প্রকাশ : ২২ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:৪৩
খণ্ডে খণ্ডে অখণ্ড জীবন

(সাতচল্লিশতম পর্ব)
জন্ম-জনপদের ভাষাশৈলী : শ্রবণ-মননের সমৃদ্ধি
যে কোনো জাতির ঐতিহ্যের এক অনন্য উপাদান হলো নিজস্ব ভাষা। এ ভাষায় মিশে থাকে ঐ স্থানের সংস্কৃতি, সমাজ ও পারিবারিক আচরণের সমৃদ্ধ ইতিহাস। ঊনিশশো বায়ান্ন সালে বাঙালির রক্তে পাওয়া রাষ্ট্র ভাষার মহাকাব্যিক আন্দোলনও আমাদের সেই ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেয়। আমার জন্ম-জনপদ চরণদ্বীপ ও চট্টগ্রামের স্থানীয় ভাষার নিজস্ব শৈলী বিদ্যমান। ভাষার ব্যাকরণ কিংবা ব্যুৎপত্তি নয়, ভাষার ব্যবহারিক দিকটাই আমার কাছে গুরুত্ববহ। বর্তমান সময়ে ভাষাটির ব্যবহার কেমন ও কী অর্থ বহন করে, তাই-ই বিবেচ্য। আর এ কারণেই ভাষা না মরে বেঁচে থাকে সময়ের প্রয়োজনে বিবর্তিত হয়ে। স্থানীয় ভাষায় প্রবাদ-প্রবচন, বাগধারা ইত্যাদির ব্যবহারিক প্রয়োগ আমি শুনেছি মায়ের কাছে, বাবার কাছে, পরিবার ও সমাজের মানুষের কাছে। শৈশবে মাকে কোনো কিছু নিয়ে তাগাদা দিলেই মা প্রবাদ আউড়ে বলতেন,
‘হুইন্যে বঅনা চুড়ার নাম / এইরয্যি বঅনা হাতর কাম।’ প্রথম প্রথম এ কথার মানে বুঝতাম না। পরে বড়ো হতে থাকলে ধীরে ধীরে এর অর্থ পরিষ্কার হয়ে যায়। ব্রাহ্মণের কাজ হলো পূজা-অর্চনার মাধ্যমে যজমানি করা। যজমানি করেই ব্রাহ্মণ সংসার চালায়। ব্রাহ্মণের কাছে যখন পূজার বিনিময়ে আহারের বা দক্ষিণার প্রস্তাব আসে, তখন তার কাছে অন্য কাজ তুচ্ছ হয়ে যায়। ব্রাহ্মণ ( বঅনা) তখনই পারলে হাতের কাজ ফেলে পূজার কাজে লেগে পড়ে। আর একারণেই মা-ও আমাকে বলতেন, চিড়ার (চুড়া) কথা শুনলেই হাতের কাজ ফেলে দৌড় মারি আমি। ছোটবেলায় আমাদের সবারই একটা অভ্যেস ছিলো। তা হলো, যে কেউ চকলেট বা বিস্কুটের লোভ দেখালে তার পেছন পেছন যেতাম। এতে মাঝে মাঝে বিপদও আসতো। বিশেষ করে সে সময় গ্রামে ছেলেধরার উৎপাত ছিলো বেশি। এ অভ্যেস থেকে বিরত রাখতে মাকে বলতে শুনতাম, ‘যে কয় রাম/ তার সঙ্গে যাম’। অর্থাৎ যার তার সাথে যাওয়ার বায়না ধরতাম বা চলে যেতাম। গ্রামে-গঞ্জে ছেলেভোলানো ছড়ার ছড়াছড়ি। আমাদের গ্রামেও দোলনায় বাচ্চাকে ঘুম পাড়ানোর জন্যে মায়েদেরকে আওড়াতে শুনি, ‘ টঁলে বাছা টঁলে / ঘুম