সোমবার, ০৪ আগস্ট, ২০২৫  |   ২৮ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ০৪ আগস্ট ২০২৫, ০৮:৪১

চিঠির ভাঁজে জমানো দিন

কাজী নজরুল ইসলাম নজু
চিঠির ভাঁজে জমানো দিন

নীলা আর ইমন প্রেম করে প্রায় দু বছর। প্রতিদিন কথা হয় ভোরবেলা-’ঘুম থেকে উঠেছো?’ দুপুরে--’লাঞ্চ খেয়েছো?’ রাতে-- ‘ঘুমাচ্ছো নাকি ভাবছো আমাকে? আজ কী পরেছো?’--’নীল শাড়ি’।--’উফ নীল শাড়িতে তোমায় দারুণ লাগে দেখতে, একটু ভিডিও তে আসো দেখি কেমন লাগে দেখতে’। তাদের কথার অভাব নেই। কখন কোথায় যাচ্ছে সব জানে একে অপরের। কিন্তু একদিন হঠাৎ নীলা বললো, ‘ইমন, তুমি কখনো আমাকে একটা চিঠি দাওনি এখনো !’

ইমন হেসে বললো, ‘চিঠি? এই যুগে কে আর লেখে চিঠি? সব তো এখন ফোনেই হয়ে যায়!’ দুজনে হেসে উঠে। আর এখন চিঠি লিখতে বসলে সময় হেসে উঠবে। চিঠি সেই কবে হারিয়ে গেছে।

হঠাৎ নীলা চুপ করে যায়। ওর দাদীর কাঠের ট্রাংকে রাখা একটা পুরোনো খামের কথা মনে পড়ে যায়, যেটা ওর দাদী এখনো যত্ন করে রাখেন। মাঝে মাঝে পড়ে আবার রেখে দেন। ভেতরে লেখা প্রেমপত্র, হাতে লেখা, ভুল বানান, কিন্তু শব্দে শব্দে আবেগে ভরা।

ইমন প্রতিদিন বলে, ‘ভালোবাসি’। তবু নীলা মনে মনে ভাবে, একটা চিঠি পেলে বোধহয় এই কথাটা বিশ্বাস করতে আরেকটু সহজ হতো।

চিঠি এখন কেউ লেখে না। তবে চিঠির মতো প্রেমও আর এখন নেই। প্রেমিক-প্রেমিকারা এখন ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলে, ম্যাসেজে রাত পার করে দেয়, ভিডিও কলে মুখোমুখি হয়, তবু সম্পর্কগুলো যেন হালকা হাওয়া। একসময় প্রেম মানেই ছিলো চিঠি লেখা, দিনের পর দিন ধরে ভাবা--কী লিখবো, কীভাবে বলবো বা আজ কী নামে ডাকবো ?--জানু, জানপাখি কিংবা আমার কলিজা, একটি খামেই ঢুকতো সমস্ত ভালোবাসার কথা। এখন আর কেউ অপেক্ষা করে না ডাকপিয়নের জন্যে, কেউ আর বুকের কাছে লুকিয়ে রাখে না চিঠি। ভুল বানানেও ভালোবাসা ছিলো, আজ ঠিক বানানে অভাব অনুভবের। আমরা অনেক দূর এগিয়ে গেছি, মুঠোফোনে জগত আমাদের মুঠোয়। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে যোগাযোগের ঘাটতি নেই, কিন্তু অনুভব কি আগের মতো আছে?

স্কুলে পড়া রবীন্দ্রনাথের ‘ছিন্নপত্র’ পড়ে মনে হতো, চিঠি মানেই তো সাহিত্য। এখন কেউ আর অনুভবকে কাগজে রাখে না। একটা প্রেমপত্র, মায়ের লেখা বা বন্ধুর কান্নাভেজা খাম--সবকিছু আজ হারিয়ে গেছে ডাস্টবিনে ফেলা পুরোনো খামের মতো। তবুও তারা বুকের ভেতর থেকে যায়, চাপা পড়ে থাকা হৃদয়ের মতোই। চিঠি ছিলো এমন কিছু, যা একবার খুললে সময় থেমে যেতো। শব্দগুলো যেন চোখে জল এনে দিতো, আজ তারা স্মৃতিতে তালাবদ্ধ, আর বাস্তবতায় অনুপস্থিত। আগে জানালার পাশে বসে থাকতাম ডাকপিয়নের অপেক্ষায়। এখন তো পিয়নের নামটাই কেউ জানে না। রিংটোন বাজে, কিন্তু সেই ব্যাকুলতা আর আসে না। একটা চিঠি মানেই একটা গল্প--প্রেমের, বিরহের, স্বপ্নের। কেউ লিখতো, কেউ পড়তো, আর এখন কেউ টাইপ করে।

