বুধবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০২৫
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০:৪৯

নির্বাচনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রভাব

ড. এম মেসবাহউদ্দিন সরকার
নির্বাচনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রভাব

একবিংশ শতাব্দীতে নির্বাচন আর কেবল ব্যালট বাক্স, পোস্টার কিংবা মিছিলের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। ডিজিটাল প্রযুক্তি, বিশেষ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), নির্বাচনী ব্যবস্থাকে আমূল পরিবর্তনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ভোটার তালিকা হালনাগাদ থেকে শুরু করে নির্বাচনী প্রচারণা, জনমত বিশ্লেষণ, নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং ফল ব্যবস্থাপনা সব ক্ষেত্রেই এআই তার উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। এআই ব্যবহার করে জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্মনিবন্ধন ও অন্যান্য ডাটাবেইস বিশ্লেষণ করে ভুয়া বা মৃত ভোটার শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে।

ফলে ভোটার তালিকার নির্ভুলতা বাড়ছে। নির্বাচনের দিন ভোটকেন্দ্র ব্যবস্থাপনায়ও এআই কার্যকর ভূমিকা রাখছে। মুখ শনাক্তকরণ প্রযুক্তি ব্যবহার করে একজন ভোটার একাধিকবার ভোট দিচ্ছে কিনা তা শনাক্ত করা সহজ হচ্ছে। এছাড়া ভোটকেন্দ্রে ভিড় নিয়ন্ত্রণ, লাইনের সময় নির্ধারণ এবং নিরাপত্তা ঝুঁকি পূর্বাভাসে এআই সহায়তা করতে পারে। ফল গণনার ক্ষেত্রেও এআই দ্রুত ও নির্ভুল ফল প্রকাশে সাহায্য করে, যা নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতা কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অনেক দেশে ইতোমধ্যে এআই-ভিত্তিক অ্যানালিটিক্স ব্যবহার করে নির্বাচনী অনিয়ম বা অস্বাভাবিক ভোটের প্রবণতা চিহ্নিত করছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, সার্চ ইঞ্জিন ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মে এআই অ্যালগরিদম ভোটারদের আচরণ বিশ্লেষণ করে নির্দিষ্ট বার্তা পেঁৗছে দিতে সক্ষম। কোন অঞ্চলের ভোটার কী চায়, কোন বয়স বা পেশার মানুষ কোন ইস্যুতে সংবেদনশীল এসব তথ্য বিশ্লেষণ করে রাজনৈতিক দলগুলো লক্ষ্যভিত্তিক প্রচারণা চালাতে পারছে। চ্যাটবট, স্বয়ংক্রিয় কল, ব্যক্তিকৃত বিজ্ঞাপন এবং কনটেন্ট জেনারেশনে এআই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ফলে প্রচারণা যেমন কম খরচে ও দ্রুত পেঁৗছানো সম্ভব হচ্ছে, তেমনি ভোটারদের ওপর মানসিক প্রভাব বিস্তারের ঝুঁকিও বাড়ছে। তাই বলা যায়, সঠিকভাবে ব্যবহৃত হলে এআই নির্বাচনকে আরও সুশৃঙ্খল, স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারে।

ডিপফেক ভিডিও, ভুয়া অডিও ক্লিপ বা মিথ্যা সংবাদ তৈরি করে প্রতিপক্ষকে হেয় করার প্রবণতাও ক্রমেই বাড়ছে। এতে ভোটার বিভ্রান্ত হচ্ছে এবং সত্য-মিথ্যার পার্থক্য করা কঠিন হয়ে পড়ছে। তাই এআই যেমন প্রচারণাকে আধুনিক ও কার্যকর করেছে, তেমনি এটি গণতান্ত্রিক নৈতিকতার জন্য নতুন চ্যালেঞ্জও সৃষ্টি করেছে। আসন্ন নির্বাচনগুলোতে এআই-এর সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো ভুয়া তথ্য ও সাইবার হুমকি। এআই ব্যবহার করে অতি বাস্তবসম্মত ভুয়া ছবি, ভিডিও ও সংবাদ তৈরি করা সম্ভব, যা সাধারণ ভোটার সহজেই বিশ্বাস করে বসেন। এসব ভুয়া তথ্য নির্বাচনী পরিবেশকে বিষাক্ত করে তুলতে পারে।

