বুধবার, ২৭ আগস্ট, ২০২৫  |   ৩৪ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ২৭ আগস্ট ২০২৫, ০৯:০০

বেকারত্বের বেড়াজালে তরুণ সমাজ

মো. শামীম মিয়া
বেকারত্বের বেড়াজালে তরুণ সমাজ

বাংলাদেশ আজ এক সংকটময় সময় অতিক্রম করছে। এ সংকট রাজনৈতিক বা প্রাকৃতিক নয় এটি একটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা, যার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ‘বেকারত্ব’।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ ২০২৪ (দ্বিতীয় প্রান্তিক) অনুযায়ী, দেশের বেকারত্বের হার ৩.৬৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা ২০১৬ সালের পর সর্বোচ্চ। এই সময়ে দেশে মোট ১০ লাখ ৭০ হাজার কর্মসংস্থান হ্রাস পেয়েছে। এই তথ্য শুধু পরিসংখ্যান নয়; এটি আমাদের ভবিষ্যতের জন্য একটি সতর্ক সংকেত। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে শ্রমশক্তি যত দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, সে তুলনায় কর্মসংস্থানের সুযোগ সেভাবে তৈরি হচ্ছে না। এর ফলে তরুণ সমাজ, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা, দিন দিন হতাশ হয়ে পড়ছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে তারা বছরের পর বছর চাকরির জন্য অপেক্ষায় থাকে, অথচ দেশে কর্মসংস্থানের দিগন্তে নতুন কোনো আশার আলো দেখা যাচ্ছে না। অনেকেই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত থাকলেও, তা টেকসই নয় এবং সামাজিক নিরাপত্তার আওতায়ও পড়ে না।

বাংলাদেশ বর্তমানে ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’ পর্যায়ে রয়েছে। অর্থাৎ, আমাদের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ কর্মক্ষম এবং কর্মক্ষমতার চূড়ায়। জাতিসংঘের জনসংখ্যা তত্ত্ব অনুযায়ী, এই ডেমোগ্রাফিক সুবিধা একটি দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য বিরল সুযোগ। কিন্তু এই জনসম্পদকে যদি দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তর না করা যায়, তবে এটি একসময় সামাজিক ও অর্থনৈতিক বোঝায় পরিণত হতে পারে। আমাদের সামনে এখন বড় প্রশ্ন এই সুযোগ আমরা কাজে লাগাতে পারছি কি? দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের দেশে পরিকল্পিত কর্মসংস্থান নীতির অভাব রয়েছে। সরকারি-বেসরকারি চাকরির সুযোগ সীমিত, আর যেগুলো আছে, সেগুলোতেও অব্যবস্থাপনা, স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায়। অন্যদিকে, শিল্প খাত, প্রযুক্তি খাত, কৃষি খাত কিংবা উদীয়মান সেবা খাতে নতুন কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র তৈরি হলেও তা প্রয়োজনীয় গতিতে এগোচ্ছে না।

দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ এখনো যথেষ্ট চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, কর নীতির অস্পষ্টতা এসব কারণে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা নিরুৎসাহিত হন। অথচ বিনিয়োগ ছাড়া শিল্পায়ন সম্ভব নয়, আর শিল্পায়ন ছাড়া ব্যাপক কর্মসংস্থান তৈরি করাও অসম্ভব।

অন্যদিকে, আমাদের কর্মশক্তির বড় অংশ এখনো পর্যাপ্ত দক্ষতা অর্জন করতে পারেনি। শিক্ষা ব্যবস্থার গুণগত মান নিয়ে বহুদিন ধরেই প্রশ্ন উঠছে। পাঠ্যক্রমে বাস্তবজ্ঞান, প্রযুক্তিনির্ভরতা এবং উদ্যোক্তা বিকাশের উপযোগিতা কম। এতে করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি অর্জনের পরও চাকরি পাওয়ার মতো দক্ষতা অনেকের মধ্যেই থাকে না। ফলে ‘এডুকেটেড আনএমপ্লয়মেন্ট’ নামে একটি নতুন সামাজিক ব্যাধি দেখা দিচ্ছে, যা কেবল অর্থনীতিই নয় পারিবারিক এবং সামাজিক স্থিতিশীলতাকেও নষ্ট করছে। এ অবস্থায়, আমাদের কর্মসংস্থান নীতি ও কৌশলে বড় ধরনের রূপান্তর জরুরি। প্রথমত, ‘ইনক্লুসিভ গ্রোথ’ বা অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির ধারণাকে কেন্দ্র করে পরিকল্পনা নিতে হবে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি তখনই অর্থবহ হবে, যখন তা বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জন্য আয় ও কাজের সুযোগ তৈরি করবে। দারিদ্র্য হ্রাস এবং সামাজিক বৈষম্য কমাতে কর্মসংস্থানের বিকল্প নেই। দ্বিতীয়ত, সরকারকে শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন খাতে অধিকতর বিনিয়োগ করতে হবে। কারিগরি ও পলিটেকনিক শিক্ষার বিস্তারে গুরুত্ব দিতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), রোবটিক্স, ডেটা অ্যানালাইসিস, গ্রিন টেকনোলজি ইত্যাদি খাতে তরুণদের প্রশিক্ষিত করে তুললে তারা আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারেও প্রতিযোগিতা করতে পারবে। তৃতীয়ত, উদ্যোক্তা উন্নয়নকে জাতীয় অগ্রাধিকারের জায়গায় নিতে হবে। তরুণদের উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য স্বল্পসুদে ঋণ, প্রশিক্ষণ, কর ছাড়, ডিজিটাল মার্কেটিং সহায়তা ইত্যাদি প্রদান করতে হবে।

