বুধবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫  |   ৩১ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৯:৩৯

সঙ্গীতের স্পন্দন ফিরিয়ে আনা : বাদ্যযন্ত্রের বাজারকে পুনরুজ্জীবিত করার উপায়

ক্ষুদীরাম দাস
সঙ্গীতের স্পন্দন ফিরিয়ে আনা : বাদ্যযন্ত্রের বাজারকে পুনরুজ্জীবিত করার উপায়

সময়ের গতিতে সঙ্গীতের স্পন্দনেও পরিবর্তন এসেছে। বাদ্যযন্ত্রের দোকানের নীরবতা কেবল একটি বাণিজ্যিক সঙ্কট নয়; বরং আমাদের সমাজের সাংস্কৃতিক স্থবিরতার প্রতিচ্ছবি। একসময় এলিফ্যান্ট রোড, শাঁখারীবাজারের মতো জায়গাগুলো গিটার, তবলা ও হারমোনিয়ামের সুরে মুখরিত থাকতো। কিন্তু আজ সেই প্রাণবন্ততা প্রায় অনুপস্থিত। করোনা মহামারী এবং পরবর্তী অর্থনৈতিক মন্দা এ পরিস্থিতিকে আরো গভীর করেছে। বড় কনসার্ট ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের অনুপস্থিতি; নতুন প্রজন্মের বাদ্যযন্ত্র শিক্ষার আগ্রহ কমে যাওয়া; এবং কম দামে নিম্নমানের পণ্যের সহজলভ্যতাÑএসব কিছুই মিলেমিশে বর্তমান সঙ্কটের জন্ম দিয়েছে। এ সঙ্কট থেকে উত্তরণের জন্যে প্রয়োজন একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টা। শুধুমাত্র ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়; বরং প্রয়োজন সাংস্কৃতিক নীতি সংস্কার, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের সদ্ব্যবহার এবং সমাজের প্রতিটি স্তরে সঙ্গীতের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি। এ বিষয়গুলোর ওপর মনোযোগ দিলেই বাদ্যযন্ত্রের বাজারকে আবার তার পুরোনো প্রাণ ফিরিয়ে আনা সম্ভব। এলিফ্যান্ট রোড, শাঁখারীবাজার, বা বসুন্ধরা সিটির বাদ্যযন্ত্রের দোকানগুলো কেবলই বাণিজ্যিক কেন্দ্র নয়, বরং আমাদের সঙ্গীত ও সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র। যেখানে গিটার, তবলা, হারমোনিয়ামের সুরের মূর্ছনা বেজে ওঠে, সেখানে মানুষের আবেগ, শিল্পচেতনা এবং পেশাদারিত্বের এক মিশ্র রূপ দেখা যায়। কিন্তু আজ সেই প্রাণবন্ত পরিবেশের অনুপস্থিতি আমাদের একটি গভীর প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়েছে : আমরা কি সঙ্গীতকে কেবল বিনোদন হিসেবেই দেখছি; নাকি এর অর্থনৈতিক এবং সামাজিক গুরুত্বকে উপেক্ষা করছি?

