প্রকাশ : ১৫ নভেম্বর ২০২৫, ০৯:৩৮
শিক্ষক

যেজন আমারে পড়াইলো, আইজ বহুদিন বাদে তাহারে দেখিলাম হাতে এক্ষান ফাইল, পরনে সাদা শার্ট কালো পেন্টে ফরমাল হইয়া হঁাটতাছে! পায়ের কালো জুতা জোড়া কালা থেকে হালকা বাদামী হইয়া গেছে পথের ধুলায়। চেহারায় জইমা আছে ক্লান্তি, শার্ট ভিজা গেছে ক্লান্তির জলে! বোধ-হয় চাকরি খুঁজতাছে,ডাক দিলাম স্যার ও স্যার, স্যার তাকাইলো, আমারে দেখিয়া এক্ষান শুনকা হাসি দিলো, সালাম দিয়া জিজ্ঞাইলাম স্যার কই জাইতাছেন, স্যার আবার হাসি দিয়া কইলো চাকরির ইন্টারভিউ দিয়া বাসায় যাইতেছি৷ আমারে জিজ্ঞাইলো আমি কেমন আছি কি করি!
স্যার আমার পায়ের দিকে তাকাইলো! পায়ের জুতাগুলো ক্ষয় হইয়া গেছে, স্যার আর কিছু জিজ্ঞাইলো না, শুধু জিজ্ঞাইলো লেখাপড়া শেষ করছো কবে, আমি কইলাম এইতো স্যার দেড় দুই বছর। স্যারে আবার হাইস্যা দিয়া কইলো দেড় দুই বছরেই পায়ের জুতা ক্ষয় কইরা ফেললা মিয়া, আমি আইজ ছয় বছর যাবৎ চাকরীর ইন্টারভিউ দিতাছি দেহো জুতার কালার ছাড়া আর সবই ঠিক আছে।
আমি আগের মতোই সম্মান দিয়া মাথা নিচু কইরা রইলাম, আর মনে মনে কইতে লাগলাম স্যার লেখাপড়া তো শিখাইলেন, এখন চাকরির বাজারে নিজেরে বিক্রি করে কেমনে যদি শিখায় দিতেন!
কে জানে শিক্ষা হয়তো মানুষ গড়তে পারে, কিন্তু মানুষ বিক্রি করে কি না তা আমার জানা নাই।
স্যার আবার হাইস্যা দিয়া কইলো বাসায় যাও মিয়া, ভালা কইরা চাকরির পড়া পড়ো, চাকরির ইন্টারভিউ ভালা কইরা দিতে পারবা! আমি অবাক হইলাম, আর ভাবতে লাগলাম, প্রাইমারি, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক পড়লাম ডিগ্রি লইলাম অনার্সের, এতোশত পড়ার মধ্যে চাকরির পড়া কোনডা হেইডাই তো খুঁইজা পাইলাম না!
আচ্ছা চাকরিরও কি আলাদা পড়া আছে জিজ্ঞাইলাম স্যারেরে।
স্যারে আমারে কইতে লাগলো আমার বাড়িতে অনেকগুলা চাকরির পড়ার বই আছে আয় সেখান থেকে নিয়া কয়ডা পড়। এই বলিয়া স্যারে একটু সামনে হঁাটতেই স্যারের বা পায়ের জুতা ছিঁড়া স্যার মাটিতে পইরা গেলো, স্যারেরে ধইরা উঠাইলাম, পায়ে ব্যথা পাইছে ভাইবা স্যারের পা ধরতে গিয়া দেখি স্যারের মৌজায় কয়েক হাজার ফুটা, মনে হইলো স্যারে নতুন মৌজা কিনার পরে
মনে হয় শপথ করছিলো চাকরি না পাওয়া পর্যন্ত এই মৌজা দিয়াই চলবো, তা না হইলে কি কেউ এতো ছিঁড়া মৌজা পরে!
স্যারকে জিজ্ঞাস করিলাম স্যার পায়ে ব্যথা পাননি তো, স্যার মাথা নাড়া দিয়া কইলো না। আমি একটু হাইস্যা কইলাম স্যার ব্যথা পাননাই বুঝলাম, কিন্তু পইরা গিয়া আপনার মৌজা ছিঁড়া গেছে। স্যারে একটু অতৃপ্ত সুরে কইলো না’রে ওই মৌজা আরো বছর তিনেক আগেই ছিঁড়ছে!
