিন এক ব্যক্তি কোনো একটা বিষয় নিয়ে নবীজীর সাথে কথা বলতে এসে ভয়ে কঁাপছিল দেখে রাসূল বললেন, কী হলো তোমার! ভয় কিসের? আমি কি কোনো বাদশাহ? আমি তো কুরায়শের এক সাধারণ মায়েরই সন্তান!
এটা ছিল সেই ব্যক্তির উত্তর; নানামুখী অত্যাচারের শিকার হয়ে যিনি একদিন প্রিয় জন্মভূমি মক্কা ছেড়ে হিজরত করতে বাধ্য হয়েছিল।
ছবি-১২
তীব্র শীতে তায়াম্মুম করা যাবে কি?
ঠান্ডা পানি দিয়ে অজু বা গোসল করা যদি কারো জন্য ক্ষতির কারণ হয়, তাহলে দেখতে হবে পানি গরম করার সুযোগ আছে কি না। পানি গরম করার সুযোগ থাকলে তার কর্তব্য পানি গরম করে অজু-গোসল করা। পানি গরম করার সুযোগ থাকার পরও তায়াম্মুম করা বৈধ হবে না।
যদি পানি গরম করার কোনো রকম সুযোগ না থাকে এবং ঠান্ডা পানি দিয়ে অজু-গোসল করলে তীব্র শীতে তার মৃত্যু, অঙ্গহানি বা অসুস্থ হয়ে পড়া বা অসুখ বেড়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে যেমন- কোনো অঙ্গ অবশ হয়ে যাওয়া, বুকে ঠান্ডা লেগে যাওয়া, জ্বর বা সর্দি দেখা দেওয়া, এলার্জিক সমস্যা, বাত-ব্যথা, শ্বাসকষ্ট বা হঁাপানি বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি, তাহলে তার জন্য অজু-গোসলের পরিবর্তে তায়াম্মুম করা জায়েজ।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, তোমরা যদি অসুস্থ হও অথবা সফরে থাক, যদি তোমাদের কেউ মলত্যাগ করে আসে অথবা যদি স্ত্রী সহবাস কর তারপর পানি না পাও, তবে পবিত্র মাটি নাও এবং তোমাদের মুখ ও হাত তা দিয়ে মাসেহ কর। আল্লাহ তোমাদের জন্য কোনো সমস্যা সৃষ্টি করতে চান না, বরং তিনি চান তোমাদের পবিত্র করতে এবং তার নেয়ামত তোমাদের ওপর পূর্ণ করতে, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন কর। (সুরা মায়েদা: ৬)
অজু ও গোসলের পরিবর্তে এক নিয়মেই তায়াম্মুম করতে হয়। তায়াম্মুমের নিয়ম হলো, তায়াম্মুমের নিয়ত করে মাটি বা মাটিজাতীয় বস্তু যেমন বালু, পাথর, চুন ও সুরমা ইত্যাদি কোনো কিছুতে দুবার হাত লাগানো, একবার হাত দিয়ে মুখ মাসাহ করা, আরেকবার কুনুই পর্যন্ত উভয় হাত মাসাহ করা।
তায়াম্মুম অজু-গোসলের বিকল্প এবং অজু গোসল যে সব কারণে ভাঙে, সে সব কারণ যেমন মলমুত্র ত্যাগ ইত্যাদি কারণে তায়াম্মুমও ভাঙে। এ ছাড়া যে কারণে তায়াম্মুম করা হয়েছিল, তা দূর হয়ে গেলেও তায়াম্মুম ভাঙে। উল্লিখিত ক্ষেত্রে শীত কমে গেলে বা পানি গরম করার সুযোগ সৃষ্টি হলে তায়াম্মুম ভেঙে যাবে।
উল্লেখ্য, কনকনে শীত, বৃষ্টি বা এ রকম কোনো কারণে অজু করা কষ্টকর হলে ওই সময় অজুর সওয়াবও বেড়ে যায়। আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত আল্লাহর রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) একদিন সমবেত সাহাবিদের উদ্দেশে বললেন, আমি কি তোমাদের এমন আমলের কথা বলবো যে আমল করলে আল্লাহ গোনাহসমূহ মাফ করে দেবেন এবং মর্যাদা বৃদ্ধি করবেন? তারা বললেন, ’অবশ্যই, হে আল্লাহর রাসুল!’
আল্লাহর রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, কষ্টকর অবস্থায় পরিপূর্ণরূপে অজু করা, দূরত্ব অতিক্রম করে মসজিদে যাওয়া, এক ওয়াক্তের নামাজ আদায় করে পরবর্তী ওয়াক্তের নামাজের জন্য অপেক্ষা করা। (সহিহ মুসলিম: ৪৯৪)
তাই কনকনে শীত আমাদের জন্য গুনাহ মাফ, আল্লাহর কাছে মর্যাদা বৃদ্ধি এবং আল্লাহর নৈকট্য ও অনুগ্রহ লাভের বিশেষ সুযোগও নিয়ে আসে। প্রত্যেক ওয়াক্তের নামাজের জন্য অজু করা তো অবশ্য কর্তব্য। পাশাপাশি সারাদিনই অজু অবস্থায় থাকার চেষ্টা করা উচিত। আর শীত ও গরম সব অবস্থায়ই অজু করা উচিত ধীরে-সুস্থে, উত্তমরূপে, তড়িঘড়ি করে দায়সারাভাবে নয়। আল্লাহ তাআলা আমাদের তওফিক দান করুন!








