বুধবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫  |   ৩১ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৯:৪০

রোমান স্বপ্নভঙ্গ থেকে সৌদি ঐক্যজয় : ইতিহাসের আলোকে উদীয়মান ‘আসির’

মোহাম্মদ সানাউল হক
রোমান স্বপ্নভঙ্গ থেকে সৌদি ঐক্যজয় : ইতিহাসের আলোকে উদীয়মান ‘আসির’

আসির প্রদেশ সৌদি আরবের দক্ষিণাঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক অঞ্চল, যা ভৌগোলিক বৈচিত্র্য ও ঐতিহাসিক গুরুত্বের জন্য পরিচিত। এর আয়তন প্রায় ৭৬,৬৯৩ বর্গকিলোমিটার, যা দেশের মোট আয়তনের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দখল করে আছে। ২০২২ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রদেশটির জনসংখ্যা প্রায় ২০ লাখ ২৪ হাজার ২৮৫ জন। আবহা শহর এর রাজধানী, যা সৌন্দর্য ও শীতল আবহাওয়ার জন্য পরিচিত, এবং খামিস মুশাইতের পর এটি দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী। প্রদেশটির উত্তরে ও পশ্চিমে মক্কা প্রদেশ, উত্তর-পশ্চিমে আল-বাহাহ, উত্তর-পূর্বে রিয়াদ প্রদেশ, দক্ষিণ-পূর্বে নাজরান এবং দক্ষিণে জাজান ও ইয়েমেনের সাদা গভর্নরেট অবস্থিত। এই অবস্থান আসিরকে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও পর্যটন দিক থেকে একটি কৌশলগত গুরুত্ব প্রদান করেছে।

আসির নামের উৎপত্তি নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। বিখ্যাত ইতিহাসবিদ আল-মাসুদি তাঁর দ্য মেডোজ অব গোল্ড গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে অঞ্চলটির প্রাচীন নাম ছিল ‘আজদ ভূমি’। অন্যদিকে একটি জনপ্রিয় তত্ত্ব মতে, আসির নামটি এসেছে আরবি শব্দ ‘উসরা’ থেকে, যার অর্থ ‘কষ্ট’ বা ‘দুর্গমতা’। ধারণা করা হয় যে, এই নামটি এসেছে অঞ্চলের দুর্গম ও খাড়া পাহাড়ি ভূপ্রকৃতির কারণে। ইতিহাসবিদদের মতে, নামটির উৎপত্তি ঐতিহাসিক বানু আসির গোত্র থেকে, যারা রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং তাদের নামেই পুরো অঞ্চলটির পরিচয় গড়ে ওঠে। এই বিতর্ক আসিরের ঐতিহাসিক গভীরতা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের প্রমাণ বহন করে।

আসির প্রদেশ প্রাচীনকালে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যপথের অংশ ছিল, যা ভূমধ্যসাগর থেকে ইয়েমেনের হাজরমাউত পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ২৫ সালে রোমান সেনাপতি এলিয়াস গাল্লাস প্রাচীন মিশর থেকে ২,১০০ কিলোমিটার দীর্ঘ অভিযানে নামেন, যার লক্ষ্য ছিল এই বাণিজ্যপথগুলো নিয়ন্ত্রণ করা। রোমানরা মেরিব নগরী (সাবার রাজধানী) দখল করে ধূপ ও অন্যান্য সুগন্ধি দ্রব্যের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিল, কারণ সে সময় ধূপ ছিল অমূল্য পণ্য। কিন্তু এই অভিযান ব্যর্থ হয়, অসংখ্য সৈন্য প্রাণ হারায় এবং ফলশ্রুতিতে আসির অঞ্চল সম্পর্কে খুব সামান্য তথ্যই রোমানদের হাতে আসে। এই ঘটনার পরও আসির তার বাণিজ্য ও যোগাযোগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা বজায় রাখে।

১৮১৮ সালে প্রথম সৌদি রাষ্ট্র অটোমানদের হাতে পতনের পর আসিরবাসীরা অটোমান মিশরীয় সেনাদের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ১৮৪০ সালে অটোমানরা প্রত্যাহার করলে মুঘাইদ গোত্রের আল-আয়েদহ পরিবার আসির পাহাড়ি অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। তারা সৌদিদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখলেও আনুষ্ঠানিকভাবে সৌদি শাসনের অধীনে যায়নি। পরবর্তীতে তারা যখন তিহামা নিম্নভূমি (বর্তমান জাজান প্রদেশ) দখলের চেষ্টা করে, তখন অটোমান তুর্কিরা ক্ষুব্ধ হয়ে পুনরায় আসিরে আক্রমণ চালায়। ১৮৭২ সালে আল-আয়েদহ নেতাকে হত্যা করে এবং আবহায় একটি মুতাসাররিফিয়া (উপ-গভর্নরেট) প্রতিষ্ঠা করে, যা ইয়েমেন ভিলায়েতের অধীনে ছিল। তবে এই নিয়ন্ত্রণ সীমিত দুর্গকেন্দ্রিক অবস্থানে সীমাবদ্ধ ছিল এবং স্থানীয় জনগণের মধ্যে অটোমান শাসনের প্রভাব খুব একটা পড়েনি।

