শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৫
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:২২

ধারাবাহিক উপন্যাস-১৯

নিকুঞ্জ নিকেতন

রাজীব কুমার দাস
নিকুঞ্জ নিকেতন

(পূর্ব প্রকাশের পর)

১২.

বাংলাদেশ থেকে এসে দিনগুলো ভালো কাটছে না, মন বসছে না কোনোকিছুতে। কেমন যেন একটা পিছুটান কাজ করে আর তাতেই বাড়ে অস্থিরতা। এ দেশটা আমার আপন না হলেও এখানকার পরিবেশ, জনজীবন আর সুযোগ-সুবিধায় এতটাই অভ্যস্ত হয়ে উঠি যে চাইলেও সহজে দেশে যেতে মন চায় না আবার যখন দেশে ফিরি তখন আপনজনদের আগ্রহ, ভালোবাসা আর আন্তরিকতা দেখলে মন এতটা আবেগী হয়ে ওঠে যে আপনজনদের ফেলে এসে এখানে অপরিচিতদের মাঝে স্বার্থান্বেষী হয়ে থাকতেও মন চায় না। গন্ডিটা আমার বেশ ছোট আর এই ছোট্ট গন্ডিতে রয়েছে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ, পছন্দের কিছু জড় পদার্থ, কিছু স্থান আর সবচেয়ে ভরসার ও আপন করে নেওয়া দুটো মানুষ যার একজন বাপি আর অন্যজন বিশাখা। মা মারা যাওয়ার পর থেকে বাপি আমার মা-বাবা দুটোই। অনেককেই বলতে শুনেছি বাবা আর ছেলে কখনো বন্ধু হতে পারে না। কথাটা আমাদের বেলায় ভুল। বাবা আমাকে কোলেপিঠে করে মানুষ তো করেছেন কিন্তু আমার প্রতিটি বিষয়ের সাথে উনি রয়েছেন জড়িয়ে। ছেলেরা বাবার কাছে অনেক কিছুই লুকিয়ে থাকে অথচ চাইলেও সেটা পারিনি উনার ভালোবাসার জন্য। আমার প্রতিটি বিষয়কে তিনি সবসময়ই প্রাধান্য দিয়েছেন শুধু দেশ ত্যাগের বিষয়টা ছাড়া। আমি জানি সেটা উনার অগাধ ভালোবাসা, একটা বন্ধন যা আমাকে সারাজীবনই বেঁধে রেখেছিল। আমি মায়ের মমতা কখনো অনুভব করিনি কারণ বাপি সেই জায়গাটাকে পূরণ করতে মরিয়া ছিল। তাছাড়া আমাদের দুজন ব্যতিত সংসারে আর তেমন কেউ তো ছিল না। সেদিন বাবা দিবসে এক সেমিনারে বেশ কিছু ভিনদেশী এখানে বাবা সম্পর্কে তাদের বক্তব্যে নিজ নিজ মতবাদ ব্যক্ত করেছিলেন। কেউ বাবার প্রতি ভালোবাসার পাশাপাশি অভিযোগ তুলে ধরেন আবার কেউ বাবার প্রতি তাদের ভালোবাসা সংখ্যায় বিশ্লেষণ করেছিলেন। আমার যখন বক্তব্য পেশ করার সুযোগ হয় তখন একটা বাক্যই বলেছিলামÑ বাবা-মায়ের ভালোবাসা কখনো পরিমাপ করা যায় না, কোনো কিছুর সাথে তুলনা হয় না, বিশ্লেষণ করা যায় না। উনারা শ্রেষ্ঠত্বের উর্দ্ধে সর্বশ্রেষ্ঠ। একজন ব্যক্তি তার জীবনে ভালো-মন্দ হতে পারে কিন্তু সে ব্যক্তির মাঝে বাবা-মা কখনো মন্দ হতে পারে না। আমি অদৃশ্য ঈশ্বরকে কখনো দেখিনি কিন্তু তার পরিবর্তে এ পৃথিবীতে বাবাকে দেখেছি। সেদিন বলেছিলাম কম কিন্তু শুনেছিল প্রত্যেকে। কথাগুলো শেষ করার সাথে সাথে সকলে দাঁড়িয়ে কড়তালিতে সাধুবাদ জানিয়েছিল আর তখন নিজের জন্য নিজেই গর্ব বোধ করেছিলাম। আমার পৃথিবীর আরেকটি মানুষ বিশাখা যার কাছে আমি একটা খোলা ডায়েরি। যাকে ভরসা করতে পারি, সকল অনুভূতিগুলো বলতে পারি। সেই ছোটবেলা থেকে আজও সে আমার ভরসার স্থান। তার কাছ থেকে দূরে এসে বুঝতে পেরেছি আমাদের একসাথে বেড়ে ওঠার মাঝে একটা বন্ধন গড়ে উঠেছে যা কখনো প্রকাশ করা হয়নি। এ বন্ধন এতটাই দৃঢ় যে দূরে থেকেও তার অনুভব ফিকে হয়নি কভুও। আমাদের প্রায়ই কথা হয় একে অপরে আর এটাও বুঝতে পারি কিছু একটা বলার ছিল যা বলা হয়নি কিন্তু কী সেটা জানা নেই। আমার জীবনের এই দুটো মানুষের গুরুত্ব এত বেশি যে কোনো একটাকে বাদ দিলে আমি থেকে যাই অসম্পূর্ণ। বাড়ির কথা বেশ মনে পড়ছে আজ, বাপির সাথে একটাবার কথা বলা প্রয়োজন মনটা কেমন যেন ভার-ভার লাগছে।

