শুক্রবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০২৫
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ২৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৭:৪৬

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী কমে যাওয়ার কারণ ও প্রতিকার

রাশেদা আতিক রোজী
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী কমে যাওয়ার কারণ ও প্রতিকার

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলি নিঃসন্দেহে সবচেয়ে শক্তিশালী ভিত্তি। আধুনিক ভবন, প্রশিক্ষিত ও অভিজ্ঞ শিক্ষক, পর্যাপ্ত শিক্ষাসামগ্রী এবং সরকার প্রদত্ত উপবৃত্তি ও মিড-ডে মিলের মতো সুবিধাÑসব মিলিয়ে এগুলি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের তুলনায় অনেক এগিয়ে। অথচ, গত কয়েক বছর ধরে এই প্রতিষ্ঠানগুলি নীরব এক সংকটের সম্মুখীন : শিক্ষার্থী কমে যাওয়া। শিক্ষার্থীরা প্রধানত মাদরাসা এবং কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলিতে স্থানান্তরিত হচ্ছে। মজার বিষয় হলো, এই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যেখানে সীমিত সম্পদ ও দুর্বল অবকাঠামো নিয়েও সফলভাবে শিক্ষার্থী আকর্ষণ করছে, সেখানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো নিজেদের বিপুল প্রাচুর্য (শিক্ষক দক্ষতা, অবকাঠামো, উপকরণ) থাকা সত্ত্বেও কেন পিছিয়ে পড়ছে? এই লেখায় আমরা এই রহস্যের গভীরে প্রবেশ করব এবং শিক্ষক-কর্মকর্তাদের জন্য এমন কিছু বাস্তব করণীয় তুলে ধরব, যা এই সংকট মোকাবিলায় সহায়ক হবে।

বিপণনের চরম ব্যর্থতা : কিন্ডারগার্টেন ও মাদরাসাগুলো রঙিন লিফলেট, ব্যানার, স্থানীয় কেবল টিভি বিজ্ঞাপন এবং সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে তাদের সুবিধাগুলি প্রচার করে। অন্যদিকে, সরকারি বিদ্যালয়গুলো মনে করে “সরকারি” হওয়াই যথেষ্টÑতাদের কোনো প্রচারের প্রয়োজন নেই। দু’একটা ব্যতিক্রম ছাড়া সরকারি স্কুলের কোনো লিফলেট বা পোস্টার নেই, যা তাদের ‘গুণগত মান’-এর কথা তুলে ধরে।

প্রচারকে “অপেশাদার” মনে করা: সরকারি কর্মসংস্কৃতিতে “প্রচার বা মার্কেটিং”-কে শিক্ষক বা কর্মকর্তার কাজ মনে করা হয় না। এটিকে তারা নিজেদের মর্যাদার পরিপন্থী বা অপ্রয়োজনীয় মনে করতে পারেন।

প্রতিযোগিতার ধারণার অভাব: সরকারি স্কুলগুলো নিজেদেরকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিযোগী হিসেবে দেখে না, ফলে তাদের মতো সক্রিয় প্রচারের উদ্যোগও নেয় না।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চতুর কৌশল: বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সরাসরি অভিভাবকের দোরগোড়ায় (মসজিদের গেট, বাজারের মোড়, পাড়ায় পাড়ায়) পেঁৗছাচ্ছে চটকদার প্রচারপত্র নিয়ে, যেখানে সরকারি স্কুল নীরব।

স্বতঃস্ফূর্ততার ভ্রান্ত ধারণা: শিক্ষক ও কর্মকর্তারা ধরে নেন যে যেহেতু এটি সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষার অধিকার মৌলিক, তাই অভিভাবকরা আপনা-আপনি চলে আসবে। অন্য কোনো বিকল্প না থাকলে হয়তো আসত, কিন্তু এখন বেসরকারি মাদ্রাসা ও কিন্ডারগার্টেন একটি শক্তিশালী বিকল্প তৈরি করেছে।

দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য (গরহফংবঃ এধঢ়): বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলি শিক্ষককে ‘পরিষেবা প্রদানকারী’ (ঝবৎারপব চৎড়ারফবৎ) এবং অভিভাবককে ‘ক্রেতা’ (ঈঁংঃড়সবৎ) মনে করে। তারা শিক্ষার্থী ধরে রাখতে ও আকর্ষণ করতে নিরন্তর চেষ্টা করে। পক্ষান্তরে, অনেক সরকারি শিক্ষক-কর্মকর্তার মধ্যে এক ধরনের ‘নিশ্চিন্ত বা অপর্যাপ্ততার মানসিকতা’ (ঈড়সঢ়ষধপবহপু/ঝপধৎপরঃু গরহফংবঃ) কাজ করেÑযেখানে ভর্তির বিষয়টি তাদের দায়িত্বের অংশ মনে করা হয় না।