প্রায় ১৯০৬ সালে আহমদ ইবনে ইদ্রিস আল-ফাসির বংশধর মুহাম্মদ ইবনে আলী আল-ইদ্রিসি আসিরে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা শুরু করেন। তিনি ইতালির সঙ্গে কূটনৈতিক আলোচনা করেন এবং পরে অটোমানদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। ১৯১১ সালে তিনি হাশেমি শাসক হুসেইন বিন আলির বাহিনীর কাছে পরাজিত হলেও ১৯১৫ সালে ব্রিটিশদের সঙ্গে গোপন সামরিক জোট গড়ে তোলেন। ব্রিটিশরা তখন অটোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। এই জোট পরবর্তীতে আসিরের রাজনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলে এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে মুহাম্মদ ইবনে আলী একটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত স্বাধীন রাষ্ট্র ‘আসির আমিরাত’ প্রতিষ্ঠা করেন।

মুহাম্মদ ইবনে আলীর শাসনকালে প্রতিষ্ঠিত আসির আমিরাতের সীমানা উত্তর দিকে আবহা থেকে দক্ষিণে হোদেইদা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এই সময় আসির তার ভূরাজনৈতিক অবস্থানের কারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কিন্তু মুহাম্মদ ইবনে আলীর মৃত্যুর পর (১৯২০) তাঁর উত্তরসূরিরা সৌদি শাসক ইবনে সৌদের ক্রমবর্ধমান ক্ষমতার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারেননি। সৌদি আরবের ক্রমবর্ধমান শক্তি ও রাজনৈতিক প্রভাব আসিরের স্বাধীনতার অবসান ঘটায় এবং শীঘ্রই অঞ্চলটি সৌদি শাসনের অধীনে চলে আসে।

১৯২০ সালে সৌদি বাহিনী আবহা দখল করে এবং ১৯২৩ সালের মধ্যে পুরো আসির সৌদি শাসনের অন্তর্ভুক্ত হয়। ইয়েমেনের জেদ্দি ইমামও এই অঞ্চলের দাবিদার ছিলেন, তবে ১৯৩৪ সালের ‘তাইফ চুক্তি’র মাধ্যমে আসির আনুষ্ঠানিকভাবে সৌদি আরবের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এই সংযুক্তিকরণ আসিরকে আধুনিক সৌদি রাষ্ট্রের অংশ হিসেবে নতুন রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত করে।

১৯৩২ সালে ইউরোপীয় অভিযাত্রী সেন্ট জন ফিলবি আসিরে প্রবেশ করেন এবং অঞ্চলটির একটি পূর্ণাঙ্গ মানচিত্র তৈরি করেন। তবে তাঁর পর্যবেক্ষণ প্রকাশিত হয় ১৯৫২ সালে। এর আগে আসির অঞ্চল পশ্চিমা বিশ্বের কাছে ছিল অনেকটাই অজানা। দুর্গম ভূপ্রকৃতি ও সীমিত যোগাযোগ ব্যবস্থা আসিরকে দীর্ঘদিন ধরে বাইরের বিশ্বের দৃষ্টি থেকে আড়ালে রেখেছিল। ১৯৩৫ সালে আসিরকে পৃথক গভর্নরেট ঘোষণা করা হয়, যা প্রশাসনিক দিক থেকে নতুন মাত্রা এনে দেয়।

সূত্রে জানায়, ২০১৪ সাল থেকে সৌদি-ইয়েমেন সীমান্তে শত শত ইথিওপীয় শরণার্থী নিহত হওয়ার ঘটনা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ২০২৩ সালের প্রতিবেদনে জানায় যে ২০২২ সালের মার্চ থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত সীমান্ত পার হওয়ার সময় শত শত শরণার্থী হত্যার শিকার হয়েছেন। প্রতিবেদন অনুযায়ী, এসব ঘটনায় বিস্ফোরক অস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছে এবং নারীদের উপর যৌন সহিংসতার অভিযোগও রয়েছে। এই মানবাধিকার সংকট আসির অঞ্চলের সীমান্ত রাজনীতিকে নতুনভাবে আলোচনায় এনেছে।

ঐতিহাসিকভাবে আসির অঞ্চলে কফি, গম, আলফালফা, বার্লি, সেন্না এবং ধূপ উৎপাদনের খ্যাতি ছিল। গম সাধারণত গ্রীষ্মকালে চাষ করা হতো এবং সিক্ত অঞ্চলে তিল উৎপাদন করা হতো। খড় ব্যবহার করে তৈরি করা হতো টুপি, মাদুর, ঝুড়ি, এমনকি তাঁবুও। এসব কৃষি ও হস্তশিল্প আসিরের অর্থনীতির ভিত্তি গড়ে তুলেছিল। স্থানীয় মানুষের সৃজনশীলতা ও কারিগরি দক্ষতা অঞ্চলটির অর্থনৈতিক ইতিহাসে বিশেষ স্থান দখল করে আছে।

