মঙ্গলবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২৫
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৩:০৩

এ পথ কি রক্তে হাঁটার

সুধীর বরণ মাঝি
এ পথ কি রক্তে হাঁটার

বাংলাদেশের ইতিহাস একদিকে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সমৃদ্ধ, অন্যদিকে রাজনৈতিক সহিংসতার পুনরাবৃত্তিতে জর্জরিত। স্বাধীনতার পর পঁাচ দশক পার হলেও সহিংসতা, অস্থিরতা, হিংসাশ্রয়ী রাজনীতি ও জনজীবনের অনিশ্চয়তা বারবার সমাজকে আঘাত করেছে। জনগণের আকাঙ্ক্ষা একটাইÑস্বাধীন নিশ্বাস, সহিংসতামুক্ত জনপদ, শান্তির সাদা পতাকা এবং গণতান্ত্রিক জীবনের নিশ্চয়তা। কিন্তু প্রশ্ন রয়ে যায়: “সহিংসতা কি কোনো জাতির অদৃষ্ট, নাকি ন্যায় ও মানবতার শক্তিই একটি জাতিকে টিকিয়ে রাখে?” বাংলার ইতিহাস বারবার মনে করিয়ে দেয়Ñ“আর কত রক্ত, কত লাশ, কত কান্না হলে এই ভূখণ্ডে শান্তি নেমে আসবে?” এই প্রশ্ন নতুন নয়; তবে প্রতিটি প্রজন্মের কাছে এটি নতুন বেদনায় ফিরে আসে। স্বাধীনতার পরও কেন সহিংসতার পুনরাবৃত্তি ঘটেÑতার উত্তর খুঁজতে হলে সমাজ-রাষ্ট্রের অন্তর্গত কাঠামো ও সংকট বিশ্লেষণ জরুরি।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক সহিংসতার উৎস তিনটি প্রধান মাত্রায় দেখা যায়Ñরাজনৈতিক ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও দলীয়করণ, অর্থনৈতিক বৈষম্য ও তরুণদের বেকারত্ব, আইনের শাসনের দুর্বলতা ও জবাবদিহির ঘাটতি। এই তিনটি উপাদান মিলেই তৈরি হয় এমন এক বাস্তবতা, যেখানে জনপদ মৃত্যুভয়ে আক্রান্ত, নাগরিক নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ এবং রাষ্ট্র-সমাজ সম্পর্ক টানাপোড়েনে নিমজ্জিত। বাংলাদেশের অধিকাংশ সংঘর্ষ ঘটে জনবহুল জনপদেÑরাস্তা, বাজার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও এমনকি পরিবারের অভ্যন্তরে। যে মাটি সোনার ফসল ফলানোর ক্ষমতা রাখে, যেখানে জন্ম নেয় কবিতা, প্রেম, শিল্প ও মানবতার গানÑসেই মাটিই যখন লাশ ও হাহাকারের বোঝা বইতে বাধ্য হয়, তখন সমাজের বিবেক স্তব্ধ হয়ে যায়। এ দেশ কোনো হত্যার মাঠ নয়, এ জনপদ কোনো মৃত্যুর ঘর নয়Ñএই বিশ্বাসই আমাদের নৈতিক ভরসা।

সমাজের ক্ষতবিক্ষত বাস্তবতা এক বেদনাবিধুর প্রশ্ন তোলেÑ“হে বঙ্গ জননী, কেনো তোমার এত নির্মম দৃষ্টি? এ কি রক্তে লেখা কোনো অনিবার্য ভাগ্যলিপি?” বাংলার মাতৃভূমির প্রতি এই প্রশ্ন আসলে রাষ্ট্র-নাগরিক দূরত্বের নির্মম প্রতিফলন। দক্ষিণ এশীয় সাহিত্যতত্ত্বে মাতৃভূমি প্রায়শই রাষ্ট্রের নৈতিক অবস্থার রূপক (ঈযধঃঃবৎলবব, ১৯৯৩), আর সেই রূপক যখন রক্তে ভিজে ওঠে, তা জাতির গভীর সংকটের পরিচয় দেয়। বিশেষত শিশুর কণ্ঠে যখন উচ্চারিত হয়Ñ“মা, এ পথ কি রক্তে হঁাটার?”Ñএটি আবেগের প্রকাশ মাত্র নয়; বরং সমাজের নৈতিক ভিত্তি ভেঙে পড়ার সতর্ক সংকেত। উঁৎশযবরস (১৯১২/১৯৯৫) দেখিয়েছেন, শিশু সমাজের ভবিষ্যৎ প্রতিচ্ছবি; শিশু সহিংসতাকে স্বাভাবিক ভাবতে শুরু করলে সমাজের নৈতিক কাঠামো বিপর্যস্ত হয়। এই প্রশ্ন তিনটি বাস্তবতা তুলে ধরেÑসহিংসতা প্রজন্মান্তরের মনস্তত্ত্ব ক্ষতিগ্রস্ত করছে, নাগরিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র ব্যর্থ হচ্ছে, সমাজ সহিংসতার সামনে অসহায় হয়ে পড়ছে।