আমার কৈশোর, আমার প্রথম ভালোবাসা, মায়ের বকুনি--সব কিছুই ছিলো সেসব চিঠিতে। এখন নেই চিঠি, নেই সেই আমিও। একটা সময় ছিলো, যখন মনের গভীর কথা লেখা হতো পাতাজুড়ে। প্রিয়জনের হাতে পেঁৗছাতে সময় লাগতো, তবে অপেক্ষার মধ্যে ছিলো ভালোবাসার গভীরতা।

নীলা আর ইমন ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলবে, হাসবে কঁাদবে শব্দ করে--দিনের পর দিন, ওদের ভালোবাসার পূর্ণতা পাবে, ঘর সংসার সাজাবে, বয়সের ভারে নিমজ্জিত হবে। ছেলেমেয়েরা বড়ো হয়ে গেছে, পড়ালেখার জন্যে বিদেশ পাড়ি দিয়েছে। কোনো এক বিকেলে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বেলকনিতে বসে গল্প করবে--ঘন্টার পর ঘন্টা ফোনালাপে কী কথা হয়েছিলো সেই দিনগুলোতে? মনে আছে কি ওদের? আমি জানি না ওদেরও হয়তো মনে নেই। দাদীর মতো পুরানো কাঠের বাক্সে কোনো চিঠি নেই। তাই স্মৃতি রোমন্থন বা পুলকিত হওয়ার মতো কিছু নেই ওদের কাছে। নীলা, ইমন বুঝবে না চিঠির অক্ষরে লেগে থাকতো কারো হাতের উষ্ণতা, একেকটা শব্দ যেন নিঃশব্দে বলে যেতো শত কথার ব্যথা বা আনন্দ।

হারিয়ে গেছে সেই কাগজের গন্ধ, কলমের কালি, হারিয়ে গেছে সেই প্রিয়তমার নামে লেখা প্রথম চিঠির কম্পন। তথ্যপ্রযুক্তি আমাদের অনেক কিছু দিয়েছে ঠিকই, তবে তার ছায়ায় ঢাকা পড়ে গেছে কিছু মূল্যবান অনুভূতির গল্প, যা শুধু লেখা হতো কাগজে নয়, লেখা হতো হৃদয়ের ক্যানভাসে। চিঠি ছিলো একসময়ের অনুভবের আয়না, যেখানে মানুষ লিখতো না, বরং ঢেলে দিতো হৃদয়ের কথা। প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি বিরাম চিহ্নের পেছনে থাকতো অপেক্ষা, ভালোবাসা, কিংবা মনের অভিমান।

তথ্যপ্রযুক্তি আমাদের দিয়েছে গতির ছেঁায়া, মুহূর্তেই যোগাযোগের সুযোগ। তবে এই দ্রুততার ভিড়ে হারিয়ে গেছে অপেক্ষা করার রোমাঞ্চ।

আজ সেই চিঠি নেই, নেই অপেক্ষার উত্তাপ। সবকিছু এক মুহূর্তেই পেঁৗছে যায়, তবু যেন কোথাও কিছু পেঁৗছায় না। কিন্তু তার ছায়ায় চাপা পড়ে গেছে অনেক নির্জন বিকেল, মনের গহীন থেকে উঠে আসা সেই চিঠির মতো লেখা, যেগুলো আর কখনও ফিরবে না, তবু মনে হয়, তারা আজও অপেক্ষা করে...একটা শান্ত দুপুর, একটা নিঃশব্দ কলম, আর একটুখানি হৃদয়ছেঁায়া সময়ের জন্যে। আমরা এগিয়ে যাচ্ছি ঠিকই, কিন্তু মাঝে মাঝে পেছন ফিরে সেই হারিয়ে যাওয়া অনুভবগুলোকেও মনে রাখা দরকার। কারণ সেগুলোই আমাদের মানুষ করে তোলে।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, সাহিত্য একাডেমি, চঁাদপুর।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়