শিক্ষক-অভিভাবক দূরত্বের অভাব: অনেক কিন্ডারগার্টেন/মাদ্রাসার শিক্ষকগণ অভিভাবকের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন, সন্তানের দুর্বলতা নিয়ে আলোচনা করেন এবং হোম ভিজিট করেন। সরকারি বিদ্যালয়ে এই আন্তরিক ও নিয়মিত যোগাযোগের অভাব অনুভূত হয়।

মাদ্রাসা) ও কএ-এর সুবিধা: অনেক অভিভাবক মাদ্রাসায় ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি সাধারণ শিক্ষা এবং কিন্ডারগার্টেনে অপেক্ষাকৃত কম সংখ্যক শিক্ষার্থী প্রতি শিক্ষক (ঞবধপযবৎ-ঝঃঁফবহঃ জধঃরড়) এবং অতিরিক্ত যত্ন পাওয়ার আশা করেন। সরকারি স্কুলে ছাত্র বেশি থাকলে সেই ব্যক্তিগত যত্নের ঘাটতি অনুভূত হতে পারে।

পাঠদানের নতুন কলাকৌশল” প্রয়োগে অনীহা: সরকারি শিক্ষকরা নিয়মিত প্রশিক্ষণ পান বটে, কিন্তু ক্লাসরুমে সেই নতুন কলাকৌশল (যেমন, খেলার ছলে শেখা, ইন্টারেক্টিভ পদ্ধতি) প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে অনেকে অনীহা দেখান। এর ফলে পাঠদান নীরস ও একঘেঁয়ে হয়ে যায়।

তদারকি ও জবাবদিহিতার ঘাটতি: শিক্ষকের কার্যকারিতা এবং বিদ্যালয়ের সার্বিক পরিবেশ নিয়ে স্থানীয়ভাবে কঠোর তদারকি ও জবাবদিহিতার অভাব রয়েছে। ৩ জন শিক্ষার্থী নিয়ে ৫ জন শিক্ষক থাকা সত্ত্বেও যদি কার্যকর উদ্যোগ না নেওয়া হয়, তবে এর জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয় না।

কেন্দ্রীয় নির্ভরতা: সরকারি স্কুলগুলো কেন্দ্রীয় শিক্ষা প্রশাসন বা জেলা কর্তৃপক্ষের নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করে। স্থানীয় পর্যায়ে নিজেদের উদ্যোগে কোনো “বিশেষ কর্মসূচী” হাতে নেওয়ার প্রবণতা কম।

শিক্ষক-কর্মকর্তা স্থবিরতা: যখন একটি স্কুলে শিক্ষার্থী কমে যায়, তখনো কোনো কোনো শিক্ষক বা কর্মকর্তার মধ্যে সমস্যা সমাধানের জন্য জরুরি উদ্যোগ নেওয়ার মানসিকতা দেখা যায় না। কারণ, তাদের চাকরি বা বেতন সুরক্ষিত, সরকারি চাকরি সহজে যায় না।

একটি ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শনে দেখা যায়Ñঢাকার মিরপুর এলাকার একটা মসজিদে জুম্মা শেষে গেটে ন্যূনতম ২০টা কেজি/মাদ্রাসা তাদের স্কুলে ভর্তির বিজ্ঞপ্তির জন্য চাররঙা লেমিনেটেড ফ্লাইয়ার বিতরণ করল। এ দৃশ্য সারাদেশের! কিন্তু একটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এই উদ্যোগ নেই। দু’একটা স্কুল বড়জোর ফেবুতে স্টাটাস দেয়, যা কাংক্ষিত অভিভাবক পর্যন্ত পৌছায় না।

প্রতিকার

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি এবং নিয়মিত উপস্থিতি বৃদ্ধি করা একটি সমন্বিত প্রক্রিয়া, যা শিক্ষক, অভিভাবক এবং স্থানীয় প্রশাসনের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সম্ভব। বর্তমান প্রেক্ষাপটে কার্যকরী কিছু পদক্ষেপ নিচে তুলে ধরা হলো:

