বুধবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০২৫
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০:৪৫

সম্প্রীতি ও দেশপ্রেমের প্রতীক খালেদা জিয়া

শায়রুল কবির খান
সম্প্রীতি ও দেশপ্রেমের প্রতীক খালেদা জিয়া

সম্প্রীতি এমনই এক সূক্ষ্ম অথচ অনিবার্য উপাদান, যা চোখে দেখা না গেলেও মনশ্চক্ষু বা অন্তরাবলোকন দিয়ে গভীরভাবে অনুভব করা যায়। এটি কেবল শান্ত বা নীরব থাকার নাম নয়; এটি আসলে পরিচ্ছন্ন চিন্তাধারা, উভয়ের প্রতি নীতি ও আদর্শগত সাম্য এবং সর্বোপরি এক গভীর মানবিক বিবেচনাবোধের সম্মিলিত ফল। প্রতিটি মানুষের মধ্যে যখন সহযোগিতা, আস্থা ও বিশ্বাসের হাত প্রসারিত হয় এবং সেই হাতগুলো অটুটভাবে আবদ্ধ হয়, তখনই একটি সমাজ বা রাষ্ট্রে সত্যিকারের সম্প্রীতির আবহ গড়ে ওঠে। এই আবহ জাগতিক নিয়মে এককভাবে তৈরি হয় না– এটি নিজের পরিবার থেকে শুরু হয়ে গ্রাম, সমাজ, জেলা, বিভাগ পেরিয়ে অবশেষে গোটা বিশ্বদরবারে জাতির পরিচয় বহন করে।

আগামীর বাংলাদেশ কেমন হবে– সেই প্রত্যাশা যখন নাগরিকদের মনে দানা বঁাধে, তখন সামাজিক শৃঙ্খলার মধ্যে ঐক্য, প্রীতি ও মৈত্রীর বন্ধনে নিজেদের মধ্যে পূর্ণ সম্প্রীতি গড়ে তোলাটাই মূল লক্ষ্য হয়ে দঁাড়ায়। কিন্তু সেই পথেই আজ এক গভীর প্রশ্নচিহ্ন। ঠিক এমন এক পটভূমিতে দঁাড়িয়ে আজ দেশের প্রধান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের অন্যতমÑবিএনপি চেয়ারপারসন দেশনেত্রী খালেদা জিয়া শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।

আগের কয়েকদিন রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে তঁার দিনযাপন যেন দেশের রাজনৈতিক সম্প্রীতি ও বিভাজনের এক অপেক্ষার প্রতিচ্ছবি হয়ে রইল। তিনি কত বড় ব্যক্তি, তা এই চরম অসুস্থতার মধ্যে দেশ-বিদেশে ব্যাপকভাবে প্রকাশিত হয়েছে। বাস্তবভিত্তিক উপাধিটা হয়তো হতে পারে ‘দেশমাতৃকা’। এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে তিনি সর্বোচ্চ দেশপ্রেম, সততা, ঐক্য আর রাজনৈতিক সম্প্রীতির এক মূর্ত প্রতীক।

খালেদা জিয়ার জীবন শুরু হয়েছিল এক কঠিন সংগ্রাম ও ত্যাগের মধ্য দিয়ে। স্বল্প বয়সে বিয়ে হওয়ার স্বল্প সময়ের মধ্যেই আসে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট। স্বামী তখনকার মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যখন যুদ্ধে ঝঁাপিয়ে পড়লেন, তখন তিনি তঁার দুই শিশু পুত্রসহ চরম অনিশ্চয়তা ও মৃত্যুর মুখে দিনযাপন করেন। সেই শুরু তঁার কঠিন সংগ্রাম। এরপর সামরিক পটপরিবর্তনÑ১৯৭৫ সালের আগস্ট ও ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার বিপ্লব ও সংহতির প্রেক্ষাপটে আসে আরও শ্বাসরুদ্ধকর জীবন। ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে একদল বিপথগামী সেনা সদস্যদের হাতে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে জাতিসত্তা প্রতিষ্ঠাতা, বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রবর্তক ও আধুনিক স্বনির্ভর বাংলাদেশের রূপকার রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান শহীদ হলে খালেদা জিয়া অসময়ে স্বামীহারা হন।

স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি কেবল ব্যক্তিগত শোক বহন করেননি, বরং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও জাতিসত্তার আদর্শ রক্ষায় রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণের গুরুভার কঁাধে তুলে নেন। স্বৈরশাসক জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ৯ বছরের সংগ্রামে তঁার নেতৃত্ব ছিল ঐক্য ও গণঅভ্যুত্থানের প্রতীক। ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানে এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে জাতীয় সংসদের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সরকার গঠন করে।

