প্রকাশ : ০৫ জুন ২০২৫, ১০:২০
ঈদুল আজহার প্রেক্ষাপট ও করণীয়

ঈদুল আজহা মানে কোরবানির ঈদ। প্রতি বছর মুসলিম বিশ্ব নবী ইব্রাহীম (আ.) এর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে পশু কোরবানি করে থাকে। কোরবানির মাধ্যমে মহান রাব্বুল আলামিনের প্রতি তাদের আনুগত্য, দাসত্ব ও আত্মসমর্পণের অনন্য নজির স্থাপন করে। সর্বকালের, সর্বযুগের, সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর সুন্নাহ মোতাবেক মুসলমানগণ বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে আল্লাহর সন্তোষ লাভের মানসে হাজার হাজার বছর ধরে কোরবানি পালন করে আসছে। আমরা আমাদের চর্ম চোখে দেখতে পাই, রক্ত ও গোশত কোনো কিছুই আল্লাহর নিকট পৌঁছায় না, বরং কেবলমাত্র বান্দার তাকওয়া পৌঁছায়। তামাম সৃষ্টিকুলের সব মানুষ আল্লাহর বান্দা বা গোলাম।
আমাদের কাছে তার একমাত্র চাওয়া হলো তার দাসত্ব মেনে নেয়া, আত্মসমর্পণ করা। আল্লাহ দেখতে চান আমরা নির্ভেজালভাবে তার দাসত্ব করি কিনা? আল্লাহ চান আমরা জীবনের সব ক্ষেত্রে কেবলমাত্র তারই আনুগত্য মেনে নেই। তারই রঙে আমাদের জীবনকে রাঙাই। গোটা জীবনের সব পর্যায়ে তার প্রভুত্বকে মেনে নেই। তারই সার্বভৌমত্বকে সদাসর্বদা তুলে ধরি। সব তাগুতকে (আল্লাহবিরোধী মত) অস্বীকার করি। কাউকে তার সমকক্ষ মনে না করি। জীবনের সব ক্ষেত্রে তারই নিকট আত্মসমর্পণ করি।
কোরবানির মূল উদ্দেশ্য আমরা পবিত্র কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াত থেকে জানতে পারি। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, হে মুহাম্মদ (সা.) আপনি বলুন, নিশ্চয় আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন, আমার মৃত্যু সবকিছুই সারা জাহানের রব আল্লাহর জন্য। (সুরা আনআম, আয়াত-১৬২) পবিত্র কুরআনের এ আয়াতটি কোরবানির উদ্দেশ্যকে সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্টভাবে তুলে ধরেছে। আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণের জন্য এর চেয়ে বড় ঘোষণা আর কিছুই হতে পারে না। যেখানে আমার নামাজ, আমার কোরবানির দ্বারা সব আনুষ্ঠানিক ইবাদত এবং আমার জীবন আমার মৃত্যুর কথা বলে, আর এমন কোনো ইবাদত বা কাজ বাকি থাকল না যা আল্লাহর জন্য নয়। সবকিছু সকল ইবাদত জীবন-মৃত্যু আল্লাহর জন্য বলে সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কুরআনে বলেছেন, ‘আল্লাহর নিকট পৌঁছায় না প্রাণীর গোশত ও রক্ত, পৌঁছায় কেবলমাত্র তোমাদের তাকওয়া।’ কুরআনে আরও বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ অবশ্যই মুত্তাকীদের কোরবানি কবুল করে থাকেন।’
পবিত্র কুরআনের উপর্যুক্ত আয়াত দুটি থেকে পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় আল্লাহ কোরবানির মাধ্যমে এমনকি আমাদের জীবন থেকে তিনি কি পেতে চান। আল্লাহ কোরবানির মাধ্যমে আসলে আমাদের কাছ থেকে পেতে চান তাঁর প্রতি নিষ্ঠাযুক্ত আনুগত্য। তার প্রতি ভালোবাসা, তারই জন্য উৎসর্গ, ত্যাগ, কোরবানি। আমরা কতখানি তার ডাকে সাড়া দিতে প্রস্তুত। আমরা যে কোরবানি করছি এর গোশত আমরা খাই। আল্লাহ এক তিল পরিমাণও গ্রহণ করেন না। এর চামড়া আমরা গরিব, মিসকিনদের দেই। এর পশম কোন কাজে লাগে না, যা চামড়ার প্রক্রিয়াজাতকরণের সময় বর্জ্য হিসেবে চলে যায়। রক্ত মাটির সঙ্গে মিশে যায় অথবা আমরা দুর্গন্ধের হাত থেকে বাঁচার জন্য পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলি। তাহলে মহান আল্লাহ কি নিলেন, অথবা কি পেলেন, আমাদের কাছ থেকে। আমাদের ক্রয় করা পশুর টাকা নিয়ে নিল তার মালিক এবং সে তার নিজের কাজে ব্যয় করল। তাহলে আল্লাহ কি পেলেন এ কোরবানি থেকে? কিছুই পেলেন না? হ্যাঁ, তিনি পেলেন কোরবানিদাতার ত্যাগী আনুগত্য ও আত্মসমর্পণ।
এ পৃথিবীর সবকিছুই আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। আর সবকিছুকে মানুষের কল্যাণার্থে সৃষ্টি করে তাদের অনুগত করে দিয়েছেন। মানুষকে এত সব নিয়ামত দান করেছেন। পক্ষান্তরে মানুষের কি কিছুই দেয়ার নেই আল্লাহকে। আমাদের সাধারণ বিবেকবোধ কী বলে?