বর্তমান এ স্থবিরতাকে শুধুমাত্র একটি সাময়িক সঙ্কট হিসেবে দেখলে ভুল হবে। করোনা মহামারীর সময় থেকে শুরু হওয়া এ দীর্ঘমেয়াদী মন্দা আসলে আমাদের সাংস্কৃতিক চর্চার দুর্বলতা এবং দূরদর্শী পরিকল্পনার অভাবকেই ফুটিয়ে তোলে। বড় বড় কনসার্ট, ছোট আকারের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শিল্পীরা যেমন মঞ্চ হারিয়েছেন, তেমনি বাদ্যযন্ত্রের বাজারও ক্রেতা হারিয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন প্রজন্মের মধ্যে বাদ্যযন্ত্র শেখার আগ্রহ কমে যাওয়া। স্মার্টফোন এবং ডিজিটাল বিনোদনের সহজলভ্যতা তরুণদের আকর্ষণ করছে, যেখানে বাদ্যযন্ত্র শেখার জন্য যে ধৈর্য ও পরিশ্রম প্রয়োজন, তা অনেক ক্ষেত্রেই উপেক্ষিত হচ্ছে। পাশাপাশি, অনলাইন মার্কেটপ্লেসে সহজলভ্য ও কম দামের নিম্নমানের বাদ্যযন্ত্রগুলোও এ সঙ্কটকে আরো বাড়িয়েছে। যারা নতুন করে বাদ্যযন্ত্র শিখতে চান, তারা প্রায়শই সস্তা এবং খারাপ মানের পণ্য কিনে হতাশ হন; যার ফলে বাদ্যযন্ত্র শেখার আগ্রহ দ্রুতই হারিয়ে যায়। কিন্তু এ পরিস্থিতিকে কেবল হতাশ হয়ে মেনে নিলে চলবে না; বরং, এটিকে একটি সুযোগ হিসেবে দেখা যেতে পারে, যেখানে আমরা নতুন করে ভাবতে পারি এবং নতুন কৌশল প্রয়োগ করতে পারি। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মকে কাজে লাগিয়ে অনলাইন ক্লাস ও ওয়ার্কশপের আয়োজন করা, স্থানীয় শিল্পীদের নিয়ে ছোট আকারের অনুষ্ঠান করা এবং বাদ্যযন্ত্রের গুণগত মান নিশ্চিত করার মাধ্যমে এ শিল্পকে আবার পুনরুজ্জীবিত করা সম্ভব। এ সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজতে হলে আমাদের নিজেদের সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক কাঠামোকে নতুন করে সাজাতে হবে।

বর্তমান ডিজিটাল যুগে বাদ্যযন্ত্রের বাজারকে পুনরুজ্জীবিত করতে হলে অনলাইন প্ল্যাটফর্মের যথাযথ ব্যবহার অপরিহার্য। ঐতিহ্যবাহী দোকানগুলো এখন কেবল শারীরিক উপস্থিতির ওপর নির্ভরশীল না হয়ে ডিজিটাল মাধ্যমকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে পারে। এক্ষেত্রে প্রতিটি দোকানের নিজস্ব ই-কমার্স ওয়েবসাইট থাকা আবশ্যক, যেখানে পণ্যের বিস্তারিত তথ্য, ছবি ও ভিডিও থাকবে। একই সঙ্গে, অ্যামাজন, দারাজ বা অন্যান্য জনপ্রিয় অনলাইন মার্কেটপ্লেসের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ব্যাপক সংখ্যক ক্রেতার কাছে পৌঁছানো সম্ভব। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, যেমনÑফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব ও টিকটক, বাদ্যযন্ত্রের প্রচারের জন্যে শক্তিশালী হাতিয়ার হতে পারে। এ প্ল্যাটফর্মগুলোতে লাইভ সেশন করে নতুন গিটারের ডেমো, তবলার বোল শেখানো বা ড্রামের সাউন্ড টেস্টের মতো কার্যক্রম ক্রেতাদের আকর্ষণ করবে। এছাড়া, বাদ্যযন্ত্রের দোকানগুলো নিজেরাই অভিজ্ঞ প্রশিক্ষক দিয়ে অনলাইন ক্লাস বা ওয়ার্কশপের আয়োজন করতে পারে। এর মাধ্যমে একদিকে যেমন নতুন শিক্ষার্থী তৈরি হবে, তেমনি বাদ্যযন্ত্রের বিক্রিও বাড়বে। অনলাইনে বাদ্যযন্ত্র কেনার আগে অনেকেই এর সাউন্ড কোয়ালিটি নিয়ে নিশ্চিত হতে চান। তাই, প্রতিটি পণ্যের জন্য মানসম্পন্ন অডিও ও ভিডিও ক্লিপ আপলোড করা জরুরি। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে বাদ্যযন্ত্রের বাজারকে একটি নতুন দিগন্তে নিয়ে যাওয়া সম্ভব, যেখানে ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতা আর কোনো বাধা থাকবে না। আধুনিক বিশ্বে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মকে উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই। বাদ্যযন্ত্রের বাজারকে পুনরুজ্জীবিত করতে অনলাইন প্ল্যাটফর্মকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। প্রতিটি বাদ্যযন্ত্রের দোকানের নিজস্ব ই-কমার্স ওয়েবসাইট থাকা উচিত। পাশাপাশি, অ্যামাজন, দারাজ বা অন্যান্য জনপ্রিয় অনলাইন মার্কেটপ্লেসের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পণ্য বিক্রি করলে ক্রেতার সংখ্যা অনেক বাড়বে। এক্ষেত্রে শুধুমাত্র বাদ্যযন্ত্র নয়, এর আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র যেমনÑতার, পিক, স্ট্যান্ড, কেসিং ইত্যাদিও বিক্রি করা যেতে পারে। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব ও টিকটকের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো ব্যবহার করে বাদ্যযন্ত্রের প্রচার করা যেতে পারে। লাইভ সেশন করে গিটারের ডেমো দেখানো, তবলার বোল শেখানো বা নতুন কোনো বাদ্যযন্ত্রের সাউন্ড টেস্ট করানোÑএসব কর্মকাণ্ড ক্রেতাদের আকর্ষণ করবে। বাদ্যযন্ত্রের দোকানগুলো নিজেরাই অনলাইন ক্লাস বা ওয়ার্কশপের আয়োজন করতে পারে। অভিজ্ঞ প্রশিক্ষক দিয়ে গিটার বা তবলার প্রাথমিক জ্ঞান দেওয়া যেতে পারে। এতে একদিকে যেমন নতুন শিক্ষার্থী তৈরি হবে, তেমনি বাদ্যযন্ত্রের বিক্রিও বাড়বে।

