সোমবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২৫
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ২২ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:৩৯

জাকারিয়া তামেরের ‘নির্বাচিত গল্প’

ছোটগল্পে শোষকদের নগ্ন দৃশ্যায়ন

মুহাম্মদ ফরিদ হাসান
ছোটগল্পে শোষকদের নগ্ন দৃশ্যায়ন

তিনি বিখ্যাত দামেস্ক শহরের সন্তান। দারিদ্র্য অভিঘাত ও স্বপ্ন-বাস্তবতার মধ্যে তাঁর বেড়ে ওঠা। অসম্ভব মেধাবী লেখক জাকারিয়া তামের তাঁর দৃষ্টিকে ছড়িয়ে রাখেন সর্বত্র। আরব বিশ্বে সমাজ ও রাজনীতির অভ্যন্তরে যে-সব ক্লেদ, ক্ষত প্রতিনিয়ত জেগে থাকে, সেগুলো তাঁর লেখার উপজীব্য বিষয়। তামেরের রসবোধ অসাধারণ। তাঁর শ্লেষ ভয়ানক, একই সঙ্গে মর্মভেদী। অপরাজনীতি ও অপশক্তির বিরুদ্ধে তাঁর প্রতিটি লেখা উদ্ধত তলোয়ার। মাইনুল ইসলাম মানিক অনুদৃত জাকারিয়া তামের-এর নির্বাচিত গল্প পড়ে মনে হয়েছে, শোষণ, পীড়ন, দহনে জর্জরিত নাগরিকদের অনুচ্চারিত কথাগুলোই লেখক বলেছেন অকপটে। এজন্যে তাঁকে প্রতীকের আশ্রয় নিতে হয়েছে। ব্যঙ্গ, বিদ্রুপের তীব্র চপেটাঘাতের কারণে শাসকদের রোষানলে পড়েছেন। কিন্তু তাঁর লেখার মতো তিনিও অনমনীয়।

সিরিয়াকে আমরা জেনেছি রাজা-রানি, গল্পমুখর প্রাচীন নগর হিসেবে। ক্রমেই এটির আলো নিভে গেছে, এখন সিরিয়া উচ্চারিত হলে চোখে ভাসে বিধ্বস্ত, বিপন্ন আর পশ্চাদ্গামী এক নগরীর কথা। এ ভূমির নাগরিকরা বহুকাল ধরে ভীত-সন্ত্রস্ত ও নিপীড়িত। জাকারিয়া তামের শোষিত মানুষের পক্ষে বিদ্রোহী কণ্ঠস্বর। তাঁর একটি গল্প ‘হাসান আল-মাজাজ আল-সাঘৌরির চূড়ান্ত বিজয়’। সামান্যতম অপরাধ না করেও যে রাষ্ট্রের রোষানলে পড়ে কোনো মানুষের জীবন বিপন্ন হতে পারে, এ গল্পটি তার প্রতিচ্ছবি। মূল চরিত্র হাসান আল-মাজাজ আল-সাঘৌরিকে অপরাধ ছাড়াই নয় বছর জেলখানায় বন্দী রাখে। দশম বছরে আদালতে তোলা হলে তিনি দেখেন তার পরিচিত অর্থলোভী চরিত্রহীন নারীটি আজ বিচারক। একসময়ের চোর আজ প্রহরী। তিনি আদালতে জানতে পারেন, দেশে তার নাগরিকত্ব বাতিল হয়ে গেছে, স্ত্রী, সন্তান, সম্পদে আইনগত তার অধিকার নেই। এমনকি অঙ্গার হয়ে যাওয়া নিজস্ব হৃৎপিণ্ডটিও এখন তার নেই, দান করা হয়েছে। পরে নিজেই স্বেচ্ছায় অন্য অঙ্গগুলো দান করে দেন। এতকিছুর পরেও হাসান আল-মাজাজ আল-সাঘৌরি দাঁড়িয়ে আছেন দেখে বিচারক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। প্রহরীরা তাকে কামরার বাইরে মাটিচাপা দেন। এতে হাসান আল-মাজাজ আল-সাঘৌরি খুশি হয়েছেন। কেননা, নির্বাসন দণ্ডের পরিবর্তে তিনি মাটির নিচে নিরাপদ শান্তিপূর্ণ জীবন উপভোগের সুযোগ পেয়েছেন। গল্পটি প্রতীকী, বর্ণনাভঙ্গি সাদামাটা। কিন্তু মূলভাব হৃদয়স্পর্শী। তামের বলতে চেয়েছেন, রাষ্ট্রব্যবস্থা এতো জঘন্য হয়েছে যে, জীবিতাবস্থায় মানুষ কখনও সুখ-শান্তির দেখা পাবে না। একমাত্র মৃত্যুর পরেই নাগরিকদের জীবন শান্তিপূর্ণ হতে পারে।

