মঙ্গলবার, ০৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫  |   ২৯ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৮:৩৮

যাদব স্যারের ‘ছাত্র’রা : স্কুলবেলার গল্প

অমল সাহা
যাদব স্যারের ‘ছাত্র’রা : স্কুলবেলার গল্প

আমরা স্কুলে যেতাম অন্য সবাই যায় বলে! না গেলে খারাপ দেখায় তাই স্কুলে যেতাম। অবশ্য আমাদের বন্ধুবান্ধবদেরও দু’একজন বাদে সবারই একই দশা। আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে পড়ালেখার বিষয়টা আমাদের মপস্বলে ঐরকমই ছিল। পড়ালেখা করাটা কোনো সিরিয়াস বিষয় ছিল না। আবার কেউ পড়তে চাইলেও যে পড়তে পারতো তা নয়। আমাদের বাস ছিল বাজারের পাশেই। সেই হিসাবে আমরা ছিলাম ‘বাজাইরা পোলাপান’। সবার বাবাদেরই বাজারে আরৎ, চালের কল, ডালের দোকান’ কিংবা পাইকারী খুচরা বিক্রির জন্য আটা লবণের দোকান ছিল। সেখানে তুমি লেখাপড়া করে একেবারে দিগগজ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পানে ছুটবে সে হবে না বাবা! হিসেবনিকেশ যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ শিখেছো ওতেই চলবে। মেট্রিকটা (এসএসসি) পাশ করেছো ব্যস, এবার আরতে বসে যাও। এক বাবা আরেক বাবাকে বুদ্ধি দিতো, আরে পড়ালেখা করিয়ে কী হবে? শুধু শুধু সময় নষ্ট। আর মেয়েদের অবস্থা আরও কেরাসিন। বেশির ভাগ মেয়েরই ষোল সতেরোতে বিয়ে হয়ে যেত। সেই সময়টা দেখেছি অনেক মেধাবী ছেলেমেয়েদের, ভাল ফলাফল করা ছেলেমেয়েদের স্কুল কলেজের গন্ডি পার হতেই দোকানে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। আর মেয়েদের বিয়ে। আমার ছোটভাই যখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় তখন আমার বাবা মনে মনে খুবই অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। এই ছিল সার্বিক অবস্থা। যাকগে। এই যখন অবস্থা তখন আমার ও আমার বন্ধুবান্ধবদেরও পড়ালেখা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা ছিলনা। আমার সঙ্গ মোটেও ভাল ছিলনা। কারণ স্কুল ছেড়ে কলেজে উঠতেই অনেকে গাঁজাগুলি ধরে ফেলেছিলো। একদিন স্কুলে এসেম্বলি হচ্ছে। সবাই লাইন ধরে আছি মাঠে। এটেনশন স্ট্যান্ড ইজি হয়ে দাঁড়িয়ে। এমন সময় স্কুলের বারান্দা থেকে নেমে এলেন এসিস্টেন্ট হেডমাস্টার পঙ্কজ স্যার। ইয়া লম্বা চওড়া। আমাদের উপর দিককার ক্লাশে ইংরেজি পড়াতেন। আর স্যার কেন জানি রেগেই থাকতেন। মনে হয় আমাদের মতো অকাল কুষ্মান্ড ছাত্রদের জন্যই স্যারের মেজাজ সব সময়ই বিগড়ে থাকতো। স্যার আমার সামনেই এসে দাঁড়ালেন, তারপর ভয়াবহ কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, তুই কতদিন পরে স্কুলে এলি?

আমিতো গত সতের দিন স্কুলে আসিনি। বই নিয়ে বাড়ি থেকে বের হ’তাম তারপর নদীর পাড়ে বালুর মাঠে চলে যেতাম ক্রিকেট বা ফুটবল খেলতে, যখন যেটায় সুযোগ পেতাম। ভেবেছিলাম আমার এই অবিরাম স্কুল ফাঁকি দেয়া কেউ ধরতে পারবে না। কারণ তখনতো সিসি ক্যামেরা ছিলনা। কিন্তু পঙ্কজ স্যার কীভাবে যেন স্যাটেলাইট তাক করে রেখেছিলেন আমার উপর কে জানে? আবার দাঁত কিড়মিড় করে বললেন, কয় দিন পর স্কুলে আসলি? আমি মিনমিন করে বলি, সতের দিন পর।

-কেন?