বাদ্যযন্ত্রের বাজারকে কেবল বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে হবে না, এর সঙ্গে জড়িত একটি বৃহত্তর কমিউনিটি। এ কমিউনিটিকে শক্তিশালী করতে কিছু সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া অপরিহার্য। বাদ্যযন্ত্রের দোকানগুলো নিজেদেরকে শুধুমাত্র পণ্যের বিক্রয়কেন্দ্র হিসেবে সীমাবদ্ধ না রেখে, এটিকে একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। এর একটি কার্যকর উপায় হলো দোকানের সঙ্গে ছোট আকারের মিউজিক স্টুডিও বা প্র্যাকটিস রুম খোলা। নতুন বাদ্যযন্ত্র কেনা বা শেখার আগ্রহীদের জন্য এটি একটি দারুণ সুবিধা হবে। তারা সেখানেই অনুশীলন করতে পারবে, যা দোকানের প্রতি তাদের আনুগত্য বাড়াবে এবং একটি দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক তৈরি করবে। এছাড়া, দোকানগুলো কমিউনিটি ইভেন্ট ও ওপেন মাইক সেশনের আয়োজন করতে পারে। দোকানের সামনে বা কাছাকাছি কোনো খোলা জায়গায় এই ধরনের ছোট আকারের অনুষ্ঠান করা যেতে পারে, যেখানে নতুন এবং অভিজ্ঞ শিল্পীরা পারফর্ম করার সুযোগ পাবেন। এ ধরনের উদ্যোগ স্থানীয় মানুষদের মধ্যে সঙ্গীতের প্রতি আগ্রহ তৈরি করবে এবং দোকানের প্রতি আকর্ষণ বাড়াবে। পাশাপাশি, বিভিন্ন স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে অংশীদারিত্ব স্থাপন করে বাদ্যযন্ত্র প্রদর্শনী বা কর্মশালার আয়োজন করা যেতে পারে। এতে নতুন প্রজন্মের মধ্যে বাদ্যযন্ত্রের প্রতি আগ্রহ তৈরি হবে এবং তারা এটি শেখার জন্য উৎসাহিত হবে। এ ধরনের সাংস্কৃতিক উদ্যোগগুলো বাদ্যযন্ত্রের বাজারকে কেবল পুনরুজ্জীবিতই করবে না, বরং সমাজের সাংস্কৃতিক ধারাকে আরো গতিশীল করে তুলবে। তাছাড়া দোকানগুলোর সঙ্গে ছোট আকারের মিউজিক স্টুডিও বা প্র্যাকটিস রুম খোলা যেতে পারে। যারা নতুন বাদ্যযন্ত্র কিনবেন, তারা সেখানেই অনুশীলন করতে পারবেন। এর ফলে দোকানের সঙ্গে ক্রেতার একটি দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক তৈরি হবে। দোকানগুলোর সামনে বা কাছাকাছি স্থানে ছোট আকারের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা যেতে পারে। এখানে নতুন শিল্পীরা পারফর্ম করার সুযোগ পাবেন। এ ধরনের 'ওপেন মাইক' ইভেন্টগুলো মানুষকে উৎসাহিত করবে এবং দোকানের প্রতি তাদের আগ্রহ বাড়বে।

