প্রকাশ : ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০:৪৯
প্রবীণ জীবনে মেডিটেশনের শক্তি

২১ ডিসেম্বর বিশ্ব মেডিটেশন দিবস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় “ঐবধষরহম ঃযব ড়িৎষফ ভৎড়স রিঃযরহ”, অর্থাৎ নিজের ভেতরের শান্তি দিয়েই বিশ্বকে সুস্থ করা সম্ভব। এই প্রতিপাদ্যটি বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক প্রবীণদের জন্যে। জীবনের দীর্ঘ পথে চলতে গিয়ে প্রবীণরা যে মানসিক চাপ, দুঃশ্চিন্তা ও একাকীত্বের মুখোমুখি হন, তার নীরব প্রতিষেধক হতে পারে ধ্যান বা মেডিটেশন।
প্রবীণ বয়স মানেই শুধু শরীরের জরা নয়, মনেও জমে ওঠে নানা প্রশ্ন, অনিশ্চয়তা ও স্মৃতির ভার। অবসরজীবন, আয় কমে যাওয়া, শারীরিক অসুস্থতা, সন্তানদের ব্যস্ততা, একাকীত্ব সব মিলিয়ে প্রবীণদের মানসিক চাপ তুলনামূলকভাবে বেশি হয়। অনেকেই রাতে ঘুমোতে পারেন না, অতীতের ভুল বা হারানোর বেদনা মনে পড়ে যায়, আবার ভবিষ্যৎ নিয়ে ভয় কাজ করে। এই মানসিক অস্থিরতা ধীরে ধীরে শারীরিক সমস্যাকেও বাড়িয়ে তোলে। ঠিক এখানেই মেডিটেশন হয়ে উঠে এক নীরব সহযাত্রী।
মেডিটেশন কোনো কঠিন সাধনা নয়, এটি নিজের সাথে কিছু সময় কাটানোর সহজ উপায়। শ্বাস-প্রশ্বাসে মনোযোগ দেওয়া, চোখ বন্ধ করে শান্তভাবে বসা, অথবা কোনো ইতিবাচক শব্দ বা অনুভূতিকে মনে ধারণ করাএই সামান্য চর্চাই প্রবীণ জীবনে বড়ো পরিবর্তন আনতে পারে। নিয়মিত ধ্যান মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে, কারণ এটি মনকে বর্তমান মুহূর্তে স্থির রাখে। অতীতের আফসোস বা ভবিষ্যতের ভয় ধীরে ধীরে তার তীব্রতা হারায়।
প্রবীণদের ক্ষেত্রে মেডিটেশনের প্রথম ও বড় উপকার হলো মানসিক প্রশান্তি। ধ্যান মস্তিষ্কে এমন রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটায় যা উদ্বেগ ও হতাশা কমাতে সহায়ক। এতে মন শান্ত হয়, রাগ ও বিরক্তি কমে, সহনশীলতা বাড়ে। অনেক প্রবীণ বলেন, নিয়মিত ধ্যান করলে তারা ছোটখাটো বিষয় নিয়ে আর অতোটা বিচলিত হন না। জীবনের প্রতি এক ধরনের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়Ñযা আছে, যেমন আছে, সেটাকেই শান্তভাবে মেনে নেওয়ার শক্তি আসে।
দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ঘুমের উন্নতি। প্রবীণ বয়সে অনিদ্রা একটি সাধারণ সমস্যা। মেডিটেশন স্নায়ুতন্ত্রকে শান্ত করে, হৃদস্পন্দন স্বাভাবিক করে এবং গভীর শ্বাসের মাধ্যমে শরীরকে বিশ্রামের সংকেত দেয়। ফলে ঘুম আসতে সহজ হয় এবং ঘুমের গুণগত মানও বাড়ে। ভালো ঘুম মানেই পরদিনের মন ও শরীর দুটোই তুলনামূলকভাবে চাঙ্গা।
তৃতীয়ত, মেডিটেশন শারীরিক স্বাস্থ্যের সাথেও গভীরভাবে যুক্ত। মানসিক চাপ কমলে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগের ঝুঁকি কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে থাকে। ধ্যানের সময় সচেতন শ্বাস-প্রশ্বাস শরীরের অক্সিজেন সরবরাহ বাড়ায়, যা প্রবীণদের জন্যে বিশেষভাবে উপকারী। অনেক ক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা বা অস্বস্তির অনুভূতিও ধ্যানের মাধ্যমে সহনীয় হয়ে উঠে, কারণ মন ব্যথার প্রতি অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখানো কমিয়ে দেয়।
আরও একটি বড় সহায়তা হলো একাকীত্ব মোকাবিলা। ধ্যান মানুষকে নিজের ভেতরের সাথে বন্ধুত্ব করতে শেখায়। যখন বাইরের সম্পর্কগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন নিজের মনই হয়ে উঠতে পারে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সঙ্গী। মেডিটেশন প্রবীণদের আত্মসম্মান ও আত্মমূল্যবোধ বাড়ায়Ñ“আমি এখনও গুরুত্বপূর্ণ, আমি এখনও পূর্ণ” এই অনুভূতিটি জাগিয়ে তোলে।
সবচেয়ে সুন্দর দিক হলো, একজন প্রবীণ যখন নিজের ভেতরে শান্তি খুঁজে পান, তখন সেই শান্তির প্রভাব পরিবার ও সমাজেও ছড়িয়ে পড়ে। শান্ত মন নিয়ে কথা বললে সম্পর্কের টানাপোড়েন কমে, পারিবারিক পরিবেশ হয় সহনশীল ও মানবিক। এভাবেই “নিজের ভেতরের শান্তি দিয়ে বিশ্বকে সুস্থ করা” এই প্রতিপাদ্য বাস্তব রূপ পায়।
বিশ্ব মেডিটেশন দিবসে তাই প্রবীণদের জন্যে আমাদের বার্তা হোক সহজ ও মানবিক মেডিটেশন কোনো বয়সের বাধা মানে না। দিনে মাত্র কয়েক মিনিট নীরবে বসে নিজের শ্বাসের সাথে বন্ধুত্ব করলেই শুরু হতে পারে সুস্থ, শান্ত ও মর্যাদাপূর্ণ প্রবীণ জীবনের নতুন অধ্যায়।