স্যারের ছিঁড়া জুতা হাতে লইয়া হঁাটতে হঁাটতে স্যারের বাড়ি গেলাম। স্যারের যেই ঘড়ে আমি পড়তাম ওই ঘড় চিনার উপায়ন্ত নাই, চারটা জানালার কোনোটার কপাট আছে তো কোনোটার কব্জা নাই। আবার কোনোটার কপাট, কব্জা কোনোটাই নাই। দরজার কপাট আলগি দিয়া সরাইলো, মনে হইলো যেনো আলিবাবার গুহার দরজা খুললো! দরজার কলকব্জা কিছুই নাই, দরজা বুঝানোর লাইগা এক্ষান টিনের মধ্যে দুইখান কাঠ লাগাইয়াই দরজা বানাইয়া রাখছে!
ঘড়ে ঢুইকা লাইট অন করতেই আমার মনে হইলো এইটা আসলেই আলিবাবার গুহা! মানে সেই ৬০ ওয়ার্ডের লাল লাইট, একটা টেবিল ফ্যান, সেই পুরোনো চৌকিখাট তার পাশে রাখা একটা ভাঙাচুরা আলমারির ভিতর অসংখ্য বই!
আমার মনে হইলো এইডা বইয়ের আলিবাবার গুহা।
স্যার আমারে কইলো তুই বস আমি জামাকাপড় পাল্টাইয়া আই, এই বলিয়া স্যার গেলো জামাকাপড় পাল্টাইতে। আমি সেই মাধ্যমিকে থাকা অবস্থায় যে চেয়ারখানায় বইসা পড়তাম সেই চেয়ারখানায় বসলাম, বসতেই চেয়ার শব্দ কইরা উঠনো, একটু তাকাইতেই দেখি চেয়ারের চার পায়ায় ১৬ খানা পেরাক মারা, হাতুড়ির বারির অভাবে পেরাক কোনোটার মাথা বাহির হইয়া আছে, আবার কোনোটায় বোধ হয় স্যারের সাথে রাগ কইরা মাথা বঁাকা কইরা রাখছে, আবার বোধ হয় জন্মগত ত্যাড়া। যাক চেয়ার দিয়া কাজ নাই, বইতে পারলেই হইলো। ঘরে আশেপাশে তাকাইয়া দেখার মতো কয়টা বই ছাড়া আর কিছুই চোখে পরলো না! স্যারের বয়স ৩৫-৪০ এর মতো হইবো বিয়া করে নাই! বিয়াই বা করবো কেমনে, আজকাল চাকরি ছাড়া কোনো মাইয়ার মায়’ই বিয়া দেয় না।
স্যারের কথা কমু কি, আমার নিজেরই তো ২৬-২৭ বছর হইয়া গেলো চাকরি পাই না, চাকরি পাইয়া বিয়া করতে করতে আমারও স্যারের মতো বয়স হইয়া যাইবো।
তাকের থিকা বই দেখি! ওম্মা প্লে থেকে পঞ্চম শ্রেণীর নতুন বই ছাড়া আর বাকি সব বইগুলা ১০-১৫ বছরের পুরানো, বইয়ের পৃষ্ঠাগুলা সাদা থেকে মাইট্টা কালার হইয়া গেছে। কিন্তু স্যারের বইয়ের তাকে প্লে-পঞ্চম শ্রেণীর বইয়ের কি কাম? ভাবতে ভাবতেই স্যারে আইলো, কয় কিরে বই পাইছোস? কইলাম স্যার যেই বই আরো ৬-৭ বছর আগে দেইখা গেছি সেই বইগুলা এখনো আছে আপনার? স্যার কয় বইয়ের প্রতি তার মায়া জন্মাইয়া গেছে তাই রাইখা দিছে।
দেখছোস অবস্থা আমি সালার স্কুল কলেজ জীবনের সবগুলা বই কেজি দরে বেইচ্চা দিলাম! বইয়ের প্রতি আমার কোনো মায়া নাই আবার আমি পামু চাকরি!
আফসোস করতে করতে হঠাৎ স্যারের কথা মনে পইরা শান্তনা পাইলাম, স্যারইতো বইরে ভালোবাইসা এখনো বেকার!
যাক ভাবনা চিন্তা অনুশোচনা শান্তনারে একপাশে রাইখা স্যারেরে জিজ্ঞাইলাম স্যার প্লে-পঞ্চম শ্রেণীর বইয়ের কি কাজ?
স্যারে কইলো প্লে-পঞ্চম শ্রেণীর বইগুলা তার স্টুডেন্টদের।
আরে সালা স্যারের চাকরি নাই কাইন্দা মরে, স্যারের দেখি স্টুডেন্টও আছে!
