প্রকাশ : ২০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০:০০
ডাঙ্গাপাড়ার ফুলপরীদের দোকান

ডাঙ্গাপাড়া গ্রামটি যেন প্রকৃতির হাতে আঁকা এক নিবিড় ক্যানভাস।
সেখানে মাঠের পর মাঠ সবুজ ধানক্ষেত, আর সেই ক্ষেতের কোল ঘেঁষে একফালি পথ চলে গেছে গ্রামের প্রাচীন বটতলার দিকে। বটতলার ঠিক উল্টো দিকে, যেখানে সূর্যের শেষ আলোটুকু সবথেকে বেশি সময় খেলা করে, সেখানেই ছিলো এক অদ্ভুত সুন্দর দোকানÑযার নাম ‘ফুলপরীদের দোকান’।
দোকানটির মালিক ছিলো এক বৃদ্ধা, নাম তার শান্তিদি। শান্তিদির বয়স কতো, তা’ কেউ জানতো না। তবে গ্রামের মানুষ বলতো, ডাঙ্গাপাড়ার সবথেকে পুরোনো শিউলি গাছটার বয়সও নাকি শান্তিদির চেয়ে কম। শান্তিদি দেখতে ঠিক যেন রূপকথার সেই পরীদের দিদিমা। ধবধবে সাদা শাড়ি, চোখে এক অদ্ভুত মিষ্টতা আর মুখে সবসময় লেগে থাকতো একফালি হাসি, যা’ ডাঙ্গাপাড়ার সকালের রোদের থেকেও মিষ্টি।
‘ফুলপরীদের দোকান’ আর পাঁচটা দোকানের মতো ছিলো না। এখানে কোনো তেল-নুন, চাল-ডাল বিক্রি হতো না। দোকানের মূল আকর্ষণ ছিলো ফুল। তবে এগুলো সাধারণ ফুল ছিলো না। শান্তিদি ভোরবেলায়, শিশির ঝরার মুহূর্তেই, গ্রামের সবচেয়ে নিভৃত কোণ থেকে, যেখানে নাকি পরীরা রাতে নেমে আসে, সেইসব জায়গা থেকে বিরল আর পবিত্র ফুল সংগ্রহ করতেন। এ ফুলগুলো শুধু সুন্দরই ছিলো না, এদের ছিলো আশ্চর্য গুণ।
কেউ যদি মন খারাপের দিনে শান্তিদির দোকানে এসে একটি ‘নীল সন্ধ্যাতারা’ ফুল কিনতো, পরদিন তার মন ভালো হয়ে যেতো। যদি কোনো কৃষক তার ফসলের জন্যে আশীর্বাদ চাইতো, শান্তিদি তাকে দিতেন 'সবুজ হাসি' নামের এক বিশেষ ফুল, যা’ নাকি জমির উর্বরতা বাড়াতো। আর প্রেমিকের দল ভিড় করতো ‘রঙিলা প্রজাপতি’ ফুলের জন্যেÑশোনা যেতো, এ ফুল হাতে নিয়ে ভালোবাসার কথা বললে, সে প্রেম নাকি চিরস্থায়ী হয়।
দোকানটি ছিলো সাজানোও ভিন্ন কায়দায়। দেয়ালগুলো ছিলো মাটির, আর তাতে খোদাই করা ছিলো লতাপাতার নকশা। ছাদ থেকে ঝোলানো থাকতো শুকনো ফুল আর রঙিন সুতো দিয়ে বাঁধা অসংখ্য 'ড্রিমক্যাচার' বা স্বপ্ন-ধরার জাল। দিনের আলোয় যখন বাইরে থেকে মৃদু বাতাস ঢুকতো, তখন সেই ঝোলানো সজ্জাগুলো এমনভাবে দুলতো, যেন মনে হতো ফুলপরীরা সত্যি সত্যিই চারপাশে আনাগোনা করছে।
ডাঙ্গাপাড়ার ছেলেমেয়েরা মনে করতো, শান্তিদি আসলে একজন ফুলপরী। কারণ, তিনি সবসময়ই হাসতেন, সবসময়ই মানুষকে সাহায্য করতেন। একবার গ্রামে খুব খরা হলো। মানুষের মাথায় হাত, মাঠ ফেটে চৌচির। তখন গ্রামের সবাই শান্তিদির কাছে গেল। শান্তিদি দীর্ঘক্ষণ চোখ বন্ধ করে বসে রইলেন। তারপর সবাইকে বললেন, "কাল সূর্য ওঠার আগেই তোমরা সবাই মিলে বটতলার নিচে একটি সাদা শাপলা ফুল পুঁতে এসো।"
গ্রামবাসীরা প্রথমে হাসলেও, শান্তিদির উপর বিশ্বাস থাকায় তাই করলো। অবাক কাণ্ড! পরদিন ভোরে আকাশ কালো করে বৃষ্টি নামল। এমন বৃষ্টি হলো যে, সমস্ত মাঠ আবার জলে ভরে উঠল। গ্রামের লোক বলাবলি শুরু করলোÑএসবই ফুলপরীদের দোকানের জাদু।
তবে শান্তিদির কাছে সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস ছিলো একটি ছোট্ট কাঁচের বয়াম। বয়ামের মধ্যে থাকত এক চিমটি সোনালী ধুলো। কেউ জিজ্ঞেস করলে শান্তিদি হেসে বলতেন, "এগুলো ফুলপরীদের ডানা ঝেড়ে আসা গুঁড়ো, মনকে আনন্দ দিয়ে যায়।"
একদিন এক শহরের লোক এলো ডাঙ্গাপাড়ায়। নাম তার রণজিৎ। সে ছিলো একজন বড় ব্যবসায়ী, যে গ্রামে তার পুরনো জমি বিক্রি করতে এসেছিলো । রণজিৎ ছিলো হিসেবি, কঠোর আর একদম আবেগহীন। গ্রামের সরলতা, শান্তিদির দোকান, সবকিছু তার কাছে ছিলো অর্থহীন। সে শান্তিদির কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, "এসব ফালতু ফুল বিক্রি করে তোমার কতো টাকা লাভ হয়?"