যখন অন্যায়ের চাপ সীমা অতিক্রম করে, তখন জনতার বিপ্লবচেতনা ঘুমিয়ে থাকে না। তখন রাস্তায় নামার আহ্বান, শপথ নেওয়া, প্রতিরোধের মন্ত্রÑসবই জনতার অন্তর্গত শক্তিকে জাগিয়ে তোলে। ঞরষষু (২০০৪) বলেন, যখন জনগণ রাজনৈতিক ব্যবস্থায় অবদমিত বোধ করে, তখন তারা পড়ষষবপঃরাব পড়হঃবহঃরড়ঁং ঢ়ড়ষরঃরপং–এর মাধ্যমে পরিবর্তনের দাবি তোলে। ঈধংঃবষষং (২০১২) দেখান, আধুনিক নাগরিক আন্দোলন গড়ে ওঠে মানুষের অভিজ্ঞ বেদনা ও ন্যায়বোধের উপর ভিত্তি করে। কাব্যিক ভাষায় উচ্চারিতÑ“জেগে ওঠো, রাস্তায় নামো, শপথ নাও!”Ñএই আহ্বান তাই সামাজিক প্রতিরোধের তাত্ত্বিক কাঠামোর সাথে সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসও গণতান্ত্রিক প্রতিরোধে সমৃদ্ধÑভাষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ, ৯০-এর গণ-আন্দোলনÑসবই নাগরিক শক্তির জাগরণের বহিঃপ্রকাশ।

সহিংসতার ধারাবাহিকতা সমাজে এমন এক পরিবেশ সৃষ্টি করে যেখানেÑচেনা পথ অপরিচিতের মতো, আকাশ লাল ধুলোয় ঢেকে যায়, রাস্তায় রক্ত, ঘরে অশ্রু আর ভবিষ্যতের আলো নিভে যেতে থাকে। গবেষণায় দেখা যায়, রাজনৈতিক আধিপত্যবাদের প্রতিযোগিতা, দলীয় সংঘর্ষ এবং দারিদ্র্য বাংলাদেশে সহিংসতা বৃদ্ধির মূল চালক (অসরহ, ২০২১)। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (টঘউচ, ২০২২) জানায়, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার শর্ত হলোÑআইনের শাসন, সামাজিক সংহতি, ও নাগরিক স্বাধীনতার নিশ্চয়তা। এই তিনটি শর্ত যখন দুর্বল হয়, তখন সমাজ স্বাভাবিকভাবেই সহিংসতার দিকে ধাবিত হয়।

“অন্যায়ের দেয়াল ভেঙে ফেলো”Ñএই কাব্যিক আহ্বান গণতান্ত্রিক রূপান্তরের নৈতিক ভাষা। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের গবেষণা (ঐড়ংংধরহ, ২০১৭) দেখায়, ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা দূর না হলে জনগণ শান্তিপূর্ণ প্রতিরোধের মাধ্যমে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করে। বাংলাদেশের মানুষ কখনো সহিংসতার পক্ষে নয়; তারা চায়Ñশান্তি, ন্যায়, মর্যাদা, নিরাপত্তা, ও মানবিকতার পরিবেশ।জনতার কণ্ঠ যখন ফেটে বেরোয়, তা ধ্বংসের নয়Ñবরং অন্যায় ভেঙে ন্যায় প্রতিষ্ঠার শক্তি। এই শক্তিই ইতিহাসকে সামনে এগিয়ে দেয়।

এ পথ কি রক্তে হঁাটার?Ñএই প্রশ্ন শুধু একটি কাব্যিক আবেগ নয়; এটি বাংলাদেশের বর্তমান সমাজ রাজনৈতিক সংকটের গভীরতম প্রতিফলন। সহিংসতা কোনো জাতির নিয়তি হতে পারে না। শান্তি, ন্যায়, সংহতি ও মানবিকতাই একটি জাতিকে অগ্রগতির পথে নিয়ে যায়। অতএব, উত্তরণের পথ নিহিতÑরাষ্ট্রের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারে, সমাজের মানবিক সংহতি গঠনে,নাগরিকের নৈতিক সাহস ও প্রতিরোধচেতনায়। বাংলা আবার জেগে উঠবেÑএই বিশ্বাসই আমাদের শক্তি। অন্যায়ের দেয়াল ভাঙবে, ভয়ের প্রাচীর চূর্ণ হবে, আর নতুন প্রভাতের আলো বাংলার আকাশে ন্যায়ের পথ দেখাবে।

সুধীর বরণ মাঝি : শিক্ষক, হাইমচর সরকারি মহাবিদ্যালয়, হাইমচর, চঁাদপুর।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়