আমি আবার চোরের মতো বলি, সরস্বতী পূজা ছিলোতো...

পঙ্কজ স্যার এবার আমার গালে ছোট্ট করে চড় মেড়ে বললেন, ব্যাটা তর সরস্বতী পূজা করতে সতের দিন লাগে? এ্যাই ফাজিল!

মাঠের সব ছাত্র আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ধরা খেয়ে বললাম, স্যার আর স্কুল বাদ দিমুনা।

সেকথা কি আর মানে স্যার! এবার আমাকে বেশ চটাস করে গালে চড় দিয়ে বললেন, আমিই তরে স্কুল থেকে বাদ দেওয়াইতেছি। এই বলে এই একমাঠ ছাত্রের মধ্যে আমার দুই গালে তালে তালে চড় মারতে শুরু করলেন। আমি ক্লাশের দিকে এক দৌড়ে পালিয়ে গিয়ে কোনো রকমে মান ইজ্জত রক্ষা করলাম (এতো অল্প চড়ে মান ইজ্জত আমাদের তখন যেত না)। আমি ইংরেজিতে টেনেটুনে পাশ করতাম আবার টেনেটুনে ফেলও করতাম অর্থাৎ পাশের প্রায় কাছে গিয়ে ফেল করে বসতাম। কিন্তু স্কুল ফাইনালতো পাশ করতে হবে। স্যার একদিন নন্দকে দিয়ে আমাকে খবর পাঠালেন। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে স্যারের সামনে গেলাম। পঙ্কজ স্যার আমাকে বললেন, কাল থেকে তুই আমার কাছে প্রাইভেট পড়বি। তর বাবাকে আমি বলবো। এমনিতেই ইংরেজি পারিনা তারপর পঙ্কজ স্যারের কাছে ইংরেজি প্রাইভেট! আমার মাথা একটা চক্কর মারলো। কিন্তু উপায় নাই। পরদিন ভয়ে ভয়ে গেলাম। শফিক, উৎপল আর নন্দ দেখি স্যারের দেয়া কোন এসাইনমেন্ট খাতায় লিখছে। তখন এক হাজার বারশ পৃষ্ঠার মোটা টেস্ট পেপার বইটি থাকতো। স্যারের কাছে যাওয়ার পর স্যার টেস্ট পেপারটা উল্টেপাল্টে দেখলেন। তারপর গমগমে আওয়াজে বললেন, তর কিছুই করতে হবে না। আগামীকাল এখানে তিনশ ভয়েস আছে সবগুলি চেঞ্জ করে নিয়ে আসবি।

আমার মাথায় বাড়ি! তিনশ ভয়েস এক রাতে! আমি ভয়েসহারা! হারামী নন্দ দেখি আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে। অর্থাৎ আমার বিপদে বিমলানন্দ পাচ্ছে। আমার এসব সম্বন্ধে অল্প ধারণা আছে কিন্তু তিনশ ভয়েস চেঞ্জ করার মতো বিদ্যা আমার ঘটে নাই। পঙ্কজ স্যার বললেন, যা এখন যা। আজ বিকাল থেকেই লেগে পড়।

আমি বিকাল থেকেই লেগে পড়লাম। বাসার সবাই দেখলো আমার মতো দঁড়ি ছাড়া ষাঁড় ‘গোয়ালে’ বসে একমনে খাতায় লিখছে। বাবা শুধু বললেন, পঙ্কজ স্যারের কাছে গেছিলি? বাজারে আমার সাথে ওনার কথা হইছে। বাবাকে একবার বলতে ইচ্ছা করছিলো, আপনার সাথে কথা হইছে আর আমার যতো ব্যথা হইছে। আমি বললাম, গেছিলাম।

সারা রাত জেগে আমি তিনশ ভয়েস চেঞ্জ করে নিয়ে গেলাম। স্যার আমার খাতাটা নিয়ে গম্ভীর মুখে দেখতে লাগলেন আর লাল কালির একটা ফাউন্টেন কলম দিয়ে ভুলগুলি কাটতে লাগলেন। দেখলাম খাতা লালে লাল হয়ে যাচ্ছে। আর আমার শরীরে বিনবিন ঘাম ফুটছে। আজ বোধ হয় চড় থাপ্পর নয় ঘুষিই খেতে হবে। শেষতক দেখলাম আমার ভয়েস চেঞ্জগুলি কমিউনিস্ট হয়ে গেছে। অর্থাৎ লাল রঙ ধারণ করেছে। স্যার শেষ করে খাতাটা আমার দিকে বাড়িয়ে ধরলেন, নে গোণ কয়টা কারেক্ট হয়েছে।

