সোমবার, ১৮ আগস্ট, ২০২৫  |   ৩৪ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ১৮ আগস্ট ২০২৫, ০৮:৫৯

খণ্ডে খণ্ডে অখণ্ড জীবন

পীযূষ কান্তি বড়ুয়া
খণ্ডে খণ্ডে অখণ্ড জীবন

॥ আটত্রিশতম পর্ব ॥

আমার ভোট আমার গণতন্ত্র : আঠারো বছর পার হলে একজন ব্যক্তি তার ভোটাধিকার অর্জন করে, অর্জন করে নাগরিক অধিকার। আমিও সময়মত আমার ভোটার হওয়ার স্বীকৃতি অর্জন করি। উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণিতে দ্বিতীয়বর্ষে অধ্যয়নকালীন আমি প্রথম ভোটার হই। তিনজোটের রূপরেখায় তখন সদ্য বিদায়ী এরশাদ সরকার হতে আমাদের গণতন্ত্রে উত্তরণ। দুই নেত্রীর ঐকমত্য বাংলাদেশের মানুষকে নতুন এক সকালের অসাধারণ স্বপ্ন দেখিয়ে আশার দীপ জ্বালিয়ে দেয়। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনই আমার প্রথম ভোটার হওয়ার নির্বাচন। ব্যক্তির চেয়ে এদেশে মার্কা বড়। কে কতো বড়ো সৎ কিংবা কতোটুকু যোগ্য তা নির্বাচনে কোনো বিষয়ই নয়। আসল বিষয় হলো মার্কা। এদেশে বুঝ হওয়ার পর থেকেই দেখে আসছি, যোগ্য ব্যক্তিটি ভোটে হেরে যায়, আর অযোগ্য ব্যক্তি মার্কার জোয়ারে জিতে যায়। ফলে বার বার গণতন্ত্র ব্যর্থ হয় মার্কাতন্ত্রের জয় হয়।