‘অভিযুক্ত’ গল্পটিতে আবার দেখানো হয়, দেশে কবরে গেলেও শান্তি নেই। যে কারণে ওমর খৈয়ামকে গোরস্তান থেকে তুলে বিচারের মুখোমুখি করা হয়। আদালতে মৃত কবিকে দোষী সাব্যস্ত করে তাঁর সকল কবিতা নিষিদ্ধ ও ধ্বংস করার নির্দেশ দেয়। রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতি বিতৃষ্ণা, ক্ষোভের চরম বহিঃপ্রকাশ এই গল্প। একই ধাঁচের গল্প ‘পুলিশ ও ঘোড়া’। শাসকরা চতুর। তারা জানে সাহসী মানুষকে ধীরে ধীরে বশ করা হয়।ছলে-বলে-কৌশলে বিদ্রোহীকে পরিণত করা হয় ভীরুতে। ‘দশম দিনে বাঘ’ এমন চিন্তাধারী একটি প্রতীকী গল্প। বাঘকে খাঁচায় বন্দী করে তত্ত্বাবধায়ক মাত্র দশদিনের কৌশলে বেড়ালে পরিণত করে। এক পর্যায়ে বাঘকে মাংসের পরিবর্তে খড় খেতে বাধ্য করা হয়। তামের গল্প শেষ করেছেন এভাবে--দশম দিনে তত্ত্বাবধায়ক, তাঁর শিক্ষার্থীরা, বাঘ ও খাঁচা--সবকিছু উধাও হয়ে গেলো, বাঘ নাগরিক হয়ে গেলো আর তার খাঁচা হয়ে গেলো একটা শহর।’ অর্থাৎ বাঘ যেমন তত্ত্বাবধায়কের খাঁচায় বন্দী, তেমনি নাগরিকরাও শাসকদের কারাগারে বন্দী। শাসকদের কবলে পড়ে পুরো দেশটাই হয়ে উঠেছে জেলখানা।

‘আগুন’ গল্পটিতে দেখানো হয়েছে আমাদের অবহেলা, প্রতিবাদ ও বলিষ্ঠতার অভাবে আমরা নিজেরাই বিশাল অগ্নিকুণ্ড তৈরি করেছি। যাতে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে মানুষ, চাঁদ, বই, কারাগার ইত্যাদি। কিন্তু যখন শাসকদের আগুনে নিক্ষেপ করা হলো, তখন উল্টো আগুন নিভে গেছে। কেননা, আমাদের অসচেতনতার সুযোগে শাসকরা অনেক শক্তিধর হয়ে গেছেন। ফলে অত্যাচার থেকে জনগণের মুক্তি মেলেনি।

‘মুফতির প্রতিভা’ গল্পে মুফতিরাও শাসকদের অনুকূলে কথা বলেন। মুফতি জানান, ওমর ইবনুল খাত্তাব খাবারের জন্যে পাথর সিদ্ধ করতেন। জমিদার এ কথা শুনে পাথর আমদানি করে ক্ষুধার্ত মানুষের মুখ পাথর দিয়ে পূর্ণ করলেন। গল্পে মুফতিও শাসকদের সহযোগী।

‘নিষিদ্ধ’ গল্পটি ব্যতিক্রম। ধর্মান্ধতা গল্পের আলোচ্য বিষয়। বড়ো অপরাধ আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় না, কিন্তু ছোট বিষয় আমাদের মাথাব্যথার কারণ। গল্পে এমনটিই দেখানো হয়েছে।

তাঁর গল্পের উৎসভূমি সিরিয়ায় হলেও বিস্তার পৃথিবীজোড়া। শাসক ও শোষিতের আলাদা কোনো শ্রেণিবিন্যাস নেই। সব অত্যাচারী শাসকের চরিত্রই এক। শোষিত মানুষের দেশ ভিন্ন থাকতে পারে, কিন্তু অনুভূতির ভিন্নতা নেই। সেই অর্থে জাকারিয়া তামেরের প্রতীকী গল্পগুলো বিশ্বের সকল অত্যাচারী শাসকের জন্যে চপেটাঘাত। সমাজ-রাষ্ট্রের অব্যবস্থাপনা, নির্মমতা, নির্বুদ্ধিতার চিত্র তাঁর গল্পগুলোতে সুস্পষ্ট। তাঁর গল্পে পশুকে প্রতীক হিসেবে চরিত্রায়িত করা হয়েছে। বিভিন্ন গল্পে বাঘ, সিংহ, গাধা, ঘোড়া, শিয়াল, বেড়াল, ভেড়ার স্বতন্ত্র চরিত্র রয়েছে। মূলত এগুলো মানুষ চরিত্রেরই বিকল্প।

তামের শাসকদের নগ্নভাবে উপহাস করেছেন। সহজ-সরল হলেও তাঁর শ্লেষের তীর বৃহৎ ক্ষতের সৃষ্টি করে। বিশেষ করে আরব বসন্তের সময় তাঁর গল্পগুলো পৃথিবীজুড়ে বহুলপাঠ্য হয়ে উঠে।

বাংলা ভাষায় তাঁর গল্পগুলোর খুব বেশি অনুবাদ হয়নি। জানা মতে, ২০১৫ সালে ষড়ৈশ্বর্য মুহম্মদের অনুবাদে ‘জাকারিয়া তামেরের গল্প’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। মাইনুল ইসলাম মানিক আরও ব্যাপৃত পরিসরে তামেরের গল্প অনুবাদ করেছেন। ‘নির্বাচিত গল্প : জাকারিয়া তামের’ গ্রন্থে ৩০টি গল্প স্থান পেয়েছে। ভাষাশৈলীও অসাধারণ। গল্পগুলো পড়তে গিয়ে পাঠক কোথাও কৃত্রিমতা পাবেন না। শিল্পী মানবের চমৎকার প্রচ্ছদ বইটিকে আরও আকর্ষণীয় করেছে।

নির্বাচিত গল্প : জাকারিয়া তামের। ভাষান্তর মাইনুল ইসলাম মানিক। প্রকাশক পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.। ১০৮ পৃষ্ঠা, মূল্য ২৫০ টাকা। বইটি রকমারি ডটকম, পিবিএস ও বইফেরীতে পাওয়া যাবে।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়