প্রকাশ : ০৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:১৬
হিন্দি সাহিত্যে প্রবীণ জীবন

হিন্দি সাহিত্যে প্রবীণ জীবনকে নানা দিক থেকে উপস্থাপন করা হয়েছে—
|আরো খবর
কখনো বার্ধক্য মানে নিঃসঙ্গতা ও অবহেলা,
কখনো প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার,
আবার কখনো পারিবারিক দায়িত্ব ও আত্মত্যাগের প্রতীক।
আমি নিচে পাঁচটি উপন্যাস, পাঁচটি গল্প ও পাঁচজন কবির কবিতা উল্লেখ করছি, যেখানে প্রবীণ জীবনের গুরুত্বপূর্ণ চিত্র ফুটে উঠেছে।
হিন্দি উপন্যাসে প্রবীণ জীবন (৫টি)
১. গোদান–মুনশি প্রেমচন্দ :
হোরিহরি চরিত্রের মধ্যে বার্ধক্যের ক্লান্তি, দারিদ্র্য ও সামাজিক অবিচারের চিত্র স্পষ্ট। প্রবীণ কৃষকের সংগ্রাম উপন্যাসকে মানবিক গভীরতা দিয়েছে। গোদান উপন্যাসে প্রবীণ চরিত্র হোরিহরি মাহতো
উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র। একজন প্রবীণ কৃষক, বয়সের ভারে নুয়ে পড়লেও জমি, গরু আর সংসারের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে বেঁচে আছেন।
তিনি দারিদ্র্য, সামাজিক অবিচার এবং জমিদার-মহাজনের শোষণে ক্লান্ত।
বার্ধক্যের কারণে শরীর দুর্বল, তবুও হাল ছাড়েন না—পরিশ্রম করে সংসার টেনে নেন। তার সবচেয়ে বড়ো স্বপ্ন ছিলো মৃত্যুর আগে গরু দান করা (হিন্দু ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী মুক্তির পথ), কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই স্বপ্নও অপূর্ণ থেকে যায়। হোরিহোর চরিত্রে বার্ধক্যের ক্লান্তি, অসহায়ত্ব এবং একইসাথে সহিষ্ণুতা ফুটে উঠেছে। তিনি শুধু ব্যক্তিগত প্রবীণ চরিত্র নন, বরং ভারতীয় গ্রামীণ কৃষকের প্রতীক।
ধনিয়া–হোরির স্ত্রী
প্রবীণ নারীর চরিত্র, যিনি স্বামীর মতোই জীবনের ভার বইতে থাকেন।
সংসারের প্রতি অগাধ ভালোবাসা, সহমর্মিতা ও আত্মত্যাগ তার জীবনে প্রবল। তিনি প্রবীণ বয়সেও মানসিকভাবে শক্ত, স্বামীকে সামলে রাখেন। বার্ধক্য সত্ত্বেও তাঁর মমতা ও সংগ্রামী চেতনা পরিবারের স্তম্ভ হয়ে দাঁড়ায়। ধনিয়া চরিত্রে প্রবীণ নারীর সহিষ্ণুতা, সংসার রক্ষার দৃঢ়তা এবং অভিজ্ঞতার জ্ঞান প্রতিফলিত।
সমাজের প্রবীণ মহাজন ও জমিদাররা
বার্ধক্যে এসেও শোষণ ও লোভ ছাড়তে পারেনি।
প্রবীণ বয়স এখানে প্রজ্ঞার প্রতীক নয়, বরং লোভ ও অন্যায়ের প্রতীক।
প্রেমচন্দ দেখিয়েছেন যে, সব প্রবীণ চরিত্র সমান নয়—কারো বয়স অভিজ্ঞতা ও মানবিকতার আলো ছড়ায়, আবার কারো বয়স লোভ-অভ্যাসকে আরও শক্ত করে।
২. গবানুমুনশি প্রেমচন্দ :