বিদেশি হস্তক্ষেপ, বট অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে জনমত প্রভাবিত করা এবং অনলাইন ট্রল পরিচালনায় এআই গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। একই সঙ্গে ভোটার ডাটাবেইস বা ফল ব্যবস্থার ওপর সাইবার আক্রমণের আশঙ্কাও বাড়ছে। যদিও এআই এসব আক্রমণ শনাক্ত ও প্রতিরোধেও সক্ষম। কিন্তু প্রযুক্তিগত সক্ষমতার ভারসাম্য না থাকলে ঝুঁকি বেড়ে যায়। উন্নত দেশ ও উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে প্রযুক্তিগত বৈষম্য থাকায় অনেক রাষ্ট্রই এআই-নির্ভর হুমকির মুখে পড়ছে।

তাই এআই কি গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করবে, নাকি দুর্বল করবে- এ প্রশ্নটি আজকের প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এর উত্তর নির্ভর করছে আমরা কীভাবে এ প্রযুক্তি ব্যবহার করি তার ওপর। দায়িত্বশীল, নৈতিক ও মানবকেন্দ্রিক এআই ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে নির্বাচন হবে আরও স্বচ্ছ, অংশগ্রহণমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য। এজন্য নির্বাচন কমিশন, সরকার, রাজনৈতিক দল, প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান এবং নাগরিক সমাজ সবার সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন। এআই ব্যবহারে স্বচ্ছতা, ডেটা সুরক্ষা, গোপনীয়তা রক্ষা এবং ভুয়া তথ্য দমনে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। একই সঙ্গে ভোটারদের ডিজিটাল সচেতনতা বাড়ানো জরুরি, যাতে তারা ভুয়া তথ্য শনাক্ত করতে পারে।

অনেকেই মনে করছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ভবিষ্যতে নির্বাচনের ফল পাল্টে দিতে পারে। এ ধারণার পেছনে কিছু বাস্তব কারণ আছে। বর্তমান যুগে এআই বিশাল পরিমাণ তথ্য বিশ্লেষণ করতে সক্ষম। ভোটারদের আচরণ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রবণতা, অর্থনৈতিক অবস্থা ও রাজনৈতিক মতাদর্শ বিশ্লেষণ করে এআই নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে বার্তা তৈরি করতে পারে। ফলে ভোটারদের মতামত প্রভাবিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভুয়া খবর, ডিপফেক ভিডিও এবং বিভ্রান্তিকর কনটেন্ট ছড়াতে এআই ব্যবহৃত হলে সাধারণ মানুষ সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য বুঝতে ব্যর্থ হতে পারে।

এতে গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া দুর্বল হয়ে পড়ে। অনেক সময় এআই-চালিত বট বা স্বয়ংক্রিয় অ্যাকাউন্ট একটি নির্দিষ্ট দলের পক্ষে জনমত তৈরি করতে সক্রিয় ভূমিকা রাখে, যা নির্বাচনের ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে। তবে এআই সব সময় নেতিবাচক নয়। সঠিক নিয়ন্ত্রণ ও নৈতিক ব্যবহারের মাধ্যমে এটি নির্বাচনকে আরও স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু করতেও সাহায্য করতে পারে, যেমন ভোট জালিয়াতি শনাক্তকরণ, ভোটার তালিকা হালনাগাদ বা দ্রুত ফল বিশ্লেষণ। তাই বলা যায়, এআই নিজে থেকে নির্বাচনের ফল পাল্টায় না, বরং মানুষ যেভাবে এটি ব্যবহার করে, তার ওপরই নির্বাচনের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে।

গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হলো জনগণের অংশগ্রহণ, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও স্বচ্ছতা। এআই এই ভিত্তিগুলোকে একদিকে যেমন শক্তিশালী করতে পারে, অন্যদিকে ভুল ব্যবহারে তা দুর্বলও করে তুলতে পারে। যেমনÑ প্রথমত, এআই গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার বড় একটি উপায় হলো তথ্যপ্রাপ্তি ও নাগরিক অংশগ্রহণ বৃদ্ধি। এআইভিত্তিক ডেটা বিশ্লেষণ সরকারের নীতিনির্ধারণে জনগণের চাহিদা, সমস্যা ও মতামত দ্রুত বুঝতে সহায়তা করে।

ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে এআইচালিত চ্যাটবট ও স্বয়ংক্রিয় সেবা নাগরিকদের অভিযোগ, পরামর্শ ও প্রশ্ন সহজে পেঁৗছে দিতে সাহায্য করছে। এতে শাসনব্যবস্থা আরও জনমুখী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক হতে পারে। পাশাপাশি, নির্বাচন ব্যবস্থাপনায় এআই ব্যবহার ভোটার তালিকা হালনাগাদ, ফল বিশ্লেষণ ও অনিয়ম শনাক্তে সহায়তা করে স্বচ্ছতা বাড়াতে পারে। দ্বিতীয়ত, গণতন্ত্র দুর্বল হওয়ার আশঙ্কাও কম নয়। এআই ব্যবহারের মাধ্যমে ভুয়া খবর, ডিপফেক ভিডিও ও লক্ষ্যভিত্তিক প্রোপাগান্ডা দ্রুত ছড়ানো সম্ভব। এতে জনগণের মতামত বিভ্রান্ত হতে পারে এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়া প্রভাবিত হতে পারে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এআই অ্যালগরিদম প্রায়ই এমন কনটেন্ট সামনে আনে যা মানুষের আবেগ উসকে দেয়।

ফলে সমাজে মেরুকরণ বাড়ে। এই পরিস্থিতিতে যুক্তিনির্ভর গণতান্ত্রিক আলোচনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তৃতীয়ত, নজরদারি ও গোপনীয়তার প্রশ্নও গণতন্ত্রের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এআইভিত্তিক নজরদারি প্রযুক্তি নাগরিকদের আচরণ, মতামত ও চলাচল পর্যবেক্ষণে ব্যবহৃত হতে পারে। যদি রাষ্ট্র বা ক্ষমতাশালী গোষ্ঠী এটি অপব্যবহার করে, তবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত হতে পারে। ভয়ের পরিবেশে মানুষ স্বাধীনভাবে মত প্রকাশে অনীহা বোধ করে, যা গণতন্ত্রের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।

তাই বলা যায়, এআই একদিকে যেমন এটি নির্বাচনকে আরও দক্ষ, স্বচ্ছ ও দ্রুততর করতে পারে, অন্যদিকে ভুল বা অপব্যবহারের মাধ্যমে গণতন্ত্রের জন্য বড় হুমকিও সৃষ্টি করতে পারে। অর্থাৎ এর প্রভাব নির্ভর করে ব্যবহারকারীর নৈতিকতা, আইন ও নীতিমালার ওপর।

গণতন্ত্র রক্ষায় একটি সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা করা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এতে থাকে অনেক সীমাবদ্ধতা এবং চ্যালেঞ্জ। আর এই চ্যালেঞ্জের মধ্যে নতুনভাবে সংযুক্ত হয়েছে তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ সুযোগ এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) কারসাজি। যদিও এর অপব্যবহার রোধে আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নজরদারির ব্যবস্থা নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তবুও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ ও সাইবার সিকিউরিটি বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি টিম সার্বক্ষণিক নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা দিতে পারে।

মনে রাখতে হবে, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের নির্বাচন শুধু রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা নয়, প্রযুক্তিগত নৈতিকতারও পরীক্ষা। তাই নির্বাচনে এআই ব্যবহারের ক্ষেত্রে শক্তিশালী আইন, স্বচ্ছ নীতিমালা, প্রযুক্তিগত সক্ষমতা, সঠিক নিয়ন্ত্রণ, স্বচ্ছতা, মূল্যবোধের সমন্বয় এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করা গেলে গণতন্ত্র আরও শক্তিশালী হবে।

লেখক : অধ্যাপক এবং তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়