বর্তমানে দেশে অনেক স্টার্টআপ তৈরি হলেও পর্যাপ্ত অর্থায়ন এবং পরামর্শের অভাবে বেশিরভাগই টিকতে পারে না। এর পাশাপাশি, নারী উদ্যোক্তাদের জন্য আলাদা সহযোগিতা ও উৎসাহব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। চতুর্থত, প্রবাসী শ্রমবাজারেও দক্ষতা ও কূটনীতির মাধ্যমে সম্ভাবনা বাড়ানো যেতে পারে। বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, মালয়েশিয়া ও জাপানে বাংলাদেশের দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা রয়েছে। কিন্তু আমরা অনেক ক্ষেত্রেই ভাষা, সংস্কৃতি ও পেশাগত প্রস্তুতির অভাবে সেই সুযোগ হারাচ্ছি। একটি শক্তিশালী অভিবাসন নীতি তৈরি করে, দক্ষ ও সুশৃঙ্খলভাবে জনশক্তি রপ্তানি করলে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পাশাপাশি বেকারত্ব হ্রাসও সম্ভব। পঞ্চমত, সরকারিভাবে শ্রমবাজার বিশ্লেষণ ও ডেটা ব্যবস্থাপনায় আধুনিকতা আনতে হবে। কোন খাতে কত কর্মসংস্থান দরকার, কোথায় দক্ষতা ঘাটতি রয়েছে, কত শিক্ষার্থী কোন বিষয়ে লেখাপড়া করছে এইসব তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণ ছাড়া কর্মসংস্থান নীতিতে বাস্তবতা আসবে না। বর্তমানে আমাদের দেশে যে হারে উচ্চশিক্ষিত তরুণ তৈরি হচ্ছে, তা সময়ের দাবি মেটাতে পারছে না। একদিকে শিক্ষিত বেকার, অন্যদিকে দক্ষ জনবলের অভাবÑএই বৈপরীত্য একটি দেশের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নপ্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করে। বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ২০ লাখ তরুণ কর্মশক্তিতে প্রবেশ করে। এর মধ্যে প্রায় ৩৫-৪০ শতাংশের জন্য কোনো নির্দিষ্ট কর্মসংস্থান থাকে না। এই বিপুল জনগোষ্ঠীকে কর্মমুখী করতে না পারলে সামাজিক অস্থিরতা, অপরাধ, মাদক, মানসিক অবসাদসহ নানা ব্যাধি সমাজে বিস্তার লাভ করতে পারে। অর্থনৈতিকভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বিগত এক দশকে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি সন্তোষজনক হলেও তা কর্মসংস্থান তৈরি করতে তেমন কার্যকর হয়নি। এটিকে অর্থনীতিবিদরা ‘জবলেস গ্রোথ’ বলছেন যেখানে অর্থনীতির আকার বাড়ছে, কিন্তু নতুন চাকরি তৈরি হচ্ছে না। এছাড়া, গত কয়েক বছরে করোনার প্রভাবে যেসব ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তারা এখনো পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি। এরও প্রভাব পড়েছে কর্মসংস্থানে। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতির চাপে মধ্যবিত্ত ও নিম্নআয়ের মানুষের ভোগক্ষমতা কমে যাওয়ায় অভ্যন্তরীণ বাজারও চাপে রয়েছে। এই অবস্থায় বিনিয়োগকারীরা নতুন কর্মসংস্থান তৈরির ব্যাপারে সতর্ক। এই মুহূর্তে আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন একটি সমন্বিত কর্মসংস্থান রোডম্যাপ। যেখানে থাকবে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাÑনতুন কর্মসংস্থান তৈরি, উদ্যোক্তা সৃষ্টি, দক্ষতা উন্নয়ন এবং শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষা সংস্কার। সরকারের সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে একযোগে কাজ করতে হবে এ লক্ষ্যে। সবচেয়ে বড় কথা, কর্মসংস্থান শুধু অর্থনৈতিক বিষয় নয়; এটি একটি সামাজিক নিরাপত্তা, একটি মানবিক দায়িত্ব এবং একটি উন্নয়ন দর্শনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কাজেই, কর্মসংস্থান সৃষ্টিকে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি বা নির্বাচনকালীন ঘোষণার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে একটি জাতীয় উন্নয়ন কৌশল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বাংলাদেশের সামনে এখন বড় চ্যালেঞ্জ দারিদ্র্য হ্রাস, আয় বৈষম্য কমানো, সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা এবং টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা। এসব লক্ষ্য অর্জনের পূর্বশর্তই হলো ‘কর্মসংস্থান’। তরুণদের হতাশ না করে, তাদের আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কাজের সুযোগ দিতে পারলে, তাদের মেধা ও শ্রম দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদে পরিণত হবে। তাই সময় এখন সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার। তরুণ সমাজ আজ প্রশ্ন করছে ‘‘আমরা পড়াশোনা করে কি করব, যদি কাজ না পাই?’’ এ প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারলে আমাদের সব উন্নয়ন পরিকল্পনা হবে অর্থহীন। বাংলাদেশের উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি আজ শুধু একটিই উপযুক্ত, টেকসই এবং ব্যাপক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়