প্রকাশ : ১২ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৭:৫৮
হারানো রবিন

রবিন গ্রামের অন্য দশটা ছেলের মতোই এক সাধারণ কিশোর। বয়স মাত্র চৌদ্দ। ছোট্ট গ্রামে তার জীবন ছিল সীমিত গণ্ডির মাঝে। কিছু বন্ধুর সাথে স্কুলে যাওয়া, মাঠে খেলা। এসবেই অভ্যস্ত ছিলো সে। কিন্তু একদিন রাতে হঠাৎ সে হারিয়ে যায়। তার বাবা মা এবং প্রতিবেশীরা তাকে খুঁজে বেড়ায়, নদীর ধারে, বাজারে, বনপথে- কোথাও তাকে পাওয়া যায় না। দিন যায়, রাত যায়, রবিনের খেঁাজ আর মেলে না।
একদিন ভোরে টেকনাফের সমুদ্র সৈকতে ঢেউয়ের গর্জনের মাঝে দেখা যায় তাকে। বালুর ওপর অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে। তার চোখে ভয়, শরীরে ক্লান্তির ছাপ।
ইমতিয়াজ নামের স্থানীয় এক যুবক শিক্ষক সকালে সৈকতের ধার দিয়ে হঁাটছিলেন। তিনি রবিনকে এই অবস্থায় দেখে থমকে ঘুরে দঁাড়ালেন।
‘এই ছেলে! তুমি এখানে কীভাবে আসলে?’
রবিন দুর্বল কণ্ঠে বললো, ‘আমি জানি না। তবে আমি হারিয়ে গেছি। কিছু লোক আমাকে ধরে এনে সাগরে ফেলে দিয়েছিলো। সম্ভবত ঢেউয়ের ধাক্কা আমাকে পাড়ে এনে ফেলেছে।’
ইমতিয়াজ তাকে বালি থেকে টেনে তুললেন, তারপর তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে গেলেন। খাবার দিলেন, বিশ্রাম দিলেন। ধীরে ধীরে রবিন সুস্থ হলো। ইমতিয়াজের স্ত্রী মধুমিতাও তাকে পেয়ে খুশি হলো, বুকে জড়িয়ে নিলো।
ইমতিয়াজ তাকে স্কুলে ভর্তি করালেন। পড়াশোনা, খেলাধুলা, নতুন বন্ধু সবকিছুতে রবিন আবার প্রাণ ফিরে পেল।
কিন্তু ইমতিয়াজের জীবন সাধারণ ছিলো না। তিনি আসলে একজন গোপন স্পাই ছিলেন। সীমান্ত এলাকায় মাদক ও অস্ত্র চোরাচালান চক্রের বিরুদ্ধে কাজ করছিলেন। গোপনে ঢাকায় পুলিশের হেড কোয়ার্টারে মাদক কারবারীদের খবরাখবর পেঁৗছে দিতেন।
রবিন এসব কিছুই জানতো না। তবে মাঝে মাঝে সে লক্ষ্য করত ইমতিয়াজ রাতে কারও সাথে ফোনে কথা বলেন, মাঝে মাঝে কারও সঙ্গে গোপনে দেখা করেন।
একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে রবিনকে অনুসরণ করতে থাকে কিছু অচেনা লোক। তাদের নেতা জামশেদ।
রাতের অন্ধকারে রবিনকে ধরে নিয়ে যায় জামশেদের দল। তারা বলে, ‘এই ছেলেটা ইমতিয়াজের ছেলে। ওকে ধরে রাখো। ইমতিয়াজকে চাপ দিতে কাজে লাগবে।’
রবিন ভয় পায়। সে চিৎকার করে, কিন্তু চারপাশে শুধু অন্ধকার আর বন্দুকধারী লোক।
ইমতিয়াজ খবর পান। তিনি ভাবেন, রবিন তার ছেলে নয়। কিন্তু তাকে বঁাচাতে হবে। ইমতিয়াজ অনেক খেঁাজাখুঁজি করতে থাকে, রবিনকে পায় না। একদিন জামশেদ বার্তা পাঠায়, ‘তোমার গোপন তথ্য আমাদের দাও, না হলে ছেলেটিকে মেরে ফেলব।’
ইমতিয়াজ দ্বিধায় পড়েন। তার দায়িত্ব স্পাই হিসেবে দেশের নিরাপত্তা, কিন্তু রবিনও তার দায়িত্ব হয়ে গেছে।
এই খবর পেয়ে ইরফান নামের ইমতিয়াজের পুরনো এক সহকর্মী টেকনাফে আসে। ইরফান ছিলো অভিজ্ঞ, সাহসী এবং বুদ্ধিমান। দেশ বিদেশে মাফিয়াদের বিরুদ্ধে কাজ করে সুনাম অর্জন করেছে।
সে বলে, ‘ইমতিয়াজ, আমি জানি তুমি সমস্যায় আছো। রবিনকে আমি উদ্ধার করব। তুমি টেনশন করো না।’
একদিন ইরফান কৌশলে জামশেদের আস্তানার খবর বের করে সেখানে প্রবেশ করে। পাহাড়ি বন, অন্ধকার গুহা, নদীর ধারে লুকানো ঘঁাটি- সব জায়গায় তাকে লড়াই করতে হয়। এ সময় জামশেদের গুন্ডাদের সঙ্গে হাতাহাতি শুরু হয়। তারপর রবিনকে নিয়ে গোপন পথ দিয়ে পালানোর পরিকল্পনা করে। কিন্তু জামশেদ বাহিনী নাফ নদীর ধারে তাদেরকে তাড়া করে। রবিনও ভেতর থেকে সাহস দেখায়। সে ইরফানকে সাহায্য করে পালানোর সুযোগ তৈরি করে।
