প্রকাশ : ২৬ আগস্ট ২০২৫, ০৮:৩০
রকেট স্টীমার : শত বছরের ঐতিহ্য হারানোর পথে

বাংলাদেশের নৌ-ঐতিহ্যের অন্যতম গর্ব রকেট স্টীমার সার্ভিস। রকেট স্টীমার, যা মূলত প্যাডেল স্টীমার নামে পরিচিত। এটি বাংলাদেশের একটি ঐতিহাসিক জলযান, যার যাত্রা শুরু হয়েছিলো ব্রিটিশ আমলে এবং এটি প্রায় এক শতাব্দীর বেশি সময় ধরে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আঠার শতকের শেষে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের হাত ধরে এ অঞ্চলে স্টীমার বা জাহাজ চলাচল শুরু হয়। শুরুতে এ অঞ্চলে চালু হয়েছিলো প্যাডেল চালিত স্টীমার। এসব জাহাজে জ্বালানি হিসেবে কয়লা ব্যবহার করা হতো। কয়লা থেকে উৎপন্ন হওয়া স্টিম বা বাষ্পে চলতো বলে নাম হয় স্টীমার। প্যাডেল স্টীমারে নৌযানের দুই পাশে বড়ো বড়ো চাকা বা প্যাডেল থাকতো বলে এর নাম প্যাডেল স্টীমার। এই প্যাডেলের কারণেই এটি দ্রুতগতিসম্পন্ন নৌযান ছিলো। যে সময় এসব জাহাজ নদীতে নেমেছিলো, সে সময় অন্য নৌযানের চাইতে এগুলো অনেক বেশি দ্রুত গতিতে চলতো। যার কারণে লোকের মুখে মুখে এর নাম হয়ে যায় রকেট। পরবর্তীতে আনুষ্ঠানিকভাবেই একে সবাই রকেট স্টীমার বলে ডাকতে শুরু করে। কালের পরিক্রমায় পরবর্তীতে স্টিমারের নকশায় পরিবর্তন করে চাকা পেছনে নিয়ে যাওয়া হয়। শুরুর দিকে মেসার্স কিড অ্যান্ড কোম্পানি নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ১৮২৩ সালে প্রথম যাত্রীবাহী স্টীমার ‘ডায়না’ দিয়ে হুগলী নদীতে পরিবহন ব্যবস্থা চালু করে। এরপর ইন্ডিয়ান জেনারেল স্টিম নেভিগেশন কোম্পানি গঙ্গায় একটি স্টীমার সার্ভিস চালু করেছিলো। তবে ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে অচিরেই সেটি বন্ধ হয়ে যায়। পরে তারা ব্রহ্মপুত্র নদে ভিন্ন একটি সার্ভিস চালু করে। কিন্তু উত্তর আসামের চা ধীরে ধীরে বিদেশের বাজারে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে থাকলে, তৎকালীন সরকার ১৮৪৭ সালে কলকাতা ও গৌহাটির মধ্যে একটি নতুন রুটে বা পথে স্টীমার সার্ভিস চালু করে বলে উল্লেখ করেছে। এরপর ১৮৬২ সালে স্টীমারে করে কলকাতা থেকে মূলত এখনকার বাংলাদেশ অংশে যাত্রী এবং পণ্য পরিবহনের কাজ শুরু হয়।
|আরো খবর
১৯৩৮ সালে স্কটল্যান্ডে তৈরি ‘লেপচা’ এবং ১৯২১ সালে তৈরি একটি স্টীমার এর উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। যা তৎকালীন বিলাসবহুল যাতায়াতের প্রতীক ছিলো। রকেট স্টীমার শুধু পরিবহনই নয়, এটি বাংলাদেশের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও গর্বের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়। একসময় পদ্মা, মেঘনা, যমুনা আর বৃহত্তর নদ-নদীর বুক চিরে চলতো এই মহার্ঘ নৌযান। ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু হওয়া এই স্টীমার সার্ভিস শুধু পরিবহনের মাধ্যমই ছিলো না বরং এক অনন্য ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বাহক ছিলো। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য, প্রায় কয়েক বছর ধরে এই সার্ভিস বন্ধ হয়ে আছে। ফলে ‘রকেট স্টীমার’ নামটি এখন স্মৃতির পাতায় ধুলো জমাচ্ছে।