গিইয়্যে দে খঁঅলে’। এর অর্থ হলো দোলো বাছা, দোলো। তোমার দোল দেখে ঘুঘুরও ঘুম পেয়েছে। ঘুমিয়ে গেছে ঘুঘুও। শিশুকে দোলনায় দোল দেওয়া অনেক সময় সাংসারিক কারণে মায়ের পক্ষে সম্ভব হয় না। মা তখন ছোট মেয়েকে কিছু একটা দেওয়ার লোভ দেখিয়ে বাচ্চাটাকে দোলনায় দোল দিতে বলেন। সেই ঘটনাকে স্থানীয় একটা লোকছড়ায় ফুটিয়ে তুলতে শুনেছি এক ঠাকুমার কাছে। তিনি বলতেন,
‘ অসূয়া সূয়া ফোয়াউয়া ঢুলা
তোরলাই আইন্যুম পাইন্যাগুলা
পাইন্যাগুলা ফোয়াদ নাই
ফোয়া ঢুলাইতাম মনত নাই।’
এ লোকছড়ার অর্থ হলো এমন :
ও মেয়ে মেয়ে, বাচ্চাটাকে দোল দিয়ে ঘুম পাড়া। তোর জন্যে টিপফল (পানিফল) নিয়ে আসবো। এদিকে চালাক মেয়েটা টিপফল খেয়ে জবাব দেয়, টিপফলের কোনো স্বাদ নেই। বাচ্চাকে দোল দিতেও আমার মনে নেই। ঠাকুমার কাছে এমন মজার ছড়া শুনে আমি খুব আনন্দ পেতাম।
গ্রামে কৃষকেরা জমি চাষ করেন রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে। এ সময় তাদের মাথার মেজাজ ঠিক থাকে না। ঠিকমতো ফসল না ফললে তাদের বিনিয়োগ উঠে আসে না। তাই চাষের সময় কৃষকের মেজাজ থাকে ফর্টি নাইন। এমন কৃষককে খেপাতে গ্রামের দুষ্টু মেয়েরা সুর করে বলতো :
‘জ্যাডা, ঘ্যাডঘ্যাডা, নারিছর আগা ফূর্তি লাগা।’
এর মানে হলো, জ্যাঠা তুমি খালি ঘ্যাট ঘ্যাট করে বকাবাদ্য করো। দেখো তোমার পাটগাছের আগাগুলো লিকলিক করছে। ভালো ফলন হবে, ফূর্তিতে থাকো। যাকে বলছে, সেই কৃষক হয়তো একটা ধমক দিয়ে আরও বকা দেয়। তখন দুষ্টু মেয়েরা আড়াল থেকে পালিয়ে যায়। এ রকম আরেকটা দুষ্টু শ্লোক হলো :
মইশাং শাং শাং শাং
খাডর তলে মাথা ঢুকাই
পাদে ঢাং ঢাং ঢাং।
মইশাং বলা হয় বৌদ্ধ শ্রমণকে, যারা গেরুয়া চীবর ধারণ করে সাময়িক সময়ের জন্যে। কেউ কেউ দীর্ঘ সময়ও চীবর রাখে গায়ে। এরকম শ্রমণকে দেখে গ্রামের শয়তান ছেলেরা আউড়ে যায় এ শ্লোক। এতে অবশ্য শ্রমণেরা খেপতেন না। তারা মুচকি হেসে চলে যেতেন নিজ পথে। উপরোক্ত শ্লোকের অর্থ ছিলো একটু বেখাপ্পা মজাদার। ও শ্রমণ, শাং শাং শাং; তুমি খাটের নিচে মাথা ঢুকিয়ে ঢাং ঢাং ঢাং শব্দে বাতকর্ম করো। বড়ুয়াদের অন্য পাড়ার ছেলেরা খেপিয়ে বলতো :
বড়ুয়া, ভাত খাইয়্যেদে ফঅরুয়া
ভাত ন পাইলে চুরি গরে
যখন তখন ধরা পড়ে।