শান্তিদি হাসলেন। বললেন, "বাবা, এখানে লাভ টাকার অঙ্কে মাপা যায় না। যেদিন কেউ মন ভালো করে হাসে, সেদিনই আমার লাভ।"
রণজিৎ হেসে উড়িয়ে দিলো। কিন্তু নিজের জীবনে সে সুখী ছিলো না। তার স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলো , আর ব্যবসা তাকে দিয়েছিলো শুধু চাপ আর নিঃসঙ্গতা। সে হাসিমুখে শান্তিদির দোকান থেকে চলে এলেও, কেমন যেন একটা অস্বস্তি তার মনকে গ্রাস করছিলো।
সেদিন রাতে রণজিৎ একটি খারাপ স্বপ্ন দেখলÑতার সমস্ত টাকা চুরি হয়ে গেছে এবং সে নিঃস্ব। ঘুম ভেঙে তার বুকের ভেতর ধড়ফড় করছিলো। ভোরবেলা সে আবার শান্তিদির কাছে ছুটে গেলো।
শান্তিদি তখন দোকানে বসে একটি জবাফুল দেখছিলেন। রণজিৎকে দেখে তিনি বললেন, "ভয় পাচ্ছ, তাই না? জীবনের সবথেকে মূল্যবান জিনিস কি শুধুই টাকা?"
রণজিৎ চুপ করে রইল। শান্তিদি তখন তাকে কাঁচের বয়াম থেকে এক চিমটি সোনালী ধুলো নিয়ে তার হাতের তালুতে ছড়িয়ে দিলেন। বললেন, "এ নাও, ফুলপরীদের গুঁড়ো। আজ শুধু একবারের জন্যে চোখ বন্ধ করে ভাবো, তোমার জীবনে সবথেকে আনন্দের মুহূর্তটি কখন এসেছিলো।"
রণজিৎ অনিচ্ছা সত্ত্বেও চোখ বন্ধ করলো। মনে পড়লো, তার ছোটবেলার মাটির ব্যাংকে জমানো টাকা দিয়ে সে তার দিদির জন্যে প্রথম একটি চন্দ্রমল্লিকা ফুল কিনেছিলো। সেই ফুল পেয়ে দিদির হাসিটা ছিলো অমূল্য।
যখন সে চোখ খুললো, দেখলো তার হাতের সোনালী গুঁড়ো হাওয়ায় মিশে গেছে। কিন্তু তার মন শান্ত। রণজিৎ বুঝতে পারল, জীবনের আসল সম্পদ ভালোবাসা, হাসি আর মানুষের বিশ্বাস। সেদিন সে জমির দলিল ছিঁড়ে ফেললো।
ডাঙ্গাপাড়ার সেই ব্যবসায়ী রণজিৎ আর ফিরে যায়নি শহরে। সে গ্রামে থেকে গেল এবং শান্তিদির কাছ থেকে ফুল চেনার, আর মানুষের মন বোঝার কৌশল শিখতে শুরু করলো। সে সাহায্য করত শান্তিদির ‘ফুলপরীদের দোকানে’Ñযে দোকান কেবল ফুল বিক্রি করতো না, মানুষের জীবনে স্বপ্নের রং ছড়িয়ে দিতো।
‘ফুলপরীদের দোকান’ ডাঙ্গাপাড়ার শুধু একটা দোকান ছিলো না। ওটা ছিলো এক টুকরো স্বপ্ন, যেখানে ফুল ছিলো ভালোবাসার ভাষা, আর শান্তিদি ছিলেন সেই ভাষার রক্ষক। আর তাই, ডাঙ্গাপাড়ার প্রতিটি মানুষ বিশ্বাস করতোÑযতোদিন বটগাছ থাকবে, যতোদিন থাকবে ‘ফুলপরীদের দোকান’, ততোদিন ডাঙ্গাপাড়ার কপালে কোনো অমঙ্গল ছায়া ফেলতে পারবে না।








