শনিবার, ২৩ আগস্ট, ২০২৫  |   ২৮ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ২৩ আগস্ট ২০২৫, ০৯:৫৪

ধারাবাহিক উপন্যাস-৪

নিকুঞ্জ নিকেতন

রাজীব কুমার দাস
নিকুঞ্জ নিকেতন

(গত সংখ্যার পর)

(২)

বরাবরই আমরা সেই বাদাম গাছটার তলায় বসি রাউন্ড শেষে, আজও দুজনে বসে গল্প করছি। হঠাৎ দেখি এক ভদ্রলোক দিব্যি মনের আনন্দে বিড়বিড় করে গান গাইছে আর এলোমেলো ভঙ্গিতে হেঁটে যাচ্ছে। তার হাঁটায় বুঝা যায় না সে কী করতে চাইছে। বয়সটা আমাদের চেয়ে কম বা সমসাময়িক হতে পারে তবে ব্যবধান বেশি একটা হবে না। অনেকক্ষণ গল্প করেছি ভাবলাম আবারও হাঁটি আর এই মজার লোকটা কী করতে চাইছে দেখি। ভঙ্গিমায় চঞ্চলতা আজও ধরে রেখেছে আর কোনো কিছুতেই যেন সিরিয়াস নয়। আমরা পিছু নিয়ে তার আচরণটা লক্ষ্য করছিলাম তাই পার্কের একটা রাউন্ড দিতে বেশ সময় লেগে গেল। মনে খুব ইচ্ছে জেগেছে লোকটাকে জানার কিন্তু কীভাবে? সাধারণত চঞ্চল প্রকৃতির মানুষগুলো স্বাচ্ছন্দ পছন্দ করে, মুক্তচেতনা যাকে বলে এবং এটায় কোনো ব্যঘাত ঘটলে তারা ক্ষেপে যেতেও সময় লাগে না। আমরা ক্লান্ত তেমন না হলেও আবার গিয়ে বেঞ্চিতে বসি। আমি আর অনিমেষ লোকটাকে নিয়েই কথা শুরু করলাম আর হঠাৎ পাশ থেকে একটা শব্দ কানে ভেসে আসল।

‘বসতে পারি।’

পাশ ফিরে তাকাতেই আমরা দুজনে অবাক। মেঘ না চাইতে বৃষ্টির মতো সেই লোকটা আচমকা আমার পাশে বসতে চাইছে। অবাক হলেও প্রকাশ করিনি।

‘অবশ্যি।’

‘ধন্যবাদ। বেশ কিছুক্ষণ লক্ষ্য করলাম আপনারা আমার পিছু নিয়েছেন। কেনÑসেটা কী জানাবেন?

আমরা দুজনেই হতভম্ব হয়ে যাই। এটা কীভাবে সম্ভব! তার পিছু হাঁটছি অথচ আমাদের দিকে একটিবারের জন্য নজর না দিয়েও কীভাবে বুঝতে পারল। লোকটা বেশ চৌখস ও মেধাবী বলা চলে। প্রশ্নটা করায় কেমন যেন লজ্জা পেয়ে গেলাম। উত্তর কীভাবে দিব বুঝে উঠতে পারছিলাম না আর ঠিক তখনি অনিমেষ বলে উঠলÑ

‘আপনার পিছু নিয়েছি এটা পুরোপুরি সত্যি নয় আমরা বরাবরই এখানে এসে হাঁটি আর এই সাত সকালে যারা আসে প্রত্যেকে হাঁটার জন্যই আসে।

‘কিছু মনে করবেন না। মূলত আপনাকে অমন ভঙ্গিতে হাঁটতে দেখে একটু আগ্রহী হয়েছিলাম তাই জানার জন্য পিছু নিয়েছিলাম।’

‘তাহলে আমাকে জানতে পেরেছেন! না পারলে চেষ্টা করেননি কেন? ’

‘আপনার স্বাধীনতায় যদি হস্তক্ষেপ করে থাকি তাহলে আমাদের ক্ষমা করবেন।’

‘হা হা হা...আমি সারোয়ার আলম। সহসাই বদলি হয়ে এই শহরে আসলাম, চাকরির আর বেশি একটা বাকি নেই এই ধরুন ছয়-সাত মাস তারপর জীবনটা পুরো আরাম। অবসরের সময়টা কীভাবে কাটাব সেটাই অভ্যাস করছি এখন থেকে।’

‘আমি নরেন্দ্র নারায়ণ দাস আর উনি অনিমেষ ঘোষ। আমরা দুজনেই চাকরি শেষে এখন অবসর সময়টা কাটাচ্ছি। উনাকেও পেয়েছিলাম এই পার্কে তারপর আমাদের পরিচিতি বাড়ে একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে আর কী।’

‘আপনারা প্রতিদিন আসেন এখানে?