২০১৯ সালে সৌদি সরকার আসির অঞ্চলে অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য এক বিলিয়ন সৌদি রিয়ালের প্রকল্প ঘোষণা করে। এই প্রকল্পে স্বাস্থ্যসেবা, পরিবহন এবং পৌরসেবা উন্নয়নের ব্যবস্থা করা হয়। সৌদি ভিশন ২০৩০-এর অংশ হিসেবে এই উন্নয়ন পরিকল্পনার লক্ষ্য ছিল তেলনির্ভর অর্থনীতি থেকে বের হয়ে নতুন আয়ের উৎস তৈরি করা এবং আঞ্চলিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করা।

২০২৩ সালে ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান আসিরের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ জাবাল সৌদাহকে কেন্দ্র করে ‘সৌদাহ পিক্স’ নামের একটি পর্যটন প্রকল্প চালু করেন। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩,০১৫ মিটার উচ্চতার এই শৃঙ্গকে বিলাসবহুল পর্যটন গন্তব্য হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা করা হয়েছে। প্রকল্পটির লক্ষ্য হলো আন্তর্জাতিক পর্যটকদের আকর্ষণ করা এবং আসিরকে বৈশ্বিক মানের পর্যটনকেন্দ্রে পরিণত করা।

আসির প্রদেশের সর্ববৃহৎ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হলো কিং খালিদ বিশ্ববিদ্যালয় (KKU), যা ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসা, প্রকৌশল, কম্পিউটার বিজ্ঞান, মানবিক বিজ্ঞান, ইসলামিক স্টাডিজ ও ব্যবসা শিক্ষা দেওয়া হয়। মূল ক্যাম্পাস আবহায় অবস্থিত, আর শাখা ক্যাম্পাস রয়েছে খামিস মুশাইত, মুহাইল ও বিশায়। এটি প্রদেশের যুবসমাজের শিক্ষার মানোন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা সৌদি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত হয়। শহর থেকে শুরু করে পাহাড়ি গ্রাম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিদ্যালয় নেটওয়ার্ক বিস্তৃত, যাতে প্রত্যেক শিক্ষার্থী সমান সুযোগ পায়। আধুনিক শিক্ষা কাঠামো আসিরের সামগ্রিক উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।

আসিরে টেকনিক্যাল ও ভোকেশনাল ট্রেনিং করপোরেশন (TVTC) পরিচালিত বহু কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা কেন্দ্র রয়েছে। এখানে নারী ও পুরুষদের জন্য আলাদা কলেজ রয়েছে, যা স্থানীয় যুবকদের প্রযুক্তিগত ও বৃত্তিমূলক দক্ষতা উন্নত করতে সহায়তা করছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে বড় অবদান রাখছে।

আসির উচ্চভূমিতে অবস্থিত হওয়ায় এর জলবায়ু সৌদি আরবের অন্যান্য অংশের তুলনায় ভিন্ন। এখানে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত প্রায় ৩০০-৫০০ মিলিমিটার, যা মূলত মার্চ ও এপ্রিল মাসে হয়, তবে গ্রীষ্মকালেও বৃষ্টি হয়। দিনের বেলায় তাপমাত্রা ৩০ক্ক সেলসিয়াসের বেশি হলেও সকালে প্রচণ্ড ঠান্ডা পড়ে এবং ঘন কুয়াশায় দৃশ্যমানতা কমে যায়। এই জলবায়ুগত বৈচিত্র্য আসিরকে কৃষি ও পর্যটনের জন্য আকর্ষণীয় করে তুলেছে।

আসিরে প্রাকৃতিক উদ্ভিদের প্রাচুর্য রয়েছে, বিশেষ করে কিছু সুরক্ষিত এলাকায় ঘন শঙ্কুযুক্ত বনভূমি পাওয়া যায়। আধুনিক সেচব্যবস্থার ফলে গম ও ফলমূলের উৎপাদন বেড়েছে, যা স্থানীয় কৃষকদের জীবনমান উন্নত করছে। কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি এখনো আসিরের সংস্কৃতি ও জীবনধারার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

১৯৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত আসির ন্যাশনাল পার্ক প্রদেশটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রতীক। এটি উপকূলীয় অঞ্চল থেকে শুরু করে পাহাড়ি ঢাল পর্যন্ত বিস্তৃত। এখানে সংরক্ষিত বনভূমি, বন্যপ্রাণী এবং পর্যটন সুবিধা রয়েছে। এই পার্ক শুধু সৌদি আরবের জন্য নয়, সমগ্র উপসাগরীয় অঞ্চলের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশগত সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হয়।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়