১৯২৯ সালে ব্রিটিশ সরকার ইস্টার্ন বেঙ্গল স্টিম নেভিগেশন কোম্পানি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রকেট স্টীমার চালু করে। সে সময় ঢাকাকে কলকাতার সঙ্গে নৌপথে যুক্ত করার অন্যতম প্রধান বাহন ছিলো এগুলো। কেবল যাত্রী নয়, ডাকপত্র, মূল্যবান পণ্য ও কৃষিপণ্য পরিবহনেও এই স্টীমারগুলো ব্যাপক ভূমিকা রাখতো। প্রযুক্তিগত দিক থেকে এগুলোকে বলা হতো ‘রকেট’, কারণ তৎকালীন অন্যান্য নৌযানের তুলনায় এগুলোর গতি ছিলো অনেক দ্রুত।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর রকেট স্টীমার সার্ভিস পরিচালনার দায়িত্ব নেয় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি)। শুরুতে নিয়মিত চলাচল করলেও পরবর্তীতে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, নিয়মিত সংস্কার, পর্যাপ্ত জনবল ও আধুনিকায়নের অভাবে সার্ভিসটি ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে। যাত্রী সংখ্যা কমতে থাকে, আয়ের ঘাটতি দেখা দেয়। অনেক সময় মেরামতের অভাবে স্টীমারগুলো মাসের পর মাস নদীর ঘাটে অকেজো অবস্থায় পড়ে থাকতো।
আজকের দিনে রকেট স্টীমারের সংখ্যা হাতে গোণা কয়েকটিতে সীমিত হয়ে এসেছে। যেগুলো রয়েছে, সেগুলোও দীর্ঘদিন ধরে অচল অবস্থায় আছে। ঢাকা-চাঁদপুর-বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ রুটে আগে যেভাবে স্টিমার চলতো এখন আর তা দেখা যায় না। কয়েক বছর ধরে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ঐতিহাসিক এই বাহনটি হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
তবে সম্প্রতি জানা গেছে, রকেট স্টীমারের এই ঐতিহ্যকে বাঁচাতে নতুন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। বিআইডব্লিউটিসি জানিয়েছে, পুরনো স্টীমারগুলোকে সংস্কার করে আবারও নৌপথে চালু করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি কিছু নতুন আধুনিক স্টীমার সংযোজনের কথাও ভাবা হচ্ছে। এ লক্ষ্যে ইতোমধ্যে বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে এবং নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করছে।
একজন নৌপরিবহন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, রকেট স্টীমার শুধু একটি যানবাহন নয়, এটি আমাদের ইতিহাস ও সংস্কৃতির অংশ। এজন্যে আমরা চাই পুনরায় এটি চালু করতে। তবে এজন্যে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা প্রয়োজন।
রকেট স্টীমার শুধু যাত্রী পরিবহনেই নয়, পর্যটন খাতেও নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে। ইউরোপ ও আমেরিকার অনেক দেশেই ঐতিহ্যবাহী স্টীমার এখনো পর্যটকদের জন্যে আকর্ষণ হিসেবে চালু আছে। বাংলাদেশেও রকেট স্টীমারকে পর্যটন প্যাকেজে অন্তর্ভুক্ত করা গেলে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের জন্যে এটি একটি বিশেষ অভিজ্ঞতা হয়ে উঠতে পারে।