বাদ্যযন্ত্রের বাজারকে চাঙ্গা করতে হলে শুধু বর্তমান ক্রেতাদের ওপর নির্ভর করলে চলবে না, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে আগ্রহ তৈরি করাও জরুরি। এ লক্ষ্য পূরণে স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে অংশীদারিত্ব স্থাপন একটি অত্যন্ত কার্যকর কৌশল হতে পারে। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বাদ্যযন্ত্রের দোকানগুলো প্রদর্শনী ও কর্মশালা আয়োজন করতে পারে। এ প্রদর্শনীতে বিভিন্ন ধরনের বাদ্যযন্ত্র যেমনÑগিটার, কিবোর্ড, ড্রামস, তবলা, বাঁশি ইত্যাদির গুণাগুণ ও ব্যবহারবিধি তুলে ধরা যেতে পারে। শিক্ষার্থীরা হাতে-কলমে যন্ত্রগুলো বাজিয়ে দেখার সুযোগ পেলে তাদের মধ্যে এক ধরনের কৌতূহল ও আগ্রহ তৈরি হবে। কর্মশালাগুলো হতে পারে আরো বেশি ফলপ্রসূ। অভিজ্ঞ সঙ্গীতশিল্পীদের দিয়ে কর্মশালা পরিচালনা করা যেতে পারে, যেখানে তারা বাদ্যযন্ত্র শেখার গুরুত্ব, এর মাধ্যমে সৃজনশীলতার বিকাশ এবং পেশা হিসেবে সঙ্গীতের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করবেন। এ ধরনের উদ্যোগগুলো শিক্ষার্থীদের কেবল বিনোদনের জন্যে নয়, বরং একটি শখ বা পেশা হিসেবে বাদ্যযন্ত্র শেখার প্রতি উৎসাহিত করবে। এছাড়া বিভিন্ন স্কুলের বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বা মিউজিক ক্লাবে বাদ্যযন্ত্র সরবরাহ করার জন্যে বিশেষ প্যাকেজ বা ছাড় দেয়া যেতে পারে। এতে করে স্কুলগুলো সহজে বাদ্যযন্ত্র সংগ্রহ করতে পারবে এবং শিক্ষার্থীরাও তা থেকে উপকৃত হবে। এ ধরনের অংশীদারিত্বের মাধ্যমে বাদ্যযন্ত্রের দোকানগুলো নিজেদের একটি নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে এবং একই সঙ্গে একটি নতুন ক্রেতাগোষ্ঠী তৈরি হবে। এটি কেবল একটি বাণিজ্যিক চুক্তি নয়, বরং সমাজের সাংস্কৃতিক বিকাশে একটি দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ।