আমি অধোবদন হয়ে গুনে দেখলাম, তিন’শর মধ্যে মাত্র পঁচিশটা হয়েছে। পৌণে তিনশটা ভুল! স্যার জিজ্ঞেস করলেন, কিরে কয়টা?

-পঁচিশটা ঠিক হইছে।

স্যার এবার আশ্চর্য কোমল স্বরে বললেন, বুঝছস তর অবস্থাটা? এখন কি করতে হবে?

আমি চুপ করে আছি। স্যার বললেন, শোন প্র্যাকটিস করতে হবে। তারপর আমাকে ভয়েস চেঞ্জ সম্বন্ধে বললেন। কী করে ভয়েস চেঞ্জ করতে হয় তার নিয়মকানুনগুলি বিশদ বললেন। তারপর বললেন, কাল প্রথম পঁচিশটা করে নিয়ে আসবি।

পরদিন নিয়ে গেলাম হোমটাস্ক। অর্ধেক হয়েছে। এরপর পরের দিন পাঁচটা ভুল হয়েছে। এরপর আস্তে আস্তে দু’একটা। এরমধ্যেও আমি স্যারের কাছে পড়তে না এসে নদীর পাড়ের ক্রিকেট দলে যোগ দিয়েছি। আর নন্দ হারামীটা স্যারের কাছে এসে বলে দিয়েছে, স্যার অমলকে দেখলাম নদীর পড়ে ক্রিকেট খেলছে। একদিন স্যার বললেন, তর যে এই অবস্থা আরও আগে আমার কাছে তর আসা উচিৎ ছিল। আমি বললাম, আপনাকে খুব ভয় করে। স্যার তাঁর স্বভাবসুলভ বাজখাই ভঙিতে বললেন, ব্যাটা আমি কি বাঘ নাকি? ভয় পাস!

স্যার কবে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছেন। এরপর এই আমি, পৌণে তিনশ ভয়েস চেঞ্জ ভুল করা মানুষটা ঢাকার পত্রিকায় ইংরেজিতে কবিতা লিখেছি। আমার অনুবাদ করা নিজের কবিতা ইংরেজি কবিতা সংকলনে ছাপা হয়েছে। ছোটদের জন্য লেখা ইংরেজি বই প্রকাশিত হয়েছে। অগুনতি অনুবাদ করা ফিচার প্রকাশ হয়েছে। অল্প কয়েকটা দিনের জন্য বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের বেঞ্চে বসারও সৌভাগ্য হয়েছে। যেখানে দু’চার অক্ষর ইংরেজি লিখেছি প্রতিবার পঙ্কজ স্যারের কথা মনে হয়েছে। স্যারকে দেখালে স্যার নিশ্চয়ই অনেক খুশি হতেন। স্যার যদি জোর করে বাবাকে বলে তাঁর কাছে না নিয়ে যেতেন হয়তো ইংরেজি ভাষাটা অনেকের মতো আমার কাছেও অনেকটা দুর্বোধ্য হয়ে থাকতো। তিনি আমার ভয়টা কাটিয়ে দিয়ে একটা আলোর পথে তুলে দিয়ে গিয়েছেন। স্যার আপনাকে আমার অশেষ প্রণতি।

