সোমবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫  |   ৩২ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৯:০৮

বাংলা উপন্যাসে প্রবীণ জীবন

হাসান আলী
বাংলা উপন্যাসে প্রবীণ জীবন

বাংলা উপন্যাসে প্রবীণ চরিত্রগুলো কেবল পার্শ্ব চরিত্র নয়, অনেক সময়ই জীবন দর্শনের কেন্দ্রবিন্দু । এই উপন্যাসগুলোতে বার্ধক্য আসে সম্মানের সাথে, আবার কখনো আসে দুঃখ-কষ্ট নিয়ে।

বার্ধক্য নিয়ে আমাদের কথা সাহিত্যিকরা কেমন করে ভেবেছেন সেটা খানিকটা উপলব্ধি করার জন্যে নিচে দশটি উপন্যাসের সার সংক্ষেপ তুলে ধরা হয়েছে।

১. ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’। লিখেছেন মানিক বন্দোপাধ্যায়।

উপন্যাসে বড় বাবু হচ্ছেন মুখ্য প্রবীণ চরিত্র, যিনি ব্যক্তিগত জীবনে নিষ্ক্রিয়, সমাজে মর্যাদাপরায়ণ এবং কুসুম ও শশীর মতো চরিত্রদের জীবনে সংকট তৈরি করেনÑসচেতন কিংবা অসচেতন ভাবে। তাঁর উপস্থিতি উপন্যাসে প্রজন্মগত দ্বন্দ্ব, সহনশীলতা এবং অচল কাঠামোর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক।

বড় বাবুর চরিত্রের মাধ্যমে তিনি তুলে ধরেছেন এক রক্ষণশীল প্রবীণ প্রজন্মকে, যাঁরা সমাজে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা রাখে কিন্তু বাস্তবে নেতৃত্বহীন, নির্লিপ্ত ও কর্তব্যবিমুখ। তিনি একটি পুতুল, যিনি সমাজের নিয়ম কানুনে বাঁধা। কোনো স্বাধীনতা নেই, শুধু নিয়ম মেনে চলাই তাঁর ধর্ম।

২. ‘দৃষ্টিপাত’। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস।

জ্ঞানদা চরিত্রটি পূর্ণাঙ্গ প্রবীণ চরিত্র, যিনি জীবনের বহু চড়াই উৎরাই পেরিয়ে এসে এখন আত্মিক ভিত্তি। তাঁর চরিত্রে দেখা যায় সংযম, সহানুভূতি ও সমাজবোধের মিশেল। সুনীল এই প্রবীণকে শুধু করুণার চোখে দেখেননি, বরং দিয়েছেন শক্তি, মর্যাদা, সম্মান, যা বাংলা সাহিত্যে প্রবীণ চরিত্র চিত্রণে এক উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত।

৩. ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। উপন্যাসটির লেখক অদ্বৈত মল্লবর্মণ। উপন্যাসে অনন্তের পিতা একটি গভীর অর্থবহ প্রবীণ চরিত্র, যিনি প্রকৃতি, সংস্কৃতি এবং জীবনবোধের এক জীবন্ত প্রতিমা। উপন্যাসে তাঁর উপস্থিতি মৌন কিন্তু অর্থপূর্ণ। এই চরিত্র আমাদের বুঝিয়ে দেয় প্রবীণদের অভিজ্ঞতা, সরলতা এবং জীবন দর্শন, যা সমাজের ভিত্তি হলেও পরিবর্তনের তোড়ে তারা একসময় ‘হারিয়ে যাওয়া লোক’ হয়ে উঠেন।

৪. ‘শেষ প্রশ্ন’। উপন্যাসটির লেখক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র কিরনীময়ী। তবে প্রবীণ ব্যক্তিত্ব রমেশের পিতার চরিত্র দর্শন প্রবণ।