সরকারের সহায়তা ছাড়া বাদ্যযন্ত্রের বাজারকে পুরোপুরি চাঙ্গা করা সম্ভব নয়। কিছু সুনির্দিষ্ট নীতিগত পরিবর্তন ও সহায়তা এ শিল্পকে বাঁচাতে পারে। বড় বড় কনসার্ট, ছোট আকারের সংগীত আসর, এবং লোকাল পারফরম্যান্সের অনুমতি দেওয়া প্রয়োজন। সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয় থেকে এসব আয়োজনের জন্য বিশেষ সুবিধা দেওয়া যেতে পারে। বাদ্যযন্ত্রের ব্যবসায়ীদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে, যাতে তারা এ কঠিন সময়ে টিকে থাকতে পারেন। একই সঙ্গে, নতুন উদ্যোক্তাদের জন্যও বিশেষ ঋণ সুবিধা দেয়া উচিত। বাদ্যযন্ত্র নির্মাণে যুক্ত কারিগরদের আর্থিক সহায়তা দেয়া এবং তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্যে প্রশিক্ষণ কর্মসূচির আয়োজন করা যেতে পারে। এতে এ শিল্পে দক্ষ জনবল তৈরি হবে।

কম দামে নিম্নমানের বাদ্যযন্ত্রের সহজলভ্যতা একটি বড় সমস্যা। এ সমস্যা মোকাবিলায় দেশীয় বাদ্যযন্ত্রের গুণগত মান বৃদ্ধি করা অপরিহার্য। প্রতিটি দোকানে বাদ্যযন্ত্রের গুণগত মান নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে বিশেষ ছাড় দিয়ে হলেও ভালো মানের পণ্য বিক্রি করতে হবে। ক্রেতাকে বোঝাতে হবে যে ভালো মানের বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করলে শেখার আগ্রহ বাড়ে। বাদ্যযন্ত্রের ডিজাইন ও কার্যকারিতায় আধুনিক প্রযুক্তি যুক্ত করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, এমন গিটার তৈরি করা যেতে পারে যা সহজে পোর্টেবল, বা এমন হারমোনিয়াম যা আধুনিক সাউন্ড সিস্টেমের সঙ্গে যুক্ত করা যায়। বাদ্যযন্ত্র বিক্রি করার পর ক্রেতাকে ভালো মানের বিক্রয়োত্তর সেবা দেয়া উচিত। যেকোনো ধরনের মেরামতের প্রয়োজন হলে দ্রুত এবং সহজে সমাধান দেওয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে।