আমরা মান্নান স্যারকে খুব ভালবাসতাম। বেটেখাটো একটু মোটা ধরনের ফর্সা মানুষটি। অন্যান্য স্যাররা যেখানে মলিন ধুতি ফতুয়া কিংবা পায়জামা পাঞ্জাবী পরে স্কুলে আসতেন সেখানে মান্নান স্যার খুব চোস্ত পোষাক পরে স্কুলে আসতেন। শীতের দিনে কোট টাই পাম্পসু পরে আসতেন। হয়তো স্যারের বাড়ির অবস্থা বেশ ভাল ছিল। তখন মফস্বলে কেউ কেউ মান সম্মানের জন্যই স্কুল কলেজের শিক্ষক হতেন। যা বলছিলাম। মান্নান স্যার বিদ্যাসাগর ছিলেন কিনা জানিনা কিন্তু তিনি ছিলেন দয়ার সাগর। প্রকৃত ‘ছাত্রবন্ধ’ু। তিনি স্কুলের বিভিন্ন পরীক্ষার সময় পাশে এসে দাঁড়াতেন। দেখতেন কীভাবে অঙ্ক করছি। অঙ্কটা মিলছে না। স্যার এবার মাথা টান করে সামনের দিকে তাকিয়ে বলতেন, গর্ধভ, বি স্কয়ারের মানটা আগে বসা তারপর সি এর মান দিয়ে ভাগ কর। তারপর আবার হাঁক দিতেন, এই কেউ মাথা ঘুরাবি না। তরে না বললাম সি এর মান বসা! তারপর অঙ্ক মিললে বলতেন, নে আরেকটা ধর, বলে সামনে চলে যেতেন। তারপর হয়তো আবার অন্য কোন ছাত্রের পাশে গিয়ে দাঁড়াতেন। এজন্যই মান্নান স্যারকে আমি মনে মনে ‘ছাত্রবন্ধু’ উপাধি দিয়েছি।

তবে আমাদের পন্ডিত স্যার কোথা থেকে যে এতোবড় একটা বেত সংগ্রহ করেছেন তা আজও চুয়াল্লিশ বছর পর অবাক হয়ে ভাবি! বেতটার সাইজ ছিল লম্বায় ছয় সাত ফুট। ঐ বেতটা শুধু পরীক্ষার হলেই ডিউটি দেবার সময় আনতেন। অন্য সময় স্বাভাবিক সাইজ। বেতটা সাপের মতো লিকলিক করতো। পন্ডিত স্যার দু’ পাশের বেঞ্চের মাঝখানে দাঁড়িয়ে অনায়াসেই দেয়ালের দিকে বসা ছাত্রকে নাগালের মধ্যে পেয়ে যেতেন। পন্ডিত স্যারের পরীক্ষা হলের ডিউটির সময় একটা অতি পরিচিত শব্দ ছিল, কতক্ষণ পর পর বলতেন, ইয়ো সাইলেন্ট। তবে আমাদের এসিস্টেন্ট হেড স্যার ছিলেন মজিদ স্যার। মজিদ স্যারও ইংরেজি পড়াতেন। তাঁর ব্যক্তিত্ব এতো প্রবল ছিল যে ক্লাশে ঢুকলে সব ছাত্র নাকের নিঃশ্বাসটাও মেপে ফেলতো। পরে স্যার অনেক বছর আমাদের স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন। স্যার ছিলেন ইস্পাতের মতো ছিপছিপে দেহের মানুষ। লালচে চোখ দুটো! ওফ! ভয়াবহ রকমের দৃষ্টি! যার দিকে কালো ফ্রেমের চশমার ফাঁক দিয়ে তাকাতেন তার বুকের এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে যেতো। আমি বাজি ধরে বলতে পারি, এখনও কোন দুর্নীতিবহুল প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসাবে স্যারকে বসিয়ে দিলে সাত দিনে সব বাপ বাপ করে ঠান্ডা হয়ে যেতো। আমি স্যারের কাছ থেকে আমার সম্বন্ধে একটাই মন্তব্য পেয়েছিলাম। এখনো কানে বাজে। ইংরেজি আচমকা ক্লাশ টেস্টে আমি খাতা দেইনি। স্যার বের হয়ে যাবার সময় আমার দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে সংক্ষেপে বলেছিলেন, অসৎ! যথার্থ মন্তব্য। মজিদ স্যারও চলে গেছেন আজ হতে পঁচিশ বছর আগে। স্যার আপনাকে আমার মনে পড়ে, আপনি ঠিকই বলেছিলেন। আমি পড়ালেখায় বরাবরই অসৎ। সৎ হতে পারিনি। সেজন্য জীবনে চুড়ান্ত ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে।

