বৃহস্পতিবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫  |   ৩০ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৯:১৮

কালদগ্ধা নির্ঘণ্ট

বিমল কান্তি দাশ
কালদগ্ধা নির্ঘণ্ট

এই একবিংশতি শতাব্দির আগের এবং চলমান সরকারের শাসনামলেও কতিপয় উচ্ছৃঙ্খল জনতা নিজের হাতে রাষ্ট্রীয় আইন তুলে নেওয়া যে প্রাগৈতিহাসিক বর্ববতার কুৎসিত দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে তা নিশ্চয়ই প্রাকৃতিকভাবে ‘প্রত্যেক ক্রিয়ার সমান এবং বিপরীত প্রতিক্রিয়ায় পর্যবসিত হবে’। অধ্যাপক হ্যারল্ড লাস্কির মতে, সব মানবাধিকারই সমাজ থেকে সৃষ্টি হয়। মানবাধিকারের সার্বজনীনতাই বস্তুত ‘বাক স্বাধীনতা’। এরা পরস্পর নির্ভরশীল। কারণ বাক স্বাধীনতা কোন শাসক গোষ্ঠীকে খাটো করে না, বরং সংশোধিত আকারে উদ্ভাসিত হতে সাহায্য করে। ফলে কোনো সরকারেরই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ সংগঠন থাকতে নেই। এতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকে। এর একমাত্র নিয়ামকই হলো যথাযথ ‘নাগরিকত্ব বোধ’। আর নাগরিকত্ব বোধের উদ্রেক ঘটে শৈশবের মৌলিক নৈতিক শিক্ষা থেকে। যার অন্তঃসারশূন্য প্রকটতাই দেশে সৃষ্টি করেছে মবসন্ত্রাস-বিচারহীনতা-সামাজিক অসৌজন্যতা-দলবাজ-গলাবাজ-ক্ষমতাবাজ-মববাজ-মতলববাজ-ধর্মবাজ-বোমাবাজ-গুমবাজ-এবং খুনবাজদের। যাদের বেপরোয়া পদচারণার সাথে এ যেন সমস্ত বাংলাদেশীদের সামাজিক অবক্ষয়ের এক প্রাত্যহিক চিত্রে পরিণত হয়েছে। আমাদের বাঙালি চারিত্রিক প্রকৃতি তো এর সম্পূর্ণ পরিপন্থী ছিলো।

আমাদের দেশের চলমান প্রাথমিক শিক্ষায় নৈতিকতার ঘাটতির কারণেই এমনটি ঘটছে বলে মনে হয়। প্রাথমিক স্তরের শিক্ষায় অবশ্যই যা যুক্ত থাকাটা প্রয়োজন, তা শিষ্টাচার-দায়িত্ববোধ-পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ-সহানুভূতি-পরিচ্ছন্নতার দায়িত্ব এবং সম্প্রীতি বোধ এ সবের প্রভাবেই একটা শিশু নিখুঁত স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে যায়। শৈশবই নিয়মানুবর্তী হওয়ার প্রকৃষ্ট সময়। কবি কুসুম কুমারী দাশ আদর্শ ছেলের সংজ্ঞায় বলেছিলেন : ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে; কথায় বড় না হয়ে কাজে বড় হবে।’ বুক ফুলিয়ে বলতে হয়, তাঁরই জ্যেষ্ঠ ছেলে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি হলেন ‘জীবনানন্দ দাস’।

যে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় শিশুদেরকে মানবিক মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্যে জ্ঞান চর্চার পাশাপাশি সত্যবাদিতা এবং উন্মুক্ত মনের যথাযথ ‘ছবক’ শিখানো যায়, তাতেই সকল শিশু তারুণ্যসুলভ অপরাধমুক্ত হয়ে উন্নত সংস্কৃতিজাত উৎকৃষ্ট অর্জনে সফল হবেই এবং বৃত্তাতিক্রান্ত একটা উন্নত মানব সমাজ সৃষ্টি হবে।