এ উপন্যাসে প্রবীণ বয়সে আত্মসম্মান, পরিবার রক্ষা ও সামাজিক মর্যাদার সংগ্রাম দেখিয়েছেন।
৩. মাইলস্টোন– অমৃতলাল নাগর :
প্রবীণ চরিত্ররা সমাজ-পরিবারের পরিবর্তনের মধ্যে কীভাবে নিজের স্থান খুঁজে পায় তা তুলে ধরা হয়েছে। এখানে প্রবীণ চরিত্ররা মাইলস্টোন বা মাইলফলকের মতো—যারা অতীত অভিজ্ঞতার প্রতীক হয়ে নতুন প্রজন্মকে দিকনির্দেশনা দেয়, কিন্তু নিজেরা সামনে এগোয় না।
৪. রাগ দরবাড়ি – শ্রীলাল শুক্ল :
গ্রামীণ সমাজে প্রবীণ রাজনৈতিক নেতাদের ক্ষমতা, অভিজ্ঞতা ও দুর্নীতি সমানভাবে দেখানো হয়েছে।
এটি স্বাধীনতোত্তর ভারতের গ্রামীণ সমাজ ও রাজনীতির ব্যঙ্গচিত্র।
শোষণ, দুর্নীতি, শিক্ষা ও রাজনীতির জটিল খেলাকে এখানে তুলে ধরা হয়েছে। প্রবীণ চরিত্ররা সমাজের নৈতিক অবক্ষয় ও অভিজ্ঞতার ধারক—তারা কখনো হাস্যকর, কখনো শোষক, আবার কখনো সমাজের অবিচারের প্রতীক। বাদশাহ সিং
গ্রামে প্রভাবশালী এক প্রবীণ নেতা। বয়সের কারণে অভিজ্ঞ, কিন্তু সেই অভিজ্ঞতা ব্যবহার করেন ক্ষমতা ধরে রাখা ও দুর্নীতি চালিয়ে যাওয়ার জন্যে। তিনি সমাজে প্রবীণ বয়সের মর্যাদাকে শোষণের হাতিয়ার বানিয়েছেন। বাদশাহ সিং প্রবীণ বয়সের এক নেতিবাচক দিক—লোভ, ক্ষমতালিপ্সা ও প্রজন্মকে ভুল পথে চালানো।
প্রবীণ শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবী চরিত্র
স্কুল ও কলেজের কিছু প্রবীণ শিক্ষক সমাজের অবক্ষয়ের সামনে অসহায়। তারা শিক্ষার নামে রাজনীতির খেলায় জড়িয়ে পড়েন। প্রবীণ বয়সে এসে তাদের নৈতিকতা দুর্বল হয়ে যায়।
এরা প্রবীণ বয়সের নৈতিক ভঙ্গুরতা ও সমাজের ব্যর্থ দিশারী।
প্রবীণ গ্রামীণ চরিত্ররা
গ্রামীণ জনজীবনের প্রবীণরা অতীতের গল্প ও রীতিনীতি আঁকড়ে ধরেন।
তারা নতুন প্রজন্মের দুর্নীতি ও রাজনৈতিক খেলায় হতাশ। অনেক সময় তারা হাস্যরসের উপকরণ হয়ে উঠেন।
এদের মাধ্যমে লেখক দেখিয়েছেন, প্রবীণ বয়স মানে শুধু প্রজ্ঞা নয়, বরং অসহায়ত্ব, হাস্যকর অবস্থান এবং পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মেলাতে না পারা।
৫. ঝুঁকি (ঔযঁশর ঐঁর অঁৎধঃ)– মন্নু ভান্ডারী :
এতে রয়েছে প্রবীণ নারীর একাকিত্ব ও সমাজে অবহেলার কাহিনি।
‘ঝুঁকি’ তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস, যেখানে ভারত বিভাজন (১৯৪৭)-এর ভয়াবহতা, পরিবার ও ব্যক্তিজীবনের টানাপোড়েন এবং মধ্যবিত্ত সমাজের সংগ্রাম ফুটে উঠেছে। এখানে প্রবীণ চরিত্ররা অভিজ্ঞতা, শিকড়ের টান ও মানসিক সংগ্রামের প্রতীক হয়ে উঠেছেন।
প্রবীণ চরিত্র বিশ্লেষণ--
শকুন্তলার পিতা :