তো স্যার আপনার স্টুডেন্ট কতোজন? স্যারে কইলো প্লের ১৩ জন আর অন্যান্য মিলিয়ে মোট ২৪জন!
দেখছোস অবস্থা! ২৪ জনে মাসে ১ হাজার কইরা দিলেও তো মাসে ২৪ হাজার টাকা। স্যারের কি আর চাকরি করা লাগে?
সালার ভাবছিলাম স্যার মনে হয় আমার থেকেও অসহায়! এখন দেখি সবচেয়ে বড় অসহায় আমি নিজেই, স্যারে তো পড়ায়, আমার তো তাও নাই।
স্যার এতো বাচ্চাকাচ্চা পড়ান সবই তো প্রাইমারির, মাধ্যমিকের কিছু পড়াইলেই তো আপনার হইয়া যায়।
স্যারে কইলো-অষ্টম নবম দশম শ্রেণীর বাচ্চারা এই ভাঙা ঘর দেইখা পড়তে আসে না! আপনারা বলেন তো এটা কোনো কথা, লেখাপড়া কি স্যারের ঘরে নাকি স্যারের মগজে। আমাদের সমাজের মগজবিহীন কিছু শিক্ষিত মানুষের চিন্তাভাবনা এর থেকে সুন্দর হওয়ার কথাও না।
একটু রহস্য নিয়ে জিজ্ঞাইলা স্যার এই অল্পকিছু বাচ্চা পড়াইয়া চলতে পারেনি সামান্য কয়টা টাকা।
স্যারে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে দিয়ে বললো এর মধ্যেও ১৫-১৬ জন ৮-১০ মাস বেতনই দেয় না! তাও চালায়া নেয় আল্লায়।
বেকার শিক্ষিতরা সব যায়গায়ই অবহেলিত! এতো মাস কেউ টাকা জমাইয়া রাখে! মানুষের বিবেক কি হঁাটুর নিচে নাকি আমার জানা নাই।
স্যার ৮-১০ মাস বেতন দেয় না কিছু বলেন না?
স্যার বললো, আর সামান্য কিছু টাকার জন্য কি আর বলবো, ওরা পড়ুক মানুষ হোক সমাজে মাথা উচু করে চলুক। এটাই আমার পাওয়া।
দেখছেন অবস্থা! নিজের পেটে ভাত নাই অন্যের জন্য কাইন্দা মরে।
স্যার অল্প টাকা বললেন, ১৫-১৬ জন টাকা দেয় না, ১ হাজার করে ধরলেও তো মাসে ১৫-১৬ হাজার টাকা তার ৮-১০ মাসে হিসাব করলে কতো টাকা আসে হিসাব আছে আপনার?
স্যারে বললো আর হিসাব এই বয়সে মানুষের কাছে বাচ্চা পড়াইয়া কতো টাকা পাবো তার হিসাব করলে আমি কোটিপতিদের খাতায় থাকতাম। এর মধ্যে কতো অসহায় বাচ্চা আছে তারাও তো কোনো না কোনো সমস্যার জন্যই টাকা দিতে পারে নাই। এসবে আমার কোনো আক্ষেপ নাই। এই বলতে বলতে স্যারে আমারে দুইটা বই বাহির কইরা দিলো দিয়া কইলো এই বইগুলো আমি যখন প্রথম চাকরি খুঁজা শুরু করি তখন কিনেছিলাম, পড়িস নতুন বই থাকায় হয়তো আমার ভাগ্যে চাকরি দেয় নাই । তোরে দিতে পারে। আর শুন বইগুলো নষ্ট করিস না। পড়া শেষে দিয়ে যাইস।
স্যাররে সালাম দিয়া অবশেষে স্যারের আলাদিনের গুহা থেকে বের হয়ে আসলাম।
বাহিরে আসার পর কেন জানি ভাল্লাগতাছে না, স্যারের ঘরে আলাদা একটা শান্তি অনুভব করছিলাম, একটু ভাবসা গরম, নতুন পুরান বইয়ের গন্ধ, লাল লাইটের আভা পুরো পৃথিবী থেকে আলাদা।
একজন বইপ্রেমি যার সংগ্রহে ২৫-৩০ বছরের বই থেকে নতুন শিক্ষাবর্ষের সকল বই, একজন ঋণদাতা যার কাছে হাজারো শিক্ষার্থী ঋণী। একজন উদার মনের মানুষ, যে নিজের জাহার সমস্যা জলাঞ্জলি দিয়ে শিক্ষার্থীদের সমস্যা ভাবে। সবকিছুর সমন্বয়ে তিনি একজন শিক্ষক।