এখানে শি-ক্ষ-ক শব্দটির তাত্ত্বিকতা খুবই আশাব্যঞ্জক ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে। যেমন শি দ্বারা শিক্ষিত শিষ্টাচারী, ক্ষ দ্বারা উদাত্ত ক্ষমাশীলতা এবং ক দ্বারা অশেষ কর্তব্যপরায়ণতা নির্দেশ করে। এতোসব দুর্লভ গুণে গুণান্বিত শিক্ষকের বিতরণকৃত শিক্ষাই জাতির প্রকৃত মেরুদণ্ড রূপে পরিগণিত হতে পারে। তবে শিক্ষকের মধ্যে জ্ঞানের গভীরতা, পাঠক্রমে রূপরেখা এবং শিক্ষকতার প্রকাশভঙ্গি এই তিনটি বিষয় শিক্ষা ক্ষেত্রে পরস্পর নিবিড় সম্পর্কযুক্ত। এখানে শিক্ষক হলো চুম্বক শক্তি, শিক্ষার্থী হলো চৌম্বক পদার্থ আর চুম্বকীয় আবেশ হলো শিক্ষকের প্রকাশভঙ্গি। সুরম্য অট্টালিকা নির্মাণে যেমন দৃঢ় ভিত্তির প্রয়োজন হয়, তেমনি নৈতিক সুশিক্ষায় শিক্ষিত হতে হলে বর্ণমালা-সংযুক্ত বর্ণমালার এবং সৃষ্টিশীল শিক্ষার সঠিক প্রায়োগিক ব্যবহার অপরিহার্য।

এক সময় এদেশের নৈতিক প্রাথমিক শিক্ষার মধ্যে এমন কিছু অমোঘ নীতি বাক্য ছিলো, যা চিরন্তন সত্য। যেমন : অসৎ সঙ্গ ত্যাগ কর, আলস্য দোষের আকর, উগ্রভাব ভাল নয় ইত্যাদি নৈতিকতায় ভরপুর বাক্যগুলো অজ্ঞাত কারণে প্রতিস্থাপিত হয়েছিলো অসামঞ্জস্যপূর্ণ কিছু বাক্য দ্বারা। প্রাথমিক শিক্ষায় এই জাতীয় নীতি বাক্যগুলোর সরাসরি আবেশ না থাকায় পরবর্তী মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার গতি-প্রকৃতিতে নৈতিকতায় মন্দ ভাব চলে আসে। কালক্রমে দেশের উচ্চশিক্ষাও নানা বিপত্তিতে বিঘ্নিত হয়। আবার কখনো কখনো অটো পাসের মতো আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের সংক্রামক ব্যাধিতে জড়িয়ে সদ্য পাস করা ছাত্রদের জীবনটাকে অর্থহীন করে দিয়েছে। শিক্ষার প্রায় সর্বস্তরেই পার্থিব জ্ঞানের অপূর্ণতা, কৌতূহলোদ্দীপক অস্বাভাবিক জীবন যাপনে বাধ্য করে। তাতে বাংলাদেশের উজ্জ্বল সম্ভবনাময় যুব সমাজ অশান্ত রাজনৈতিক ‘সুনামীর’ কবলে পড়ে প্রাথমিক পর্যায়ে অপরিহার্য নৈতিকতায় ঘাটতি, মাধ্যমিক স্তরে নিয়মানুবর্তিতায় বিলুপ্তি, উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে অপরাজনীতির আসক্তি, উচ্চ শিক্ষা স্তরে জন্মেছে জীবনের প্রতি বিরক্তি।এতেই জীবনে নেমেছে পথহারা পথিকের ভ্রান্তি। চরম অবস্থায় বাংলাদেশে বিগত কয়েক প্রজন্মের যুবকদের জীবন গঠনের পথে এই অনাকাঙ্ক্ষিত প্রতিবন্ধকতার জন্যে দায়ী কে? আমরা আশায় বুক বেঁধে আছি যে ‘The darkest hour is before the dawn’.

হায় নিয়তি! তোমার স্বাভাবিক সমাজ সংস্কার প্রত্যাশায় চলমান তিক্ত প্রহরগুলোর অবসান গুণছি আর গুণছি। কবে কখন আমাদের দৈনন্দিন জীবনের স্বাভাবিকত্বের মাহেন্দ্রক্ষণ সূচিত হবে। সেজন্যেই আমরা অপেক্ষমান। কায়মনো বাক্যে শুধুই প্রার্থনা May God speed in every sphere of our life with His best wishes..

লেখক : কবি ও প্রবন্ধকার; অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র শিক্ষক, বলাখাল যোগেন্দ্র নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয় ও কারিগরি কলেজ, হাজীগঞ্জ, চাঁদপুর।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়