একজন প্রবীণ, অভিজ্ঞ মানুষ, যিনি পরিবারকে একত্রে রাখার চেষ্টা করেন। তিনি অতীতের মূল্যবোধ আঁকড়ে থাকেন, কিন্তু বিভাজন-পরবর্তী পরিস্থিতি তাঁকে অসহায় করে ফেলে। এই চরিত্র দেখায় প্রবীণ বয়সে মানুষ অভিজ্ঞ হলেও সামাজিক বিপর্যয়ের সামনে কতোটা অসহায় ও দিশেহারা হয়ে পড়ে।
প্রবীণ মা চরিত্র :
মা পরিবারে আবেগ ও মমতার কেন্দ্রবিন্দু।
বয়সের ভারে ক্লান্ত হলেও তিনি সন্তানদের রক্ষাকবচ হতে চান। কিন্তু বিভাজনের অমানবিক পরিস্থিতিতে তাঁর ভূমিকা সীমিত হয়ে যায়।
এখানে প্রবীণ বয়সকে দেখানো হয়েছে ত্যাগ, সহমর্মিতা ও মানসিক শক্তির প্রতীক হিসেবে।মহল্লা ও আশপাশের কিছু প্রবীণ মানুষ বিভাজনের সহিংসতায় পথ হারান।
তারা অতীতের শান্তিপূর্ণ সমাজের কথা স্মরণ করেন, আর বর্তমানের বিভেদ মেনে নিতে পারেন না। প্রবীণ বয়স এখানে ঐতিহ্য, স্মৃতি ও মানবিকতার রক্ষক হিসেবে প্রতিভাত।
লেখিকা বার্ধক্যকে কেবল শারীরিক নয়, বরং মানসিক ও সামাজিক দিক থেকেও দেখিয়েছেন।
প্রবীণ চরিত্ররা ‘মূল্যবোধ’ ও ‘অতীতের অভিজ্ঞতা’-এর ধারক, কিন্তু নতুন প্রজন্মের ভোগবাদী মানসিকতার কাছে তারা পরাজিত।
হিন্দি ছোটগল্পে প্রবীণ জীবন (৫টি)
১. বুড়ি কাকি–মুনশি প্রেমচন্দ :
এক বৃদ্ধা আত্মীয়দের অবহেলার শিকার হলেও শেষ মুহূর্তে ভালোবাসা পায়। প্রবীণ জীবনের নিঃসঙ্গতা ও মানবিক আবেগের চমৎকার চিত্র।
২. পঞ্চপরমেশ্বর–মুনশি প্রেমচন্দ :
প্রবীণ বিচারকের প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতা ও ন্যায়বিচার তুলে ধরা হয়েছে।
৩. বুড়ি মা–জয়শংকর প্রসাদ :
মায়ের প্রবীণ বয়সে সন্তানের প্রতি নির্ভরশীলতা ও একাকিত্বের প্রতিফলন।
৪. দূরদৃষ্টি–মহাদেবী বর্মা : বার্ধক্যে একজন নারীর স্মৃতি, বেদনা ও পরিবারের প্রতি দায়বদ্ধতার কাহিনি।
৫. বুড়ি কাকিমা– অমরকান্ত :
সামাজিক অবহেলায় বৃদ্ধাদের কষ্ট ও নিঃসঙ্গতার জীবন্ত বর্ণনা।
হিন্দি কবিতায় প্রবীণ জীবনকে কীভাবে তুলে ধরা হয়েছে তা নিচের পাঁচজন কবির কবিতায় দেখানো হয়েছে--
১. নিরালা (সূর্যকান্ত ত্রিপাঠী)-এর কবিতায় প্রবীণ বয়সের নিঃসঙ্গতা, দারিদ্র্য ও জীবনের ক্ষয় স্পষ্ট।
২. মহাদেবী বর্মার কবিতায়
প্রবীণ নারীর স্মৃতি, অভিমান ও অবহেলার যন্ত্রণা ফুটে উঠেছে।
৩. রামধারী সিং দিনকর
বার্ধক্যকে জীবনের সংগ্রামের সমাপ্তি এবং জ্ঞানের পূর্ণতা হিসেবে দেখিয়েছেন।
৪. অমৃতলাল নাগর
গ্রামীণ জীবনের প্রবীণদের পরিশ্রম ও অবহেলা নিয়ে কবিতা লিখেছেন।
৫. রাহুল সঙ্কৃত্যায়ন
তাঁর কবিতায় দেখিয়েছেন প্রবীণ বয়স মানে অভিজ্ঞতার আলো এবং ইতিহাসের ধারক।