প্রথম ভোট দেওয়ার প্রাক্কালে আমি গণিতের শিক্ষক তাহের স্যারের কাছে জেনে নিই কীভাবে ভোট দিতে হয়। বাম হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলে প্রথম অমোচনীয় কালির দাগ নিয়ে আমি সগৌরবে বের হয়ে আসি ভোটকেন্দ্র থেকে। ভোটকেন্দ্রে ঢোকার আগে সকল পক্ষের সমাদরে আমি নিজেই লজ্জা পেয়ে যাই। অনেক বড়ো বড়ো লোক আমার কাছে এগিয়ে এসে বলে, ভোটের সিলটা মার্কা বরাবর মারবে, যাতে দাগের বাইরে না যায়। সিলের কালি না শুকানোর আগে ব্যালট পেপার ভাঁজ করবে না। এতে ভোট নষ্ট হয়ে যেতে পারে। ভোট দিয়ে আসার পর আগের সেই সমাদর আর কারও ব্যবহারে চোখে পড়লো না। যেন আমার দাম শেষ। নিজের গর্বে নিজে যখন টগবগ করে ফুটতে ফুটতে বাসার গলিতে ঢুকি, তখন দেখি একটা জায়গায় টেবিল নিয়ে বসেছে কয়েকজন। হাতে কালির দাগওয়ালা সবাইকে এক টুকরা করে লেবু বিতরণ করছে। আমি লেবুর ব্যবহার দেখে অবাক হলাম। পরে জানলাম, লেবু ঘষলে অমোচনীয় কালির দাগও নাকি মুছে ফেলা যায়। এরপর ভোটার তালিকা দেখে দেখে প্রবাসী, অসুস্থ ও মৃত ব্যক্তিদের ভোটার নাম্বার, বাবার নাম, মায়ের নাম, পত্নী বা স্বামীর নাম শিখিয়ে দিয়ে তোতা পাখি বানিয়ে পাঠানো হচ্ছে ভোটকেন্দ্রে। কয়েকজন নির্বিঘ্নে দ্বিতীয় ভোট প্রদান করে তৃতীয় ভোটের জন্যে লেবু ঘষছে। আমার কাছে ব্যাপারখানা বেশ উপভোগ্য মনে হলো। এটাকে জালভোট হিসেবে দেখার চেয়েও আমার কাছে উৎসবের ভোট হিসেবেই বেশি সত্য বলে মনে হলো। কারণ তখনও জাল ভোটের কুফল বুঝে ওঠার সুযোগ হয়নি। কেউ কেউ দুয়েকবার আমার দিকে ভিন্ন নজরে চাইলেও বাবার পরিচিতি এবং আমার সরলতার কারণে আর মুখ ফুটে কিছু বলেনি। আমি স্বচক্ষে লেবু টেকনিক দেখে বাসায় চলে এলাম। তখনও দেখি আমার মা-দিদিরা মাত্র তৈরি হচ্ছেন সদলবলে ভোট দিতে যেতে। সেবার অবশ্য আমার প্রথম ভোট হেরে গিয়েছিলো। দ্বিতীয়বার ভোট দিলাম মেয়র ভোট। অর্থাৎ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সিটি কর্পোরেশনের ভোট। ভোটের আগে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিয়ে হ্যান্ড মাইকে আমাদের এলাকায় ভোট চেয়ে গেছেন এক প্রার্থী। আরেক প্রার্থী সারা রাস্তায় এয়ার ইন্ডিয়ার বিজ্ঞাপনের হাসিমাখা মুখ নিয়ে সবাইকে সম্ভাষণ করে গেছেন। তাঁকে বলতে শুনেছি, ‘আমার নিজস্ব কোন অপিনিয়ন নেই, আপনাদের অপিনিয়নই আমার অপিনিয়ন।’ হারিকেন মার্কাকে ভোট দিয়ে সেবার আমি জিতেছিলাম। এ সময় যিনি কাউন্সিলর প্রার্থী ছিলেন, তিনি আমাদের খেলাঘরের বড়োভাই ছিলেন। আমাদের গলিতে ভোট চাইতে এসে তিনি বাসা থেকে আমাকে ডেকে নিয়ে বললেন, আমাকে তোদের গলিতে পরিচয় করিয়ে দে। আমি ভয়ে ভয়ে যা পারলাম তা-ই বললাম। দেখি তিনি এরপর হাসিমুখে হ্যান্ড মাইক নিয়ে যথোচিত ভদ্র ও আন্তরিকভাবে ভোট চাইলেন।

পরেরবারের জাতীয় নির্বাচনের সময় আমি মেডিকেল কলেজের ছাত্র। গোয়াছিবাগানে ভোট দিচ্ছিলো আমাদের বন্ধুরা, যারা বাইরের জেলা হতে এখানে পড়তে এসেছিলো। তাদেরকে নমিনে হোস্টেলে ভোটার বানানো হয়েছিলো। আমি আমার এলাকায় ভোট দেই। এবার দেখলাম লেবুর চেয়ে কোক-ফান্টার কদর বেশি। যে ভোট দেয়নি তাকে প্রার্থীর নির্বাচনী তাঁবুতে এনে পিপাসা পাক বা না পাক, একটা করে কোক-ফান্টা ধরিয়ে দেওয়া হলো। তাদের অনেকের চেহারা দেখে আমি নিশ্চিত বুঝেছি, ফান্টা খেয়ে পিপাসা মিটালেও প্রার্থীর ভোটের আশা মিটবে না। এ সময় হঠাৎ করে একজন ভোটার ভোট কেন্দ্র হতে গর্জাতে গর্জাতে ফিরে এলেন। তার ভোট নাকি দেওয়া হয়ে গেছে। অথচ তিনি তখন মাত্র ঘুম থেকে উঠে ভোট দিতে গিয়েছিলেন। তিরিশ বছরের এক যুবককে লেবু থেরাপি দিয়ে পাঠানো হলো পঞ্চাশ বছর বয়সী তার বাবার ভোট দিতে যেতে। বেচারা সবকিছুই ঠিকঠাক বলে যাচ্ছিলো। তবে খুব কঠিন চ্যালেঞ্জে পড়েছিলো প্রতিপক্ষের পোলিং এজেন্টের। বাবা-মায়ের নামে দাদু-ঠাকুরমার নাম বলে দিলো অবলীলায়। যখন স্ত্রীর নাম জিজ্ঞেস করলো তখন ঐ যুবক ভোঁ দৌড় মেরে দেওয়াল টপকে বের হয়ে গেলো ভোটকেন্দ্র থেকে।