১৯২৯ সালে ব্রিটিশ আমলে রকেট স্টীমার চালু হয়। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর স্টীমারের রুট সংখ্যা কমে আসে। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিআইডব্লিউটিসি এটির দায়িত্ব নেয়। ১৯৮৫ সালে যাত্রী সংখ্যা ক্রমাগত কমতে থাকে, যার কারণে রক্ষণাবেক্ষণে অবহেলায় পড়ে এটি। ২০০০ সালে পুনরায় অর্থ সংকটের কারণে সার্ভিস সীমিত হয়ে পড়ে। ২০১০ সালে হাতে গোণা কয়েকটি স্টীমারই চালু থাকে। তার মধ্যে লেপচা, গাজী, পিএইচ টার্ন ইত্যাদি। ২০১৮ সালে রকেট স্টিমার কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। সর্বশেষ তিনটি প্যাডেল স্টীমারের বহর নিয়ে শতবর্ষেরও বেশি পুরনো এসব নৌযানের সেবা ২০২২ সালে সাময়িকভাবে বন্ধ হয়। তারপর আর স্টীমারগুলো একেবারেই চালু করেনি কর্তৃপক্ষ। যদিও ২০২৩ সালের এক ঈদে চালু করা হয়েছিল কয়েকদিনের জন্যে, তবে তা স্থায়ী হয়নি। ২০২৫ সালে এসে সংস্কার ও পুনরায় চালুর পরিকল্পনা ঘোষণা রয়েছে।
চাঁদপুরের এক প্রবীণ নাগরিক ইসমাইল হোসেন বলেন, শৈশবে আমরা পরিবার নিয়ে রকেট স্টীমারে ভ্রমণ করতাম। সেই যাত্রার স্মৃতি আজও জীবন্ত। আবার যদি চালু হয়, তবে তরুণ প্রজন্মও আমাদের মতো সেই ঐতিহ্যের স্বাদ নিতে পারবে।
যদিও সংস্কার ও নতুনভাবে চালুর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, তবে বাস্তবায়নে একাধিক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। নদীপথে নাব্য সংকট, আধুনিক নৌযানের প্রতিযোগিতা, যাত্রী চাহিদার পরিবর্তন, আর্থিক ঘাটতি সবই বড়ো বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কেবল সংস্কার করলেই হবে না, আধুনিক প্রযুক্তি যুক্ত করে এটিকে যুগোপযোগী করতে হবে। সেইসঙ্গে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে।
চাঁদপুর, বরিশাল, খুলনা, ঢাকা সবখানেই স্থানীয় জনগণ দাবি তুলেছেন রকেট স্টীমারকে বাঁচানোর। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে বলছেন, এটি বন্ধ হয়ে গেলে শুধু একটি পরিবহনই নয়, বরং একটি যুগের স্মৃতিও চিরতরে হারিয়ে যাবে।
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। নদী আর নৌযানের সঙ্গে এই দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও সভ্যতা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। রকেট স্টীমার সেই ইতিহাসের গর্বিত বাহক। তাই উন্নয়ন পরিকল্পনায় কেবল অর্থনৈতিক যুক্তি নয়, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির দিকটিও গুরুত্ব দিতে হবে। যদি যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া যায়, তবে রকেট স্টীমার আবারও নদীপথে ভেসে চলতে পারবে, আর ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানতে পারবে, কীভাবে তাদের পূর্বপুরুষেরা নদীপথে ভ্রমণ করতেন।
চাঁদপুর হরিণা ফেরিঘাটের কর্মকর্তা ফয়সাল আহমেদ জানান, আমরা কয়েকবার স্টীমার চালুর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কিন্তু যাত্রী স্বল্পতার কারণে এটি চালানো যাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে সরকারের সদিচ্ছার অভাব নেই। তবে আধুনিক যন্ত্রপাতি ও সুযোগ সুবিধা নিয়ে চালু করা হলে এটি পুনরায় সেবা দিতে সক্ষম।
বাংলাদেশের জন্যে এটি শুধু একটি নৌযান পুনরায় চালু করা নয়, বরং একটি ঐতিহ্যকে নতুনভাবে জাগিয়ে তোলার প্রয়াস। এখন দেখার বিষয়, কর্তৃপক্ষ কথার বাইরে কতোটা কাজে পরিণত করতে পারে।