‘আসতে হয়। সুস্থ্য থাকার একমাত্র উপকরণ হলো হাঁটা। আমাদের বয়সটা রোগের একটা প্যাকেজ বহন করে তাই সুস্থ্য থাকার জন্য প্রতিদিন রেস্ট নিয়ে নিয়ে এক ঘণ্টা হাঁটার চেষ্টা করি।’

‘বাহ্ এই তো পেয়ে গেলাম। সত্যি বলতে কী ্ট্রান্সফার হয়ে আসার পর এখানে মিলিয়ে নিতে পারছি না, একা হয়ে গেছি। চাকরি জীবনটাই কেটেছে বিভিন্ন জেলায় এখানে কখনো ফেরা হয়নি। এখন শেষ বেলা তাই ফিরে এসেছি আর কী।’

‘তাহলে আপনার দেশের বাড়ি এটাই।’

‘বলতে পারেন। সদর হাসপাতাল রোড ধরে বেশ কিছুদূর এগোলেই আমার বাসা। পরিবার পরিজন নিয়ে এখন এখানেই সেট হয়ে যাচ্ছি। কিছু মনে করবেন না আমি ভুলে গেছি আপনাদের নামগুলো।’

‘হা হা হা...একেই বলে বার্ধক্য। আমি অনিমেষ ঘোষ আর উনি নরেন্দ্র নারায়ণ দাস। চলুন ডাব খেতে খেতে কথা বলি।’

‘এটা আমার একটা অভ্যেস বলতে পারেন, আমি মানুষের নাম আগ্রহ করে জিজ্ঞেস করি কিন্তু একটু আলাপ-আলোচনার পর ভুলে যাই। কারো নাম মনে রাখা যে কত কষ্টকর এটা সহজেই টের পাই। তা আপনারা কী প্রতিদিন আসেন মানে বাধ্যতামূলক আসতে হয়।’

‘বাধ্যতামূলক বলছেন কেন বলুন প্রয়োজন।

‘সেটা কেমন?’

‘আপনি এখন চাকরি করছেন তাই বুঝবেন না যখন চাকরিটা শেষ হয়ে যাবে দেখবেন মাসখানেক পর আপনার আর ভালো লাগছে না তখন অস্থির হয়ে যাবেন।’

‘এমনটা কেন? তাছাড়া মাসখানেক পর কেন বুঝব সেটা এখনো বুঝা যাবে!’

‘সারোয়ার সাহেব চাকরিটা যখন অবসর দিয়ে দিবে তখন দেখবেন আপনার আপনজনেরা আপনাকে মানিয়ে নেওয়ার জন্য গুরুত্ব দিবে, কাছে থাকার চেষ্টা করবে। তখন বুঝবেন না কিন্তু অবসর আপনার হয়েছে তাদের না তাই তাদের কর্মজীবনে যখন তারা ফিরবে তখন আপনি একা বোধ করবেন। কাজ চাইবেন করতে তখন করার তেমন কিছু থাকবে না। মানুষগুলো তখনি অসহায়ত্বে ভোগে।’

‘দাদা এমনটা আমার কাছে মনে হয় না কারণ আমি সারোয়ার সারাজীবন এত পরিশ্রম করেছি যে এখন মন আর চাইছে না ব্যস্ততা, মন চায় অবসর। শুধু বিশ্রাম আর বিশ্রাম।’

‘তাহলে তো আপনি আরও বেশি সমস্যায় পড়বেন। সারাজীবন পরিশ্রম করা মানুষগুলো যখন হঠাৎ করে অবসরে যায় তখন পাগল প্রায় হয়ে ওঠে। তাদের এত বছরের পরিশ্রমটা ততক্ষণে অভ্যাসে পরিণত হয়। আমরা দুজনে এর ভুক্তভোগী তাই বলতে পারছি।’

‘হতে পারে। আমি এখনো অবসরে যাইনি তাই বুঝতে পারছি না হয়তো। নাহ: ভাবছিলাম আপনাদের সঙ্গটা আমার সহায়ক হবে এখন দেখছি ভীতিটাকে আরও জাগিয়ে দিচ্ছেন।’

‘হা হা হা...সারোয়ার সাহেব এটাকে জাগিয়ে দেওয়া বলে না বলুন সাহস জোগানো আগামীর জন্য। আপনি সাহস হারালেই নেতিয়ে পড়বেন আর মনে হবে জীবনটা বুঝি শেষ। অবসর আমাদের সেটাই ইঙ্গিত করে কিন্তু সত্যিটা তা নয়। অবসর হচ্ছে জীবনের একটা অধ্যায়ের সমাপ্তি, জীবনের নয়।’

‘আপনারা এখানে আসেন কটায়?’

‘ঠিক নেই তবে সকাল সাতটার আগেই চেষ্টা করি আর থাকি বেশ কিছুক্ষণ।’

‘তাহলে আমিও আপনাদের দলের একজন হয়েছি এখন থেকে কী বলেন?’

‘হা হা হা... অবশ্যি। আমাদের ভোরের আড্ডায় আপনাকে স্বাগতম।’

‘আজ অনুমতি দিন দাদারা অফিস আছে তাই ফিরতে হবে। আপনাদের সঙ্গ দেখি কতটুকু পুষিয়ে নেওয়া যায়। কাল সকালে এখানেই দেখা হচ্ছে তাহলে।’

‘অবশ্যি, আমরা অপেক্ষায় থাকব।’

‘তাকে বেশ মজার মানুষ মনে হচ্ছে কী বল অনিমেষ।’

‘আমারও তাই মনে হয় দাদা। তবে আমাদের মতো এখনো পাঁকেনি।’

‘কাঁচা-পাঁকা হয়ে আছে আর কী...হা হা হা...’

[পরের পর্ব আগামী সংখ্যায় প্রকাশিত হবে]

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়