অর্থাৎ, বড়ুয়ারা দৈনিক ভাত খায় না। দুদিন পর পর তারা পরশু ভাত খায়। যেদিন ভাত পায় না, সেদিন চুরি করে। কিন্তু ভাত চুরি করতে গিয়ে ধরাও পড়ে। বড়ুয়াদের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে তারা বলতো,
‘ভাঁইরও নয় লাইও নয়
তারে কয়দে পেরগ্যুয়া
হিন্দুও নয় মুসলিমও নয়
তারে কয়দে বড়গ্যুয়া।’
মানে হলো বাঁশের তৈরি ধান রাখার ছোট পাত্র (ভাঁইর) বা বড় পাত্র ( লাই) নয় যেটা তাকে বলে ওরা ( পেরগ্যুয়া)। তেমনি যারা না হিন্দু না মুসলিম, তারাই হলো বড়ুয়া।
কিছু কিছু ধাঁধা আছে স্থানীয় ভাষায়। এগুলো শুনতে মধুর এবং ভাঙতেও বেশ ভালো লাগে। যেমন : ‘এক লতা টান দিলি সব লতা লড়ে’ এ ধাঁধাটি দিয়ে রেলগাড়িকে বুঝায়। আবার ‘ উডে ডিগ ডিগ / ন মেলে পাতা’ বললে গরুর শিংকে বুঝায়। অর্থাৎ ডিক বা কলির মতো উঠে কিন্তু পাতা হয়ে মেলে না। স্টিমার বুঝাতে বলা হয়, ‘সাত খাল হাঁচুরি / বাঘ আইয়্যেরদ্দে হা গরি।’ মানে সাত নদী পাড়ি দিয়ে বাঘের মতো হা করে আসে।’ উউররতুন পইড়লো বুড়ি / তিন ঠ্যাং উয়া গরি’ বললে বুঝতে হয় মাটির চুলাকে। এটার তিনটা ঝিক বা মাথা থাকে। ‘গুটগুইট্যা গাছর টেঁইট্যা’ বললে বেতের তৈরি ওরাকে বুঝানো হয়। ‘কালা হাইট্যার পানি’ মানে হলো সেই চা যার রং ঝুল গোলানো পানির মতো। এটা ঠাট্টা অর্থে ব্যবহৃত হয়।
মা সব সময় আমাদের দোনোমনা দেখলেই বলতেন, ‘এরেম এরেম ছেরেম ছেরেম ন গরিছ্।’ অর্থাৎ করবো কি করবো না এরকম দ্বিধাদ্বন্দ্বে না পড়তে বলতেন। যে কোনো কাজ হাফ হার্টেড করা ঠিক নয়। পূর্ণ প্রয়াস তাতে ঢালা দরকার। আবার যখন কেউ অযথা সময় ক্ষেপণ করতো তখন দিদিমা বকা দিয়ে বলতেন, ‘অ নাতি, ন খেশকাইছ্।’ মানে হলো, নাতিরে, অযথা সময় নষ্ট করিস্ না। পড়াশুনায় অমনোযোগী হলে মা বকে বলতেন, ‘পড়ার হঙ্গে তোরার কোনো আশ-আশ নাই।’ মানে হলো, পড়াশুনার সাথে তোদের কোনোরকম সংশ্লিষ্টতা নাই। কেউ যখন কিছু খাবে না খাবে না বলে সব খেয়ে ফেলে তখন তাকে গ্রামে বলে, ‘নিখাতুরি গইন্দর মা’। আমার মামাবাড়িতে গোবিন্দর মা বলে একজন নারী ছিলেন। তাকে যাই-ই খেতে বলতো কেউ, তিনি কিছুই খাবেন না বলতেন। কিন্তু খেতে বসলে সবই খেতেন। তার নামটি তাই আঞ্চলিক বাগধারায় যুক্ত হয়ে যায়। ফলে কেউ এরকম করলে তাকে শুনতে হয়, ‘নিখাতুরি গইন্দর মা’ এর অপবাদ। কেউ যদি বিভিন্ন রকমের তাল করে, অর্থাৎ নানারকম মর্জি দেখায়, তখন তাকে বলা হয়, ‘তুই বিইশিয়া ন গরিছ্।’ আর যদি কোনো রান্না অখাদ্য হয়ে যায়, তখন বলা হয়, ‘ কী রাঁধিলি? কুত্তায়ও ন খায়’। অর্থাৎ রান্না এমন পচা হয়েছে যে, কুকুরেরও তাতে অরুচি। বিশৃঙ্খলা করলে কিংবা চুরি-চামারির ধান্দা করলে আমার বাবার চাচী বলতেন, ‘আঁর হঙ্গে তঅড়ি নঅড়ি ন গরিছ্।’ মানে ‘আমার সাথে টাল্টি-বাল্টি’ কোরো না। আমার মা মাঝে মাঝে সংসার সামাল দিতে গেলে কাহিল হয়ে পড়তেন। মাথা কামড়াতো তখন তার। মা বলতেন, ‘রখিছ্, আঁর মাথা ভকবোয়ার’। মানে হলো, দাঁড়া বা রোসো। আমার মাথা ভক্ ভক্ করছে। আমাদের পাড়ায় এক জেঠিমা তার স্বামীকে উদ্দেশ্য করে ছেলেদের বলতেন, ‘অ ফুত, সাবধানে থাকিস্। মা মইল্যি বাপ তালই।’ অর্থাৎ, বাছা আমার! মা মারা গেলে বাপই তালই হয়ে যায়।
মাঝে মাঝে আত্মীয়-স্বজনদের কথা উঠলে ঘরের আবহাওয়া পাল্টে যেতো। এমন অনেকেই আছে দূরের আত্মীয় কেউ আমাদের ঘরে থেকে কিছুদিন পড়াশুনা করে গেছে। কিন্তু পরে আর খোঁজ-খবর রাখেনি। এরকম কিছু হলে মা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলতেন, ‘দূরো! পরর ছা ধোয়ার ছা’। মায়ের এ কথায় বুঝতাম, পরের সন্তান মানেই সে ধোপার সন্তানের মতো। পেশার প্রয়োজনে কাপড় নিতে আর দিতে আসে কেবল। কোনো মমতা লালন করে না। আবার গ্রামে কোনো কোনো ঘরে যখন খারাপ বা অসঙ্গত কিছু ঘটে থাকে, তখন তার খুঁত ধরতে সবাই বলে, ‘ বাইন দুয়াইরজ্যা ঘর।’ মানে পেছনের দরজাওয়ালা ঘর। যে কোনো কিছু অলক্ষ্যে ঘটতে পারে। যখন কেউ অকারণ শক্তি প্রয়োগ করে বা মশা মারতে কামান দাগানোর মতো বল দেখায় তখন মুরুব্বিদের বলতে শুনি, ‘দ্যইয়ছগিরি ন গরিছ্।’ মানে দানবগিরি করতে মানা করছেন। কাউকে পেট টাইট করে খেতে দেখলে লোকে বলে, ‘খোঁআর দড়ি খুলি দিইয়্যে’। মানে কল্যাণ কামনার্থে কোমরের যে তাগা বাঁধা আছে তা ছিঁড়ে ফেলেছে, যাতে পেট ভরে খেতে গিয়ে তা বাধা হয়ে না দাঁড়ায়। একই অর্থে বলা হয়, ‘পেডত চুনা লাগাই খা।’ এতে খাওয়ার পর পেট টাইট হয়ে ফুলে গেলে কারও নজর না লাগার কথা বলা হয়েছে। কারও ঘর বা কামরা খুব ছোট ছোট দেখলে মানুষেরা বলে, ‘কইতরর খোপ’। এ রকম নেতিবাচক মন্তব্য অনেককেই করতে শুনেছি। অবিশ্বাস্য কোনো কথা যদি কেউ বলে, তবে যাকে বলা হচ্ছে তিনি তাতে বিরক্ত গয়ে বলেন, ‘আফোডাইঙ্গা কথা ন কইছ্।’ অর্থাৎ অবিশ্বাস্য কোনো কথা বলিস না। যখন গণহারে দাওয়াত দেওয়ার কথা আসে তখন বলা হয়,’হরগন্ডিয়া নিমন্ত্রণ।’ কেউ কারও কতটুকু আপন বা প্রিয় তা বুঝাতে বলা হয়, তুঁউই আঁআর কইলজার বঁঅডু।’ এতে বুঝা যায়, যাকে উদ্দেশ্য করে বলেছে সে ঐ ব্যক্তির কলিজার বৃন্তের মতোই আপন ও আদরণীয়। যদিও কলিজার কোনো বৃন্ত হয় না। আবার কারও পেটে বমি বমি ভাব হলে বলতে শুনি, ‘পরাণ বিব্বিয়ার।’ অর্থাৎ কথা শুনে বিবমিষার উদ্রেক হয়েছে এমন। আবার শোয়ার ভঙ্গি বা ধরণ উল্টাপাল্টা হলে বলা হয়, ‘চৈতার মা’র পৈতানে।’ মানে শোয়ার সময় এপাশ-ওপাশ করতে করতে পা চলে যায় মাথার দিকে, মাথা চলে যায় পায়ের দিকে। এরকম অগোছালো জিনিসপত্র রাখলেও বলা হয়, চৈতার মা’র পৈতানে। ভাগাভাগিতে বা অংশীদারিত্বের কোনো কাজের ফলাফল ভালো হয় না। এক্ষেত্রে তা বুঝাতে বলতে হয়, ‘ ভাগে হাগনও ভালা নয়’। মানে মলত্যাগও ভাগে করা উচিত নয়। কারও বাতকর্মে বেশি দুর্গন্ধ হলে গ্রামের বুড়োবুড়িকে বলতে শুনি,’মূলা খাইয়া পাদ।’ তাই মূলার কদর কারও কারও কাছে দামে সস্তা হলেও কম। কেউ যখন হাতের কাছে থেকেও কিছু খুঁজে পায় না তখন তাকে স্থানীয় ভাষাশৈলীতে ভর্ৎসনা করে বলা হয়, ‘ চউগত কানা মালা দ্যিয়ুছ্ না?’ অর্থাৎ সে কি আদৌ অন্ধ নাকি? কারও কথা মুখে না আসলে বা সময়মত সঠিক কথা বলতে না পারলে লোকজন খেপে গিয়ে বলে, ‘ মুখত কলা লইয়্যছ্ না?’ একই অর্থে বলা হয় ‘মুখত দলা পিডা লইয়্যছ?’ গ্রামে কুসংস্কারবশত পিঠা বানানোর খোলার শেষ, পিঠা কেউ খেতে চায় না। লোকবিশ্বাস আছে, এতে নাকি মেয়ে শিশুর জন্ম হতে পারে। একে বলে ‘ খোলাপোঁছা পিঠা।’ খোলাপোঁছা মানে পিঠার কাঁইয়ের পাত্র লেপে-পুঁছে যা পাওয়া যায়। সন্তানের ক্ষেত্রে শেষ সন্তানটিকে বলা হয় ‘খইলতা পোঁছা’। অর্থাৎ মায়ের জরায়ু লেপে-পুঁছে যার জন্ম। যাদের কোনো সন্তানাদি হয়নি, তাদেরকে গ্রামে বলা হয়, ‘ নইযার মা, নইয়্যার বাপ।’ মানে হলো যে শিশু জন্ম নেয়নি তার মা বা তার বাপ। কেউ যখন কোনো কিছুর জন্যে অতি আগ্রহ দেখায় বা ছোঁক ছোঁক করে তখন তাকে শাঁসিয়ে বলা হয়,’ ন লেরলেরাইছ্।’ অলস বা কুঁড়ে যে, যার আঠারো মাসে বছর, তাকে দেখলেই বলা হয়,