‘হ্যালো ... নমষ্কার বাপি, কেমন আছ তুমি?’

‘এইতো আছি বেশ তা তুমি এই অবেলায় ফোন দিলে! তোমার তো এখন অফিসে থাকার কথা। শরীর ঠিক আছে তো?’

‘আমি ঠিক আছি বাপি তোমার টেনশন করার প্রয়োজন নেই। আজ মনটা ভালো নেই তাই অফিসে নক দিয়ে ছুটি নিয়েছি। তোমার কথা বেশ মনে পড়ছে। এত শোরগোল কেন, কোথায় তুমি?’

‘কক্সবাজার।’

‘আরে বল কী এই সময় তুমি কক্সবাজারে কাটাচ্ছ? তা তোমার সাথে কে আছে?’

‘আমরা চার বন্ধু মিলে প্ল্যান করে আজ চলে এসেছি। তোমার পিটার আংকেল কখনো সমুদ্র দেখেনি তাই সবাই মিলে নিয়ে এলাম ।’

‘বাহ্ বেশ তো! আমি তোমার টেনশনে থাকি সারাক্ষণ আর তুমি আছ বেহাল তবিয়তে। তা প্ল্যান কত দিনের?’

‘পাঁচ দিনের হিসেব করে এসেছি ভালো লাগলে আরও কয়েক দিন এক্সটেনশন করতে পারি।’

‘তোমার খাওয়া-দাওয়া আর ওষুধপত্র নেওয়া হচ্ছে তো ঠিকমতো।’

‘তুমি সেগুলো নিয়ে টেনশন করবে না। আমরা নিজের মতো করে বাঁচতে শিখে গেছি। তাই আমাদের আর কোনো চিন্তা নেই বুঝলে।’

‘এগুলো বইয়ের পাতায় মানায় বাপি বাস্তবতা সেটা নয়।’

‘না শুধু বইয়ের পাতায় নয় আমাদের বাস্তবিক জীবনেও সেটা মানায়। তুমি বুঝবে না এখনো এ বয়সটায় আসনি তাই এমনটা ভাবতে পার। বেঁচে থাকতে হলে বাঁচার ইচ্ছেটাকে জাগিয়ে রাখতে হয় মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তবেই জীবনের শেষটুকু অভিশাপ মনে হবে না কভুও বুঝলে।’

‘তুমি ভালো থাক এটাই সর্বসময় কামনা করি আর ভালো আছ কথাটা শুনে প্রাণ ফিরে পেলাম। খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতো করবে আর ওষুধগুলো ঠিকঠাক নিও। তোমার টাকা-পয়সার সমস্যা নেই তো! হলে জানিও আমি সেখানে টাকা ট্রান্সফার করে দিতে পারব মুহূর্তেই।’

‘ধন্যবাদ বলার জন্য, তবে আশাকরি প্রয়োজন পড়বে না তারপর যদি সমস্যা হয় তখন না হয় বলব।’

‘বাপি একটা কথা বলি?’

‘কী কথা বল।’

‘আমি দেশের বাইরে আসার জন্য তোমার মতের বিপক্ষে গিয়েছি। তুমি কী আমায় ক্ষমা করতে পেরেছ?’

‘হা হা হা... তোমার কী মনে হয় তুমি অন্যায় করেছ কোনো? আমরা প্রত্যেকে যার যার জায়গায় সঠিক ছিলাম। তোমার প্রতি আমার মায়ার বাঁধনটা ছিল প্রবল আর সেজন্যই হয়তো আগলে রাখার চেষ্টা ছিল কিন্তু জীবনটা তোমারও তাই ভালো-মন্দ বিবেচনা করার অধিকার তোমার আছে। এখানে কিছুই ভুল নেই।’

‘তারপরও বাপি কিছু হয়তো থেকে যায়। আমি একটা স্বার্থপরের মতোই তোমায় ফেলে চলে এসেছি জীবন গড়তে। হয়তো আরেকটু ভাবার প্রয়োজন ছিল।’