এক-এগারোর পর নির্বাচনে এনআইডি কার্ডের প্রচলন হয়। এ সময় জাল ভোট কমে আসে এবং প্রায় নেই বললেই চলে। আমার নামের কারণে এনআইডি কার্ড ইস্যু হলো হরিজনদের সাথে। ফলে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে লাইনে আমি বেকায়দায় পড়ে গেলাম। হরিজনদের একটা সুনির্দিষ্ট মার্কার ভোটার হিসেবে চিন্তা করে তাদের ভোট গ্রহণে অহেতুক বিলম্ব হচ্ছিলো। সেই বিড়ম্বনায় পড়ে গেলাম আমিও। অবশেষে প্রিসাইডিং অফিসার চিনতে পেরে আমার ভোটটা আগে নেওয়ার ব্যবস্থা করেন। দুহাজার চব্বিশ সালের নির্বাচনে ডামি প্রার্থীর ডামাডোলের কারণে ভোটকেন্দ্রে ভোটার প্রায় ছিলো না বললেই চলে। দলের নেতাকর্মীরা নিজেদের মধ্যে ভ্রাতৃবিধ্বংসী বিরোধের কারণে ভোটার কেন্দ্রে না এনে ভোটকেন্দ্র পাহারা দিচ্ছিলো। এতে আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হারে ভোট গ্রহণ না হওয়ায় এ নির্বাচন সত্যিকার অর্থেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে গেলো। রিকশা নিয়ে আমি আর আমার পত্নী ঘুরে ঘুরে শহর পরিক্রমা করে ভোটারদের উপস্থিতি যাচাই করছিলাম। দেখলাম, শুধু চেনামুখগুলোই ভোটকেন্দ্র ঘিরে আছে। ঘরের বউ-ঝি কিংবা আমজনতা ভোটকেন্দ্রে আসার তেমন কোনো উৎসাহ দেখায়নি। অর্থাৎ সবার মাইন্ডসেট ছিলো এমন, সব তো তারা তারাই। ফলে ভোট দিয়ে উল্লসিত হওয়ার চেয়ে বরং বিবেকের প্রশ্নবাণে জর্জরিত হতে হলো।

আমি যখন ভোটার হইনি, তখন রাত জেগে আমি আর আমার ছোটমামা মিলে স্কুলের পরিত্যক্ত ডায়রিতে ভোট গণনার সংখ্যা লিখে রেখে রাত জাগতাম। বড়োদের সাথে আমারও কপালে চা জুটতো। সালেহ একরাম, সরকার কবীরউদ্দিন, বাবুল আক্তার এদের নির্বাচনী সংবাদে আমরা রাত জাগার রসদ পেতাম। ছিয়াশি-আটাশি সালে দেখলাম মিডিয়া ক্যু কাকে বলে। আমাদের মামা-ভাগ্নের একটু আগেও গণনায় যে এগিয়ে ছিলো বিপুল ভোটে, তাকে হেরে যেতে দেখলাম মাত্র কয়েকটি কেন্দ্রের স্থগিত ভোটের ফলাফলে। এরপর আমাদের আর উৎসাহ রইলো না। কী হতে যাচ্ছে তা বুঝতে পেরে আমরা টিভি বন্ধ করে ঘুমুতে গিয়েছিলাম।