মানুষের বিবেকের স্বাভাবিক দাবি হলো কেউ কিছু দিলে তাকেও তার ঋণ শোধ করার নিমিত্তে কিছু প্রতিদান দিতে হয়, এটাই ভদ্রতা জ্ঞান। কোরবানির ক্ষেত্রে প্রতিদান আর কিছু নয় তা হলো তাকওয়া বা খোদাভীরুতা বা আত্মসমর্পণ। শুধু কোরবানি নয়, বরং প্রতিটি ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহ তার বান্দার কাছ থেকে কেবল মাত্র দাসত্ব ও আনুগত্য পেতে চান, আর কিছুই নয়।
আমাদের মহান স্রষ্টা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নির্দেশ মোতাবেক জানমাল কোরবানি করার স্বতঃস্ফূর্ত মানসিকতা তৈরির প্রমাণ স্বরূপ মুসলমানগণ তাদের অর্থ, পাশবিকতা কোরবানি করার মাধ্যমে এ ঘোষণা দিয়ে থাকেন যে, আমরা প্রয়োজনে নিজেদের জীবনও কোরবানি করতে প্রস্তুত আছি। কোরবানির মাধ্যমে আল্লাহও জানতে চান তার বান্দাগণ তার আনুগত্যের জন্য কতখানি প্রস্তুত।
কোরবানির ইতিহাস অনুসন্ধানে জানা যায়, এ পৃথিবীতে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন প্রেরিত এবং পবিত্র কুরআনে উল্লিখিত ২৫ জন নবীর মধ্যে হজরত ইব্রাহীম (আ.) অন্যতম। বর্তমান ইরাকের অন্তর্গত প্রাচীন উর নগরের বাসিন্দা ছিলেন তিনি। তাঁর পিতার নাম ছিল আযর। তিনি একজন মূর্তিপুজক মুশরিক ছিলেন।
হজরত ইব্রাহীম (আ.)-এর দুই সন্তান ছিলেন, একজন হলেন হজরত ইসমাইল (আ.), অন্যজন হজরত ইসহাক (আ.)। হজরত ইসমাইলের বংশধারায় শ্রেষ্ঠ নবী হিসেবে হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর আগমন। আর হজরত ইসহাক (আ.) এর বংশধারায় অনেক নবীর আগমন ঘটে। অভিশপ্ত ইহুদি জাতির পূর্ব পুরুষ ছিলেন হজরত ইসহাক (আ.)।
হজরত ইব্রাহীম (আ.)-এর পিতা আযর ছিলেন একাধারে মূর্তি নির্মাতা, ব্যবসায়ী এবং পূজক। একবার শহর থেকে কোন একটি উৎসব উপলক্ষে সবাই বাইরে গেলে সুযোগমতো হজরত ইব্রাহীম (আ.) অসুস্থতার অজুহাতে শহরে থেকে বের হননি। তিনি কিশোর বয়সে কুঠার নিয়ে মন্দিরে প্রবেশ করেন এবং মূর্তিগুলো ভেঙে সবচেয়ে বড় মূর্তির হাতে কুঠারখানি রেখে দিলেন। মূর্তি ভাঙার অজুহাতে তাকে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করে হত্যার ব্যবস্থা করা হয়। আল্লাহর অসীম কৃপায় তিনি অক্ষত অবস্থায় আগুন থেকে বেঁচে যান। আল্লাহ আগুনের প্রতি নির্দেশ দিলেন ‘হে আগুন তুমি ইব্রাহীমের জন্য শীতল ও নিরাপদ হয়ে যাও’। অগ্নিকুণ্ড থেকে বের হয়ে হজরত ইব্রাহীম (আ.) নিজ মাতৃভূমিতে আর অবস্থান করা নিরাপদ মনে করেননি।
তিনি ইরাক থেকে হিজরত করে শামদেশে (সিরিয়ায়) চলে যান। ভিন দেশের মাটিতে এসে, হজরত ইব্রাহীম (আ.) মহান আল্লাহর দরবারে কায়মনোবাক্যে দোয়া করেন আল্লাহ যেন তাকে একটি সৎকর্মশীল ছেলে দান করেন। দ্বিতীয় স্ত্রী হাজেরার গর্ভে হজরত- ইসমাইল (আ.) জন্মগ্রহণ করেন। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘হে আমার প্রতিপালক আমাকে একটি সৎকর্মশীল ছেলে দান কর’।