কিন্তু আমাদের হেডমাস্টার চিত্ত স্যার ছিলেন একদম অন্যরকম মানুষ। তার ব্যক্তিত্বটা ছিল অন্যরকমের। মাইডিয়ার ঘরানার। তিনি নির্দিষ্ট করে কোনো ক্লাশ নিতেন না। কিন্তু যেদিন নিতেন সে ক্লাশটায় আমাদের ফুরফুরে ফাগুনের হাওয়া বয়ে যেতো। তিনি ক্লাশের দরজা দিয়ে ঢুকেই ঝট করে সামনের বেঞ্চের ছাত্রদের কাছ থেকে একটা বই উঠিয়ে নিতেন। সেটা বাংলা হোক, ইংরেজি হোক বা সমাজ বিজ্ঞান হোক। কেউ হয়তো বলতো, স্যার এখন আমাদের বাংলা পিরিয়িড। হেড স্যার সেসব কথার ধার কাছ দিয়েও যেতেন না। ঝড়ের বেগে পড়ানো শুরু করতেন বই না দেখেই হয়তো বাংলা বা ইংরেজি কবিতা বা সমাজবিজ্ঞান। সেদিন কোনো পড়া দেয়া লাগতো না। ভয় লাগতো না। শুধু আনন্দ আর আনন্দ। স্যার মনের আনন্দে পড়িয়ে যেতেন আমরাও মনের আনন্দে শুনে যেতাম। স্যারের কোনো সংসার ছিলনা। চিরকুমার মানুষ। অসহ্য রকমের ধবধবে ফর্সা। সাদা ফিনফিনে পাঞ্জাবী আর ধুতি পড়তেন। বড় ক্লাশে উঠে আমরা কৌতুহল বোধ করতাম, এতো সুন্দর মানুষ বিয়েশাদী করলেন না কেন? তবে আমাদের মাঝে একটা কানাঘুষা ছিল, স্যারকে কোনো মেয়ে ছ্যাঁক দিয়েছে তাই আর বিয়ে করেননি। কিন্তু কার এতো বড় বুকের পাটা এরকম একজন সুদর্শনকে ফিরিয়ে দিয়েছে সে নায়িকার কোনো সুলুকসন্ধান আমরা কোনোদিন পাইনি। স্যারের শবযাত্রায় যে পরিমাণ লোক হয়েছিল চাঁদপুরের আর কোনো মানুষের অন্তিম যাত্রার সময়ে সে পরিমাণ লোক আর হয়নি।

কালীপদ স্যারের কথা না বললেই নয়। স্যার আমরা যারা হায়ার ম্যাথ নিয়েছিলাম তাদের স্যার বিনা পয়সায় পড়াতেন প্রতি রবিবার। রবিবার তখন স্কুল বন্ধ থাকতো। কিন্তু আমি আর আমার মতো এক কুলাঙ্গার বন্ধু স্কুলের সামনে খাতাপত্র নিয়ে যেতাম কিন্তু সেই বিনা পয়সার প্রাইভেটও পড়তে যেতাম না। যারা পড়তো তারা বেরিয়ে এলে ওদের বাসায় চলে যেতাম। বলতাম, দে অঙ্কগুলি খাতায় উঠিয়ে দে বাসায় গিয়ে পরে দেখবোনে। ওরা অঙ্ক উঠাতো আর আমরা ওদের বাসায় ওদের মায়ের দেওয়া খাওয়াদাওয়া খেতাম। সেই ওঠানো অঙ্ক আর আমাদের ইহজন্মে দেখা হয়নি।