রমেশের পিতার চরিত্র নৈতিক দ্বন্দ্ব, ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং সামাজিক সম্মানের মোহে আচ্ছন্ন এক পিতৃতান্ত্রিক পুরুষের প্রতিচ্ছবি। শরৎচন্দ্র এই চরিত্রের মাধ্যমে দেখাতে চেয়েছেন, ধর্ম ও সমাজের নামে ব্যক্তি স্বাধীনতা, ভালোবাসা ও মানবিকতা কীভাবে দমন করা হয়। এই চরিত্রটি উপন্যাসের প্রধান চরিত্র না হলেও উপন্যাসের মূল বার্তা ও সংকটকে গভীরভাবে তুলে ধরতে সহায়ক। রমেশের পিতা আসলেই একটা প্রতীকী চরিত্র, তিনি সেই সমাজ ব্যবস্থার প্রতিনিধি, যেটি নারী স্বাধীনতা দেয় না, বিজ্ঞান ও যুক্তিকে অস্বীকার করে এবং ভালোবাসার চেয়ে সামাজিক সম্মানকে বড়ো করে দেখে। এই চরিত্রের মাধ্যমে শরৎচন্দ্র তাঁর সময়ে সমাজে প্রচলিত ধর্মীয় ও সামাজিক সংকীর্ণতাকে তীব্রভাবে সমালোচনা করেছেন। শেষ প্রশ্নের একটি গৌণ কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র।

৫. ‘বৃদ্ধাশ্রম’। উপন্যাসটির লেখক সেলিনা হোসেন। উপন্যাসের প্রবীণ চরিত্রগুলোর দুঃখ-কষ্ট-ব্যথা- বেদনা তুলে ধরেছেন। বার্ধক্যে নিঃসঙ্গতা, পরিবারের উপেক্ষা এবং মানবাধিকারের প্রশ্ন তুলে পাঠকের মনে সাড়া জাগিয়েছেন।

৬. ‘মরণ বৃক্ষ’। উপন্যাসের লেখক বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়। মরণ বৃক্ষ উপন্যাসে তিনি প্রবীণ চরিত্রদের এমনভাবে এঁকেছেন, যাতে তাঁরা হয়ে উঠে জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়ানো এক একটি মানব প্রতিমা। যাঁদের চোখে রয়েছে অতীতের অভিজ্ঞতা, বর্তমানের মমতা এবং ভবিষ্যতের ম্লান আলো।

প্রবীণ চরিত্ররা প্রায়শঃই নিঃসঙ্গ। তারা পরিবারের কেন্দ্র থেকে সরে গিয়ে নীরব প্রহরীর মতো থেকে যান। কিন্তু তাঁদের মধ্যে রয়েছে অপার মায়া, সম্পর্কের প্রতি টান এবং হারানো সময়ের প্রতি মমতা। বিভূতি ভূষণ উপন্যাসের প্রবীণ চরিত্রের প্রতি করুণা দেখান না, বরং সম্মান ও সহানুভূতির সাথে উপস্থাপন করেন।

৭. ‘গৃহবাসী’। উপন্যাসটির লেখক প্রমথ চৌধুরী।

গৃহবাসী উপন্যাসে লেখক প্রবীণ চরিত্রদের বাস্তব, মনস্তাত্ত্বিক ও বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিতে উপস্থাপন করেছেন। তাঁরা শুধু গৃহকর্তা নন, বরং সমাজের রক্ষণশীল চেতনার ধারক। এই চরিত্রগুলো আমাদের ভাবায়--বয়স বাড়লেও সবসময়ই প্রজ্ঞা বাড়ে না, বরং কখনো সীমাবদ্ধতা বেড়ে যায়। তবে এই প্রবীণদের ছায়াতেই তৈরি হয় নতুন প্রজন্মের বিদ্রোহ, প্রশ্ন এবং আত্ম অন্বেষণ।