কিন্তু রবিন বলে, ‘আঙ্কেল ওরা পেছনে পেছনে আসছে, আমি ভয় পাচ্ছি।’
ইরফান সাহস দেয়, ‘রবিন তুমি ভয় পেও না। তুমি শক্তিশালী। আমরা একসাথে বের হবো।’ একথা বলেই দু’জন গোপন পথ দিয়ে অনেক কষ্টে পালিয়ে আসে।
ইরফান রবিনকে উদ্ধার করে ইমতিয়াজের বাড়িতে পেঁৗছে দেয়। ইমতিয়াজ ও ইমতিয়াজের স্ত্রী মধুমিতা তাকে পেয়ে খুবই খুশি হয়, কারণ তাদের কোনো সন্তান ছিলো না। রবিনই তাদের সন্তানের মতো।
কিছুদিনের মধ্যে জামশেদ ও তার দল পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। তারপর তাদেরকে কারাগারে নিক্ষেপ করে।
রবিন প্রতিজ্ঞা করে, সে পড়াশোনা করবে, শক্তিশালী হবে, আর একদিন ইমতিয়াজ ও ইরফানের মতো অন্যায়ের বিরুদ্ধে দঁাড়াবে।
একদিন রবিন পত্রিকায় দেখে তার ছবি দিয়ে নিখেঁাজ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। নিচে তার বাবার মোবাইল নাম্বারও দেওয়া হয়েছে। সে ওই নাম্বারে কল করে। তার বাবা কল রিসিভ করে বলে, ‘হ্যালো কে?’
রবিন কোনো কথা বলে না। সে ভাবতে থাকে তাদের বাড়িতে যাওয়ার চেয়ে ইমতিয়াজ ও মধুমিতার কাছে থাকাই ভালো। কারণ ওরা তার আসল বাবা মায়ের চেয়ে বেশি যত্ন করে।
রাতে ইমতিয়াজ এলে তাকে সব ঘটনা খুলে বলে। এ সময় মধুমিতাও বিষয়টি শুনে ফেলে। তখন মধুমিতা বলে, ‘বাবা রবিন, আমার মনে হয় তোমার আসল পিতামাতার সাথে দেখা করা উচিত, উনারাও তো চিন্তায় আছেন।’
‘হ্যঁা, ঠিক আছে। তুমি আমাদের কাছে থাকতে চাইলে থাকতে পারবে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু তাদের সাথেও তোমার দেখা করা দরকার, কারণ তারাই তো তোমাকে লালনপালন করে একটুকু বড় করে তুলেছেন।
রবিন রাজি হলো। একদিন ইমতিয়াজ মধুমিতা রবিনকে নিয়ে তার আসল পিতামাতার সাথে দেখা করলো। তার পিতামাতা তাকে দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। রবিন বাবামায়ের চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো, ‘তোমরা চিন্তা করো না মা, আমি ওনাদের কাছে ভালোই থাকবে, ওনারা আমাকে ভালো স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে, ভালো ভালো খাবার দিচ্ছে, আদর যত্ন করছে। ওনাদের তো কোনো ছেলেমেয়ে নেই। তোমাদের তো আরও ছেলেমেয়ে আছে।’
রবিনের মা তাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। এ সময় ইমতিয়াজ বললো, ‘দুঃখ করবেন না, ও আমাদের কাছে ভালোই থাকবে। যদি আপনারা অনুমতি দেন।’
রবিনের বাবা বললো, ‘তোমাদের যেহেতু কোনো ছেলেমেয়ে নেই, আর রবিনও যেহেতু তোমাদেরকে ভালোবেসে ফেলেছে সেহেতু আমার কোনো আপত্তি নেই, আমাদের ছেলেটা ভালো থাকলেই হলো।’
মধুমিতার মুখে হাসি ফুটলো। তার সে রবিনের মাকে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘রবিন সব সময় আপনাদের সাথে যোগাযোগ রাখবে, বেড়াতে আসবে। আমাদের কাছে ছেলের মতো হয়ে থাকলে আপত্তি নেই তো?’
‘না মা। আপত্তি নেই। আমরা চাই আমাদের ছেলে তোমাদের কাছে থেকে মানুষের মতো মানুষ হোক।’
রবিনের মুখে হাসি ফুটে উঠলো আর ওদিকে ইমতিয়াজও খুশি হলো। তার চোখে আনন্দের অশ্রু।
এ সময় ইরফান এলো। সবার মিলন দৃশ্য দেখে বললো, ‘পৃথিবীটা বড়ই অদ্ভুত। চারা গাছ একস্থানে গজায়, আর তার ভাগ্য তাকে অন্য স্থানে নিয়ে বড় করে, এটাই হয়তো আল্লাহর মর্জি। তবে রবিন ছেলেটা বুদ্ধিমান, যেমন তার পিতামাতা।’
সবাই ইরফানের কথায় হেসে উঠলো।