‘যদি স্বার্থপরতা বলছ তাহলে আমরা দুজনেই

এমন। আমিও আমার অসহায়ত্বের জন্য তোমায় আগলে রাখতে চেষ্টা করছি হয়তো। দেখ রাজীব আজ কিছু বিষয় তোমার সাথে শেয়ার করি যা আগে কখনো করিনি। আমি আমার জীবনে অনেক কিছুই হারিয়েছি। বাপ-দাদার সম্পদ আছে বলেই মাথা উপরে একটা ছাঁদ আর পাঁয়ের তলায় জমি রয়েছে। চাকরি করে হয়তো তোমাদের বিলাসী জীবন দিতে পারিনি আবার সময়ের আগেই তোমার মায়ের মৃত্যু আমাকে এক অসহায়ত্বের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। পরিবার পরিজন, আত্মীয় সকলেই যার যেমন আছে শুধু আমিই একা। তুমি ছাড়া এ জীবনটায় আর কেহ ছিল না আমার তাই তোমার দূরে চলে যাওয়ার বিষয়ে পুনরায় অসহায় হয়ে উঠি। আমার কাছে যে হারানোর আজ কিছুই নেই। চাকরি জীবনের সততা বাদে আমার আর কোনো অর্জনও তো নেই। ঈশ্বর হয়তো এজন্যই আরও কয়েকজন জুড়ে দিয়েছে আমার মতো, এখন তাদের সাথেই পথচলা। মানুষ কখনো একা থাকতে পারে না এটা তুমি চলে যাওয়ার পর খুব ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলাম।’

‘তুমি ক্ষমা করেছ এটা জানতে পারলে নিজেকে অপরাধী ভাবতে হতো না।’

‘হা হা হা...আবারও একই কথা। কেন অপরাধী ভাববে? একজন সাধারণ মানুষের মতো তোমার আকাক্সক্ষা থাকা অস্বাভাবিক না। যেখানে ভুল নেই সেখানে অপরাধবোধ কীসের আর কেনই বা ক্ষমা চাওয়া। আমার ছেলের উপর অগাধ বিশ্বাস আছে যে সে কখনো ভুল সিদ্ধান্ত নিবে না। আমি তোমাকে বাস্তবিক হতে শিখিয়েছি। আশা করব আমাদের এ বিষয়ে আর কোনো কথা থাকবে না আগামীতে।’

‘তুমি ভালো থেক বাপি আর নিজের দিকে খেয়াল রেখ।’

‘তুমিও ভালো থেক আর নিজের প্রতি যত্ন নিও। আরেকটা কথাÑতোমার বাপি বাঁচতে জানে তাই আমাকে নিয়ে অযথা টেনশন করে লাভ নেই। আমি ভালো আছি আর ভালো থাকার চেষ্টাও করি।’

বুঝতে পারছি বাপির অভিমানটা আজও কমেনি। উনার কাছে আমার ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টা নিছক একজন ভদ্রলোকের মতো কত সহজে এড়িয়ে গেলেন আর কথার মারপ্যাঁচে বুঝিয়ে দিলেন ক্ষমা চাওয়ার মতো আমার কোনো ভুল হয়নি। আজকে কথা বলায় স্পষ্ট হয়েছি আমার বাবার কাছে আমি অপরাধী। জীবনটা হয়তো এমন থাকত না আরেকটু কম ভালো হতো তাহলে কী হতো? নিজের মধ্যে একটা অপরাধবোধ কাজ করত না। আমার বাবা একজন সৎ মানুষ আর এজন্য আমার গর্ববোধ হয় আবার এটাও ভাবি যেখানে সততার কোনো মূল্য নেই সেখানে সৎ থাকাটাও একটা অভিশাপ। প্রতিনিয়ত সামনের ব্যক্তিটার সাথে যুদ্ধ করতে হয় সততার জন্য। আমাদের সমাজ ব্যবস্থাটা এমনভাবে গড়ে উঠেছে যে একজন সৎ মানুষকে চরম মূল্য দিতে হয় তার জীবনে। বাপির সততার জন্য আমার ছেলেবেলার অনেক ইচ্ছে, অনেক স্বপ্নই অসম্পূর্ণ থেকেছে যেখানে চাইলেও সুযোগ ছিল না পূরণ করার আর সেজন্যই আমাকে তার চেয়ে উন্নত জীবনধারার কথা ভাবতে হয়েছিল। আমাকে নিয়েই যার পৃথিবী সেখানে এমন সিদ্ধান্তে তার পৃথিবীটা হয়েছিল শূন্য আর সেজন্যই হয়তো আমায় ক্ষমা করতে পারছেন না তিনি। শুনেছি সময় অনেক বড় বড় সমস্যাকে সমাধান করে দেয় আমাকে এখন সেই অপেক্ষায়ই থাকতে হবে।

[পরের পর্ব আগামী সংখ্যায় প্রকাশিত হবে]

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়