আমাদের স্কুলের সামনে একজন আচারওলা বসতো। আমরা ছয় সাতশ ছাত্র তার কাস্টমার ছিলাম। এবং সবাই আচারওলার কাছ থেকে বাকী খেতো। আবার সে বাকীর হিসাব রাখার কোনো খাতাও ছিলনা! কিন্তু সারাবছরই বাকী চলতো। আচার মানে রং আর স্যাকারিন দিয়ে চালতা, বড়ই বা জলপাই সিদ্ধ। তাই সবাই অমৃতজ্ঞানে খেতো। বাকীর হিসাবটা ছিল এরকম, আচার কিনতে গেলেই আন্দাজেই আচারওলা বলতো, এ্যাই তর কাছে আট আনা পাই। যে কাস্টমার ছিল তারতো হিসাব নাই কবে কত খেয়েছে। সে বলতো ইস্ আট আনা! আপনি পান চার আনা। আচারওলা তখন বলতো ওঃ আইচ্ছা দে আগের পয়সা দে। মাননীয় ক্রেতা তখন বলতো এই নেন বিশ পাই (পয়সা)। বাকীটা কাল দিবো। বলে আবার দশ পয়সার আচার বাকী খেয়ে নিতো। এতে আচারওলার লাভই থাকতো। কারণ তখন একটা চালতার দাম ছিল দশ পয়সা। জলপাই এক টাকা কেজি। রং আর স্যাকারিন দিয়ে সিদ্ধ ছোট একটা চালতার টুকরা আর জলপাই একটা দশ পয়সা করে বিক্রি করলেও দু’শ তিন’শ পার্সেন্ট লাভ। মানে ঘোষ মশাই বাজারে মাঠা বিক্রি শেষ করে যেমন বলে, আনছিলাম এক কলস, বিক্রি করলাম দুই কলস বাড়ি ফেরত নিয়ে যাইতাছি এক কলস! ঐ রকম আরকি। তবে আচারওলার বাকী শেষ করে কেউ স্কুল ত্যাগ করেছে এমন রেকর্ড নাই। চাঁদপুর পুরানবাজারের ঐ সময়ের শতকরা নব্বই জন ব্যবসায়ী, আমলা, উকিল, কেরানি, ধান্দাবাজ, নেতা, ব্যারিস্টার, প্রকৌশলী যারা দেশে বিদেশে ছড়িয়ে আছে তারা সবাই আচারওলার কাছে বাকী-খেলাপি। কেন ঐ সময়ে এইসব ছাইমাটি এতো স্বাদ লাগতো কে জানে? আচার খেতে গিয়ে অনেক সময় অনেকবার জামায় আচারের দগদগে হলুদ রঙ লাগিয়ে ফেলতাম। বাড়ি আসার পথে নদীতে ধুয়ে চিপড়ে সে রঙ বিলুপ্ত করার চেষ্টা করতাম। কিন্তু মা আর আমার বিধবা পিসিমার বকা থেকে নিস্তার মিলতো কমই। পিসিমা ছিলেন আমাদের পড়ালেখার হাতেখড়ির অভিভাবক। তাকে ভয় পেতো আমার বাবা মাও। সে এক অন্য অধ্যায়।

প্রথম দিককার ক্লাশগুলিতে আমরা ভাল ছাত্র হিসাবেই পরিচিত ছিলাম। আমাদের কুলাঙ্গার দলটার ক্লাশে প্লেস থাকতো। ক্লাশে ফার্স্ট সেকেন্ড থার্ড আমরাই হ’তাম। কিন্তু যেইনা ক্লাশ এইটে ওঠলাম দেখি কিছু ছাত্র ভাল হয়ে উঠলো আর আমরা মর্নিং শো, বিড়ি খাওয়া, রাস্তায় ঘোরা, নৌকা বাওয়া, সকালসন্ধ্যা তাসখেলা, দিনমান ক্রিকেট খেলা, ফুটবলখেলা ইত্যাদি বড় বড় কার্যে নিযুক্ত হয়ে গেলাম। এরমধ্যে সবচেয়ে কেরাসিন অবস্থা হলো বঙ্কুর (নামটা ছদ্ম। এখন সে এক ছেলের শ্বশুরমশাই) সে একদিন আমার বাসায় রাতে শুতে এসে বললো, অমল, বাবা বলছে আর আমাকে পড়াবে না। আমি বললাম কেন? বঙ্কু জানালো, এবার আমি আট বিষয়ে ফেল করেছি। আমাকে দোকান দিয়ে দেবে। আমি একটু দুঃখিত হলাম বঙ্কুর জন্য, এটা সত্যিই বিপর্যয়কর অবস্থা। দশ বিষয়ের মধ্যে আট বিষয়ে ফেল! এই ছাত্রেরতো হওয়া উচিৎ জেল।