৮. ‘মহাপ্রস্থান’ উপন্যাসের লেখক রাবেয়া খাতুন।

উপন্যাসে রাবেয়া প্রবীণদের দুঃখ-কষ্টের শিকার নয়, বরং অভিজ্ঞতা, ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার প্রতীক হিসেবে তুলে ধরেছেন। তাঁদের আত্মসম্মানবোধ অনেক উঁচুতে--তাঁরা সাহায্য চাইতে সংকোচ বোধ করেন। আবার অপমানিত হলে নীরবে সহ্য করেন। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রবীণ চরিত্রদের চিন্তায় আসে ধর্মীয় উপলব্ধি ও মৃত্যু চিন্তা। তাঁরা অতীতের ভুলচুক, স্মৃতি, মানুষের সম্পর্ক এবং মৃত্যুর পরিণতি নিয়ে ভাবেন।এই ভাবনা তাঁদের চরিত্রে এনে দেয় এক ধরনের আধ্যাত্মিক গভীরতা।

আব্দুল হাকিম চৌধুরী উপন্যাসের মূল প্রবীণ চরিত্র। একসময় গ্রামের প্রভাবশালী ও শিক্ষিত মানুষ ছিলেন। গুণাবলি : দৃঢ়চেতা, অভিজ্ঞ, ধর্মবিশ্বাসী এবং পরিবারপ্রধান।

বার্ধক্যে এসে তিনি একাকিত্বে ভোগেন। সন্তানদের দূরত্ব ও সমাজের পরিবর্তন তাঁকে কষ্ট দেয়। তাঁর চরিত্রে প্রবীণদের সম্মান, আত্মমর্যাদা, একই সঙ্গে বয়সজনিত ভঙ্গুরতা ফুটে উঠেছে।

আমেনা খাতুন (স্ত্রী) গৃহিণী, মা ও দাদী হিসেবে পরিবারে স্থিতি রক্ষার চেষ্টা করেছেন। যিনি ধৈর্যশীলা, মমতাময়ী, ধর্মপ্রাণ।

বয়সের ভারে দুর্বল হলেও মানসিকভাবে পরিবারের টানাপোড়েনে সবসময় উদ্বিগ্ন।

প্রবীণ নারীর চরিত্র হিসেবে তিনি পরিবারে ভালোবাসা ও ঐতিহ্যের প্রতীক।

৯. ‘কবি’ উপন্যাসের লেখক তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়।

‘কবি’ উপন্যাসে গ্রামীণ কবিয়াল ও লোকসংস্কৃতির টানাপোড়েন তুলে ধরা হয়েছে। গ্রামের প্রবীণ কবিয়ালরা তরুণ কবিদের অনুপ্রেরণা দেন। তাদের অভিজ্ঞতা ও ঐতিহ্যের জ্ঞান নতুন প্রজন্মকে পথ দেখায়।

প্রবীণরা সংস্কৃতি ও সৃষ্টিশীলতার ধারক হিসেবে সম্মানিত।

১০. ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’ উপন্যাসের লেখক আবু ইসহাক।

করিমুদ্দিন। তিনি গ্রামের সমাজ কাঠামোর একজন প্রবীণ। তাঁর কথায় গ্রামীণ বিচার, সালিস, সামাজিক রীতিনীতি নির্ধারিত হয়।

তিনি নিজেকে সমাজের নৈতিক রক্ষক মনে করেন। অন্য প্রবীণ নারীরা তাঁরা লোকবিশ্বাস, কুসংস্কার এবং সামাজিক চাপকে ধরে রেখেছেন।

একই সঙ্গে পরিবারের প্রতি মমতা ও সহানুভূতিও প্রবল।উপন্যাসে প্রবীণরা সমাজের রীতিনীতি ও ঐতিহ্যের ধারক। তবে তাদের সীমাবদ্ধতা হলোÑকুসংস্কার ও পুরানো ধারণা আঁকড়ে থাকা।

তবুও পরিবার ও সমাজে তাদের মর্যাদার আসন অটুট থাকে, কারণ গ্রামবাংলায় প্রবীণদের ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত কার্যকর হতো না।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়