খুব শৈশবে বাবাকে দেখতাম তিনব্যান্ডের রেডিও কানে নিয়ে বসে থাকতেন। সাতাত্তর সালে মোরারজি দেশাইয়ের কাছে কংগ্রেসের বিপুল পরাজয়ে বাবাকে হতাশ হয়ে বলতে শুনি, ইন্দিরা গান্ধী পড়ে গেছে। তখন বাংলাদেশে ইন্দিরা কংগ্রেসের বিশাল জনপ্রিয়তা ছিলো। তারা আমাদের দেশের স্বাধীনতা অর্জনে সহযোগিতা করেছেন তাই।

ভোটের বাজারে মার্কার যেমন দাম আছে, দেখলাম, স্লোগানেরও শক্তি আছে। ঊনিশশো সত্তরে যেমন একটা স্লোগান ছিলো,’ ইলিশ মাছের তিরিশ কাঁটা বোয়াল মাছের দাড়ি / ইয়াহিয়া খান ভিক্ষা করে শেখ মুজিবের বাড়ি।’ এ স্লোগান আসলে গ্রাম-বাংলায় বেশি প্রভাব বিস্তার করেছে। ঊনিশশো সাতাত্তর-আটাত্তরে আমাদের বাসার পাশে মনির নামে এক কিশোরকে স্লোগান দিতে শুনি,’ আটারুটি খাবো না/নৌকার কাছে যাবো না।’ এটা বুঝতে অসুবিধা নেই আওয়ামী লীগের শাসনামলে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষকে কেন্দ্র করেই এ স্লোগানের উৎপত্তি। কিছু কিছু স্লোগান মানুষকে আপন করে নিয়েছে। যেমন : ‘ও খালা তুমিও যাইও / অমুক মার্কায় ভোটটা দিও।’ কলেজে পড়াকালীন সাম্প্রদায়িক রাজনীতির একটা স্লোগান ছিলো, ‘ দুই বাংলার তিন পশু / অমুক তমুক আর জ্যোতি বসু।’ কাউন্সিলর নির্বাচনে আমাদের এলাকায় এক প্রার্থী ছিলেন ইজ্জত আলী। তার মার্কা ছিলো আনারস। তার স্লোগানও ছিলো সেইরকম-- ‘এক চিপে দুইগ্লাস রস / ইজ্জত আলীর আনারস।’

যত নির্বাচনেই ভোট দিলাম, আমার চোখে কোনো নির্বাচনই শতভাগ সৎ নির্বাচন ছিল না। কারণ, এদেশে গণতন্ত্র মানে সংখ্যাগরীষ্ঠের ভোট, এ কথাই প্রতিষ্ঠিত। এখানে ব্যক্তির যোগ্যতা, সততা, আন্তরিকতার কোনো মূল্য নেই। এজন্যে কখনও কখনও একথাও শুনতে পাই, ‘ অমুক এলাকায় তমুক মার্কা নিয়ে একটা কলাগাছকে দাঁড় করালেও পাস করবে।’ অর্থাৎ আমাদের দেশে এখনও মানুষ গণতন্ত্র কী তা বুঝে উঠতে পারেনি। ফলে ভোটের দিন একটা কোল্ড ড্রিংকের বদলে একটা ভোট কিংবা রিকশা ভাড়ার বদৌলতে একটা ভোট ব্যালট বাক্সে যুক্ত হয়। কড়কড়ে পাঁচশো টাকা দিলে তো কথাই নেই। যে নেতা ভোটারের এলাকায় একটা স্কুল করে দিলো তার কোনো দাম নেই, যে ভোটের আগের রাতে হাতে পাঁচশ’ টাকা গুঁজে দিলো সেই-ই হয়ে গেলো যোগ্য। এ কারণেই ভোটের পরে আর ভোটারের মূল্য থাকে না। (চলবে)

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়