সঙ্গীত কেবল একটি বিনোদনের মাধ্যম নয়, এটি মানব মনের গভীরতম স্তরে প্রভাব ফেলতে সক্ষম একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। সুর, তাল এবং লয়ের সমন্বয়ে তৈরি এ শিল্প আমাদের চেতনাকে বিকশিত করে এবং মানসিকতার পরিবর্তনে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একটি গান যখন আমাদের হৃদয়ে প্রবেশ করে, তখন তা কেবল কানের মধ্যদিয়ে নয়; বরং আত্মার মধ্যদিয়ে অনুরণিত হয়। আমরা যখন কোনো গান শুনি, তখন তা’ আমাদের মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশকে উদ্দীপিত করে। গবেষণায় দেখা গেছে, সঙ্গীত মস্তিষ্কের এমন কিছু অংশকে সক্রিয় করে যা’ স্মৃতি, আবেগ এবং ভাষা নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে যুক্ত। এর ফলে, জটিল বিষয়গুলো সহজে বোঝা এবং মনে রাখার ক্ষমতা বাড়ে। উদাহরণস্বরূপ, ছোটবেলায় আমরা ছড়ার মাধ্যমে যেসব পড়া শিখি; তা সহজে মনে রাখতে পারি কারণ সেখানে সুর ও ছন্দ থাকে। একইভাবে, জটিল বৈজ্ঞানিক তথ্য বা ঐতিহাসিক ঘটনাও যদি সুরে বাঁধা হয়, তবে তা আমাদের মস্তিষ্কে সহজে গেঁথে যায়। সঙ্গীত আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যেও অপরিহার্য। যখন আমরা বিষণ্ন বা হতাশ থাকি, তখন একটি শান্ত বা আনন্দময় গান আমাদের মনকে হালকা করতে পারে। আবার, কঠিন সময়ে অনুপ্রেরণামূলক গান আমাদের মনোবল বাড়াতে সাহায্য করে। সঙ্গীতের এ ক্ষমতা আমাদের মানসিকতাকে ইতিবাচক দিকে পরিচালিত করে। এটি আমাদের আত্মবিশ্বাস বাড়ায়, সৃজনশীলতাকে উৎসাহিত করে এবং আমাদের চিন্তাভাবনার সীমাবদ্ধতাকে ভেঙে দেয়। বিভিন্ন ধরনের সঙ্গীত বিভিন্ন আবেগ প্রকাশ করে। যেমন, শাস্ত্রীয় সঙ্গীত মনকে শান্ত ও স্থির করে, পপ সঙ্গীত আনন্দ ও উদ্দীপনা বাড়ায়, আর লোকসঙ্গীত আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত করে এক ধরনের আত্মিক প্রশান্তি দেয়। এছাড়াও, সঙ্গীত সমাজের মানুষকে একত্রিত করতেও সহায়ক। একটি কনসার্ট বা সঙ্গীতের অনুষ্ঠানে যখন বিভিন্ন বয়সের এবং সংস্কৃতির মানুষ একসঙ্গে মিলিত হয়, তখন সেখানে এক ধরনের সহমর্মিতা ও সম্প্রীতির জন্ম হয়। এটি আমাদের সামাজিক চেতনাকে বৃদ্ধি করে এবং অন্যদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি আরো সংবেদনশীল করে তোলে। সবশেষে বলা যায়, সঙ্গীত আমাদের চেতনাকে জাগ্রত করে এবং মানসিকতাকে এক নতুন দিকে পরিচালিত করে। এটি আমাদের জীবনকে আরও অর্থপূর্ণ ও সুন্দর করে তোলে, এবং এ পরিবর্তন শুধু ব্যক্তি পর্যায়ে নয়, বরং সামগ্রিকভাবে সমাজেও প্রতিফলিত হয়। সর্বোপরি, আমাদের সমাজের মানসিকতার পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। সংগীতকে কেবল বিনোদন হিসেবে না দেখে, বরং এটিকে একটি শিল্প, একটি পেশা, এবং একটি বাজার হিসেবে মূল্যায়ন করতে হবে। সমাজের বিভিন্ন স্তরে বাদ্যযন্ত্রের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। সংগীতের মাধ্যমে মানসিক চাপ কমানো, মনকে শান্ত রাখা, এবং সৃজনশীলতা বৃদ্ধির মতো বিষয়গুলো প্রচার করতে হবে। পরিবারের মধ্যে সঙ্গীত শিক্ষাগ্রহণের গুরুত্বকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। একটি সন্তানকে যেমন পড়াশোনার জন্য উৎসাহিত করা হয়, তেমনি তাকে কোনো বাদ্যযন্ত্র শিখতে উৎসাহিত করা উচিত। সংগীতকে একটি পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। একজন ভালো সংগীতশিল্পী যে সমাজে সম্মান ও আর্থিক স্বচ্ছলতা পেতে পারেন, এ বার্তাটি সবার কাছে পৌঁছে দিতে হবে।