‘লড়েরদে লড়ের চড়েরদে চড়ের।’ এর কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। কাউকে যখন মা দুপুরের আহারের তাগাদা দিয়ে বলেন, ‘যা, পঅইরত্তুন ডুম মারি আয়,’ তার মানে হলো যা তাড়াতাড়ি স্নান ( বা গোছল) করে আয়। ডুম মানে হলো ডুব। কাউকে ঠগবাজ বা প্রতারকে পেলে বলা হয়,
‘টেবটেবিয়্যে পাইয়্যি’। যাকে টেবটেবিয়্যে পায় সে বুঝে, এর মানসিক যন্ত্রণা কেমন।
ছোটবেলায় দুজন খেলোয়াড় থেকে একজনকে নিরপেক্ষভাবে বেছে নিতে হলে আবোলতাবোল ছড়া কেটে তা নির্ধারণ করতে হতো। একজনের দিকে হাত নির্দেশ করে ছড়া শুরু হতো আর যার গায়ে গিয়ে শেষ হতো, তাকেই বেছে নেওয়া হতো। যেমন :
‘এরেত বেরেত লোহার কেরেত
সাম সুম ডবলা বুরুত।’
কাউকে পচাতে হলে বলা হতো, অমুক (যে কোনো একটা ফল বা জিনিসের নাম) বলতো। সে যদি তা বলতো, অমনি ছড়া কেটে তাকে পচানো হতো। যেমন
কাউকে বলতে বলা হলো ‘ছোরাতা।’
সে বললো : ছোরাতা
অমনি তাকে পচিয়ে বলা হতো :
খইয়াত পড়ি গু হাতা।
এখানে ‘খইয়া’ মানে হলো পরিত্যক্ত জলাভূমি। ‘হাতা’ মানে হাতড়ানো, চটকানো।
কোনো গ্রাম বা স্থানকে ছোট করতে হলে বা পচাতে হলে নানা কিসিমের শ্লোক বানানো হতো। যেমন :
মাচ খরাপ লইট্যা
দেশ খরাপ পইট্যা।
অর্থাৎ মাছের মধ্যে লটিয়া মাছ খারাপ আর জায়গার মধ্যে খারাপ হলো পটিয়া। এদের নিয়ে আরও একটা শ্লোক আছে। তা হলো : কঁঅলর গু পোন্দর টিয়া হইলদে পটিয়া।’ কঁঅলর গু’ মানে হলো ঘুঘু পাখির মল আর পাছার ভাঁজ হলো ‘পোন্দর টিয়া’।
আমার মামাবাড়ি চাঁদগাঁওকে ব্যঙ্গ করার শ্লোক ছিলো : ‘চানগাঁ / হেয়ালর গু দি পান খা।’ অর্থাৎ হে চাঁদগাঁর লোকেরা, তোমরা শেয়ালের মল মেখে পান খাও।
বাঁশখালীকে হেয় করতে বলা হতো :
‘ বাঁশর গিরা/ তেলইনর কালি/ বাঁশখালি।’ অর্থাৎ বাঁশের গিঁট আর পাতিলের তলার কালি মিলে বাঁশখালী।
সাতকানিয়ার গরু চোরেরা নাকি বিখ্যাত। রাতে গোয়ালে গরু রেখে ঘুমালে সকালে দেখা যেত গরুর শিং ঘরের বেড়ায় আটকে রেখে চোর গরু নিয়ে পগার পার। তাই এদের নিয়ে শ্লোক আওড়ানো হতো :
‘সাতকাইন্যা গরু চোর/ বেড়া ফাডি দিইয়্যে দুঁউড়।’ মানে হলো সাতকানিয়ার গরু চোরেরা ধরা পরার আগেই ঘরের বেড়া চিরে দৌড়ে পালিয়ে যায়। (চলবে)