আমাদের ক্লাশের ফার্স্ট বয় ছিল কাদির। আব্দুল কাদির। লেখাপড়ায়, দেখতে সবই ঈশ্বর ওকে দিয়েছিল হাত ভরে। সম্পন্ন ঘরের ছেলে। ওর একটা কৌতুহল ছিল হিন্দুদের আনসারকামসাইজড্ জেনিটাল পার্টসের প্রতি। মানে দেখতে কেমন হয়? আমিও দু একবার দেখিয়েছি ওকে। ও খিকখিক করে হাসতো। কেন জানি বিধাতা আর ওর জীবনটা তেমন সহজ করে রাখলেন না। আরম্ভটা যেমন ছিল তেমনটা আর থাকেনি। পড়লেখাটাও আর তেমন করে আগালো না। অথচ স্কুল পেরিয়ে ওইই প্রথম ঢাকায় এসে নামকরা কলেজে ভর্তি হয়েছিলো। চারদিক থেকে সব ভালগুলি হারিয়ে গিয়েছিল ওর জীবন থেকে। জীবনের সব জৌলুস যেন মিলিয়ে গিয়েছিল। ভাল ছিল না একদম। কে যেন বলেছিল, মর্নিং শোজ দ্য ডে। তারপরেও যখন চাঁদপুর যেতাম তীর্থযাত্রার মতো দেখা করতাম ওর সাথে। আরও দু একজনকে ডেকে গল্পে আড্ডায় মেতে উঠতাম কোন চা বা মিষ্টির দোকানে রাত ১২টা ১টা অব্দি। লাইফ ইজ ফুল অব ফান, নাথিং এলস্। কাদির ছিল ঘোর সংসারী। চার চারটি ছেলেমেয়ে। দাড়ি রেখেছে বুক পর্যন্ত। কিন্তু আড্ডা শেষ করে ফেরার সময় কানের কাছে মুখ এনে বলতো, দোস্ত আগের মতই আছেনা! হা হা হা......সেই কাদিরটা বছর দুয়েক আগে স্ট্রোক করে কোনো সংকেত না দিয়েই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে। মর্মান্তিক হলো এর সাত দিন পর ওর ছোট ভাইটাও একই পথে পা বাড়ালো। দুই ভাই প্রায়শই একসাথে স্কুলে আসতো। দু’ভাই একসাথেই অনন্তের পথে পা বাড়িয়েছে।

আমার এবং আমার বন্ধুদের স্কুলে পড়ালেখা কেন যে ভাল লাগতো না সেটা একটা রহস্যময় বিষয়। অন্য বই পড়তাম বুদ হয়ে। ঐ সময়টায় পড়ালেখা ছাড়া আর সবই করেছি।

ইলিয়াস স্যার একদিন বললেন, তোরা আর পড়ালেখা করে সময় নষ্ট করিস না বাপের দোকানে গিয়ে বস। আর স্কুলটাকে রেহাই দে। ক্লাশমেট শফিক ছিল চটপটে, সে দাঁড়িয়ে বললো, স্যার আমার বাবারতো দোকান নাই। স্যার বললেন, দোকান দে। যাদব স্যার আমাদের নিম্নগতির অবস্থা দেখে আমাদের বলতে লাগলেন, তোরা এখন আর ছাত্র না, তোরা হলি ছত্র। সেই ‘ছত্র’রা দু একজন ছাড়া আজ অনেকেই রিয়েল এস্টেটের ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, বিদেশে প্রতিষ্ঠিত মানুষ। এখনও কালেভদ্রে যতবার চাঁদপুর যাই ততবারই আমাদের সাদামাটা স্কুলটার কাছে যাই। গিয়ে অপলকে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকি। বিল্ডিংয়ের গায়ে লেখা নামটা পড়ি, ‘পুরানবাজার এমএইচ (মধুসূসদন) হাই স্কুল’! আমার জ্ঞানতীর্থ। কত বর্ষা, কত হেমন্ত, শীত বসন্ত এই স্কুলের আঙিনায় কেটেছে! স্যারদের মুখগুলির কথা মনে পড়ে। স্কুলমেটদের কথা মনে পড়ে।

আরও আরও কত কথা বাকী রয়ে গেল স্কুলবেলার। এরমধ্যে আমাদের সব শিক্ষকগণই প্রয়াত হয়েছেন। ক্লাশমেটদেরও এরমধ্যে অনেকের চলে যাওয়ার খবর পাচ্ছি। জীবনের এই পর্যায়ে এসে আর কোন আফসোস নেই। সবই জীবনের অংশ বলে মনে হয়। জীবন আমাকে তার সব পশরাই উন্মোচিত করেছে আকন্ঠ পান করার জন্য। আমার স্কুল দীর্ঘজীবী হোক।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়