মহান আল্লাহ তার দোয়া কবুল করেন, বৃদ্ধ বয়সে প্রাপ্ত সন্তানটি ছিল তার প্রাণাধিক প্রিয়। নিজের বংশের বাতি জ্বালানো ছাড়াও তাঁর একান্ত সহযোগী ও সাহায্যকারী হিসেবেও তিনি হজরত ইসমাইল (আ.)-কে পেতে চেয়েছেন। অনেক কারণে তার এ ছেলেটি ছিল সাত রাজার ধন, নয়নের পুতুল, পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয়। ইব্রাহীম (আ.) ছিলেন আল্লাহর অতীব প্রিয় পাত্র। যে কারণে তাকে খলিলুল্লাহ বলা হতো, মানে আল্লাহর বন্ধু। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর নির্দেশের প্রতি অকুণ্ঠ আনুগত্য, ভক্তি ও ধৈর্যের ফলস্বরূপ মহান আল্লাহ তাঁকে বৃদ্ধ বয়সে এ সুসন্তান দান করেছেন।
চূড়ান্ত পরীক্ষা গ্রহণের জন্য মহান আল্লাহ তাঁর শেষ বয়সের সম্বল, প্রাণপ্রিয় পুত্র ও তার মাতা হাজেরাকে নির্বাসনের নির্দেশ দেন। স্বপ্নযোগে তাকে নির্বাসনের যে স্থানটি দেখানো হয় তা ছিল মরুভূমিতে অবস্থিত আল্লাহর নির্দেশিত অবলুপ্ত আদি কাবা- সন্নিহিত একটি স্থান। হজরত হাজেরা ও হজরত ইসমাইল (আ.) এর বদৌলতে মরুভূমিতে একটি ঝর্ণাধারা প্রবাহিত হলো, যা আজও আল্লাহর এক বিশেষ নেয়ামত জমজম হিসেবে বিখ্যাত। ঝর্ণার উদ্ভবে জনসাধারণের সমাগম শুরু হলো এবং এটি ক্রমাগতভাবে বাড়তে লাগল। মরুভূমির এ ঝর্ণাধারা দেখে আগত লোকজন বুঝতে পারল, ঝর্ণাধারা এ শিশু ও মায়ের কল্যাণে হয়েছে। অতএব তারা এদের যথেষ্ট সম্মানের চোখে দেখতে লাগল। লোকজন তাদের যথেষ্ট সেবাযত্ন করতে লাগল।
কিছুকাল পর হজরত ইব্রাহীম (আ.) এসে তাদের সঙ্গে যোগ দিলেন। ইতোমার ইসমাইল (আ.) যথেষ্ট কর্মক্ষম হয়ে উঠলেন। একদিন হজরত ইব্রাহীম আ. স্বপ্নযোগে আল্লাহর আদেশ পেলেন, এ বিষয়ে পবিত্র কুরআনে এভাবে বলা হয়েছে।
তারপর সে (ইসমাইল) যখন পিতার সঙ্গে কাজ করার মতো বয়সে উপনীত হলেন তখন ইব্রাহীম (আ.) বললেন, হে বৎস! আমি স্বপ্নে দেখি যে, তোমাকে আমি জবেহ করছি। এখন তোমার অভিমত কি বল? সে বলল, হে আমার পিতা! আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন তা করুন। আল্লাহর ইচ্ছায় আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন। এভাবে পিতাপুত্র উভয়ে আল্লাহর আনুগত্য প্রকাশ করল। ইব্রাহীম তার পুত্রকে কোরবানি করার প্রস্তুতি নিলেন। তখন আমি তাকে আহ্বান করে বললাম, হে ইব্রাহীম! তুমি তো স্বপ্নাদেশ পালন করলে। এভাবে আমি তাকে মুক্ত করলাম এক মহান কোরবানির বিনিময়ে। আমি ইহা পরবর্তীদের স্মরণে রেখেছি। ইব্রাহীমের ওপর শান্তি বর্ষিত হউক। এভাবে আমি সৎকর্ম পরায়ণদের পুরস্কার দিয়ে থাকি। (সুরা সাফ্ফাত, আয়াত: ১০২)
বস্তুত হজরত ইব্রাহীম (আ.) এর সর্বাধিক প্রিয় পুত্র কোরবানি দানের এ ঘটনাকে অবিস্মরণীয় করে রাখার জন্য উম্মাতে মুহাম্মদীর ওপর তা ওয়াজিব করা হয়। এ বিষয়ে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘সুতরাং আপনি আপনার প্রতিপালকের উদ্দেশে সালাত আদায় করুন এবং কোরবানি করুন। কুরআনের আয়াত মোতাবেক কোরবানি করা আমাদের ওপর ওয়াজিব বা অবশ্য করণীয়। রাসুল (সা.) থেকে আজ পর্যন্ত স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুসলিম বিশ্ব কোরবানি করে আসছে। ত্যাগের মহিমায় ঈদুল আজহা চিরকাল ভাস্বর হয়ে থাকুক মুমিন হৃদয়ে। সূত্র : জনকণ্ঠ।