সঙ্গীতের স্পন্দন ফিরিয়ে আনতে হলে এ সঙ্কটকে একটি সম্মিলিত চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিতে হবে। ব্যবসায়ী, শিল্পী, সরকার, এবং সাধারণ মানুষÑসবাইকে একসাথে কাজ করতে হবে। দোকানে সাজানো বাদ্যযন্ত্রগুলো কেবল নিস্তব্ধ হয়ে থাকবে না, বরং আবার সেখানে বেজে উঠবে সুরের মূর্ছনা। কারণ সংগীত শুধু একটি সুর নয়, এটি আমাদের জীবনের প্রতিচ্ছবি। এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা আমাদের সবার দায়িত্ব।

সঙ্গীত কেবল সুর ও তালের এক চমৎকার সংমিশ্রণ নয়; এটি মানব মনের এক গভীরতম প্রকাশ। সঙ্গীতকে ভালোবাসা মানে জীবনের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করা। সঙ্গীতের প্রতি এ ভালোবাসা আমাদের কেবল বিনোদনই দেয় না; বরং আমাদেরকে সৃজনশীল এবং সংবেদনশীল মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতেও সাহায্য করে। প্রতিটি সুর, প্রতিটি গান আমাদের ভেতরের সুপ্ত সম্ভাবনাগুলোকে জাগিয়ে তোলে; যা’ সৃজনশীলতার পথে প্রথম পদক্ষেপ। সঙ্গীতের শক্তি হলো এর সার্বজনীনতা। ভাষা, সংস্কৃতি বা ভৌগোলিক সীমানার ঊর্ধ্বে উঠে এটি মানুষের হৃদয়ে সরাসরি পৌঁছাতে পারে। যখন আমরা কোনো গান শুনি; তখন আমরা কেবল শব্দ বা সুরের সমষ্টি শুনি না; আমরা সেই গানের পেছনের গল্প, আবেগ এবং অনুভূতিকে অনুভব করি। একজন সুরকার তার জীবনের অভিজ্ঞতা, আনন্দ-বেদনা, স্বপ্ন এবং হতাশা সুরের মাধ্যমে প্রকাশ করেন। সেই সুর যখন আমাদের মনকে স্পর্শ করে, তখন আমাদের ভেতরেও নতুন নতুন ভাবনা এবং অনুভূতির জন্ম হয়। এ ভাবনাগুলোই সৃজনশীলতার ভিত্তি।

সঙ্গীতকে ভালোবাসা আমাদেরকে পর্যবেক্ষক হতে শেখায়। একটি গান শোনার সময় আমরা এর প্রতিটি অংশকে আলাদাভাবে বিশ্লেষণ করিÑসুরের ওঠানামা, যন্ত্রের ব্যবহার, কণ্ঠের অভিব্যক্তি, এবং গানের কথা। এ বিশ্লেষণ আমাদের চিন্তাভাবনার গভীরতা বাড়ায়। আমরা তখন কেবল কোনো কিছু উপভোগই করি না; বরং এর পেছনের কারণ এবং কাঠামো বোঝার চেষ্টা করি। এ বিশ্লেষণাত্মক মনোভাব আমাদের জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও কাজে লাগে, যেমনÑসমস্যা সমাধান, নতুন ধারণা তৈরি এবং জটিল বিষয়গুলোকে সহজভাবে উপস্থাপন করার ক্ষমতা। একজন সঙ্গীতপ্রেমী যখন একটি গানের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয় নিয়েও চিন্তা করে; তখন সে আসলে তার মস্তিষ্কের সৃজনশীল অংশকে শাণিত করে।