প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে তিনি বাংলাদেশে নারী শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন। তঁার সরকার অর্থনীতিতে অভূতপূর্ব সাফল্য নিয়ে আসে, যা আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সেই সময়ের অর্জন আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও স্বীকৃতি পায়। যেমনÑযুক্তরাষ্ট্রের টাইমস ম্যাগাজিনের কভার প্রতিবেদন তঁাকে ‘বাংলাদেশ ইমার্জিং টাইগার’ শিরোনামে তুলে ধরে, যা ছিল দেশের অর্থনৈতিক উত্থানের এক শক্তিশালী প্রমাণ। কিন্তু এই সাফল্য কিছু দেশি-বিদেশি কুচক্রী মহলের ঈর্ষার কারণ হয়ে দঁাড়ায়। শুরু হয় সরকারবিরোধী আন্দোলন, যেখানে আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামীকে সঙ্গে নিয়ে এক রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করা হয়। এমনকি ‘জনতার মঞ্চ’ নামে সিভিল প্রশাসনের কর্মকর্তাদের একাংশের উপস্থিতি এবং সংসদ থেকে বিরোধী দলের পদত্যাগ দেশের গণতান্ত্রিক ধারাকে সংকটের মুখে ফেলে দেয়। এই পরিস্থিতিতে, জাতির বৃহত্তর স্বার্থে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা ও সংবিধান সংশোধনীর প্রয়োজনে ১৯৯৬ সালে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ মতামতের ভিত্তিতে সংবিধান সংশোধনী গৃহীত হয় এবং নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি ফিরে আসে, যা ছিল রাজনৈতিক সম্প্রীতির এক ঐতিহাসিক অর্জন।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই ঐতিহাসিক অর্জন ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ২০১১ সালে সংবিধান থেকে বাদ দিয়ে দেয়। সেদিন থেকেই যেন বাংলাদেশ নব্য বাকশালী শাসনে ধাবিত হতে থাকে এবং রাজনৈতিক বিভাজন আরও তীব্র ও অনমনীয় হয়ে ওঠে। বিএনপিসহ সব বিরোধী দলের রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের ওপর জুলুম-নিপীড়ন, গুম, হত্যা ও কারাগারে পাঠানোর অবর্ণনীয় প্রক্রিয়া শুরু হয়। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ৪০ বছরের স্মৃতিবিজড়িত ঢাকা সেনানিবাসের বাসভবন থেকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ করা হয় দেশনেত্রী খালেদা জিয়াকে। তঁার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো নির্যাতন ও নিপীড়নের মধ্যে বিদেশে মৃত্যুবরণ করেছেন। বড় ছেলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান মিথ্যা হয়রানিমূলক মামলায় অভিযুক্ত হয়ে লন্ডনে দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে নির্বাসনে ছিলেন।

ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা নিষ্ঠুরতম আচরণ করেছেন খালেদা জিয়ার ওপর। বাড়ি থেকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ করার পর রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা দিয়ে ফরমায়েশি রায়ে তঁাকে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কারাগারে নেওয়া হয়। এতেও তিনি ক্লান্ত হননি। কারাগারে বিনা চিকিৎসায় খালেদা জিয়া কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। তঁাকে কোনো উন্নত চিকিৎসার সুযোগ দেওয়া হয়নি।

গত ২৩ নভেম্বর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর থেকে খালেদা জিয়া চিকিৎসাধীন এবং এক কঠিন জীবন-মৃত্যুর মুখোমুখি ছিলেন। প্রতিনিয়ত দেশ-বিদেশের কোটি কোটি নাগরিক তঁার জন্য দোয়া করেছেন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা অবিরাম চেষ্টা করেছেন তঁাকে সুস্থ করে তুলতে।

কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ করে ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫ মঙ্গলবার ভোর ৬টা দুনিয়া থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ সংগ্রামের আপসহীন নেত্রী বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন।

একদলীয় শাসন বাকশাল থেকে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তনে ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’-এর ভিত্তিতে জাতিসত্তা প্রতিষ্ঠিত করেন আধুনিক স্বনির্ভর বাংলাদেশের রূপকার স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। তঁার সহধর্মিণী ও সুযোগ্য উত্তরাধিকারী খালেদা জিয়া।

আমরা প্রত্যাশা করি, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এবং দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার দেখানো পথ ধরে রক্তের ও রাজনৈতিক দর্শনের উত্তরাধিকার বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ৩১ দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে আগামীর কল্যাণ রাষ্ট্র গড়ে তুলবেন। এই হোক আমাদের সবার প্রতিশ্রুতি। দেশনেত্রীকে মহান আল্লাহ বেহেশতের সর্বোচ্চ স্থানে অধিষ্ঠিত করুন।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়