১. ভর্তি বৃদ্ধির কৌশল (ঊহৎড়ষষসবহঃ ঝঃৎধঃবমরবং)

* ক্যাচমেন্ট এরিয়া জরিপ: বিদ্যালয়ের আশেপাশের এলাকায় ‘শিশু জরিপ’ পরিচালনা করে স্কুলগামী এবং স্কুলের বাইরে থাকা শিশুদের তালিকা তৈরি করা এবং তাদের ভর্তি নিশ্চিত করা।

* সামাজিক প্রচারণা: স্থানীয় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান (মসজিদ, মন্দির), বাজার এবং মাইকিংয়ের মাধ্যমে শিক্ষার গুরুত্ব ও সরকারি সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে প্রচার চালানো।

* আকর্ষণীয় পরিবেশ: বিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণ ও শ্রেণিকক্ষকে রঙিন চিত্রকর্ম, খেলার উপকরণ এবং শিশু-বান্ধব আসবাবপত্র দিয়ে সাজানো যাতে শিশুরা বিদ্যালয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়।

* সহজ ভর্তি প্রক্রিয়া: ঝক্কিহীন ভর্তি প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা এবং প্রয়োজনে পিছিয়ে পড়া পরিবারের শিশুদের বাড়িতে গিয়ে ভর্তির ব্যবস্থা করা।

২. উপস্থিতি বৃদ্ধির কৌশল (অঃঃবহফধহপব ঝঃৎধঃবমরবং)

* শিক্ষণ পদ্ধতি আনন্দদায়ক করা: গতানুগতিক মুখস্থ বিদ্যার পরিবর্তে খেলাধুলা, গান, গল্প এবং সৃজনশীল কাজের মাধ্যমে পাঠদান পরিচালনা করা।

* পুরস্কার প্রদান: নিয়মিত উপস্থিত শিক্ষার্থীদের জন্য ‘স্টুডেন্ট অফ দ্য ডে’ বা মাসের শেষে ছোটখাটো পুরস্কারের ব্যবস্থা করা। এটি অন্য শিক্ষার্থীদেরও উৎসাহিত করে।

* মিড-ডে মিল ও উপবৃত্তি: পুষ্টিকর দুপুরের খাবার নিশ্চিত করা এবং উপবৃত্তি কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালনা করা, যা অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া পরিবারের শিশুদের স্কুলে থাকতে সহায়তা করে।

* হোম ভিজিট ও যোগাযোগ: কোনো শিক্ষার্থী ২-৩ দিন অনুপস্থিত থাকলে শিক্ষকরা সরাসরি অভিভাবকের সাথে মোবাইলে কথা বলবেন বা বাড়ি গিয়ে কারণ অনুসন্ধান করবেন।

৩. অভিভাবক ও সামাজিক সম্পৃক্ততা

* মা সমাবেশ ও উঠান বৈঠক: নিয়মিত ‘মা সমাবেশ’ এবং অভিভাবকদের নিয়ে সচেতনতামূলক সভার আয়োজন করা। এতে অভিভাবকরা তাদের সন্তানের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে পারেন এবং শিক্ষার প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা বাড়ে।

* স্মার্ট মনিটরিং: ডিজিটাল পদ্ধতিতে উপস্থিতি হাজিরা নেওয়া এবং শিক্ষার্থী অনুপস্থিত থাকলে সাথে সাথে অভিভাবককে ক্ষুদে বার্তা (ঝগঝ) পাঠানোর ব্যবস্থা করা।

৪. প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও সুযোগ-সুবিধা

বিষয়। করণীয়।

স্যানিটেশন : শিশুদের জন্য পরিষ্কার টয়লেট ও নিরাপদ খাবার পানির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।

নিরাপত্তা : কন্যা শিশুদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ এবং ইভটিজিং রোধে সচেতনতা তৈরি করা।

সহ-শিক্ষা : বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং বনভোজনের আয়োজন করা।

এক কথায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার মান কেজি স্কুলের চেয়েও উন্নত করা এবং শিক্ষকদের আন্তরিকতা বাড়ানোই হলো শিক্ষার্থী ধরে রাখার সবচেয়ে বড় উপায়।

রাশেদা আতিক রোজী : ইন্সট্রাক্টর, উপজেলা প্রাইমারি এডুকেশন ট্রেনিং সেন্টার, চঁাদপুর সদর, চঁাদপুর।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়