সঙ্গীতের সাথে জড়িত থাকা আমাদের মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশকে সক্রিয় করে তোলে। নিউরোসায়েন্সের গবেষণা অনুযায়ী, যখন আমরা সঙ্গীত শুনি বা তৈরি করি, তখন আমাদের মস্তিষ্কের যে অংশগুলো আবেগ, স্মৃতি এবং ভাষা প্রক্রিয়াকরণের জন্যে দায়ী, সেগুলো একসঙ্গে কাজ করা শুরু করে। এটি মস্তিষ্কের সংযোগ বৃদ্ধি করে এবং নতুন নিউরাল পাথওয়ে তৈরি করে, যা আমাদের চিন্তাভাবনার গতি এবং নমনীয়তা বাড়ায়। যারা নিয়মিত কোনো বাদ্যযন্ত্র বাজান, তাদের মধ্যে মাল্টিটাস্কিং এবং সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা অনেক বেশি দেখা যায়। কারণ, বাদ্যযন্ত্র বাজানোর সময় মস্তিষ্ককে একযোগে একাধিক কাজ করতে হয়। সুর, তাল, গতি, এবং যন্ত্রের সঠিক ব্যবহার নিয়ে ভাবতে হয়। এ অনুশীলনগুলো আমাদের সৃজনশীলতাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়।

সঙ্গীতের প্রতি ভালোবাসা আমাদের আবেগের জগতকে সমৃদ্ধ করে। একটি গান আমাদের মধ্যে আনন্দ, দুঃখ, সাহস, বা একাকীত্বের মতো বিভিন্ন অনুভূতি সৃষ্টি করতে পারে। এ আবেগের ওঠানামা আমাদের সংবেদনশীলতা বাড়ায়। যখন আমরা কোনো শিল্পীর আবেগ বুঝতে পারি, তখন আমরা অন্যদের আবেগকেও আরও সহজে উপলব্ধি করতে শিখি। এ সংবেদনশীলতা আমাদের মানবিক সম্পর্কগুলোকে আরো দৃঢ় করে এবং আমাদের সৃজনশীল কাজগুলোকে আরও অর্থবহ করে তোলে। একজন প্রকৃত শিল্পী তখনই সফল হন যখন তিনি তার কাজ দিয়ে অন্যদের হৃদয়ে গভীর প্রভাব ফেলতে পারেন। সঙ্গীতের প্রতি এ ভালোবাসা আমাদের সেই সংবেদনশীলতাকেই জাগ্রত করে। সঙ্গীত শুধু শোনার বা বাজানোর বিষয় নয়, এটি এক ধরনের আত্মিক সংযোগ। যখন আমরা কোনো সুরের প্রেমে পড়ি, তখন আমরা আসলে জীবনেরই প্রেমে পড়ি। এটি আমাদের আত্মবিশ্বাস বাড়ায় এবং নিজেদেরকে প্রকাশ করার নতুন নতুন পথ খুঁজে বের করতে সাহায্য করে। গান লেখা, সুর তৈরি করা, বা কেবল কোনো গানের সাথে গুনগুন করাÑএই প্রতিটি কাজই এক একটি সৃজনশীল প্রক্রিয়া। এটি আমাদের ভেতরের শিল্পীকে জাগিয়ে তোলে। সঙ্গীতের প্রতি এ ভালোবাসা আমাদেরকে শেখায় যে, জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে সৃজনশীলতার উপাদান লুকিয়ে আছে, কেবল সেগুলোকে খুঁজে বের করতে হবে।

পরিশেষে বলা যায়, সঙ্গীতকে ভালোবাসা কোনো শখ নয়, এটি জীবনের এক অপরিহার্য অংশ। সঙ্গীতের প্রতি এ ভালোবাসা আমাদের মানসিকতাকে পরিবর্তন করে, মনকে উদার করে এবং সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের সৃজনশীলতাকে বিকশিত করতে সাহায্য করে। এ ভালোবাসাই আমাদেরকে নতুন কিছু তৈরি করার অনুপ্রেরণা জোগায় এবং জীবনের প্রতিটি চ্যালেঞ্জকে সৃজনশীল উপায়ে মোকাবেলা করার শক্তি দেয়।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়