প্রকাশ : ১৫ জুন ২০২৫, ০১:৫১
আদর্শ পিতা

আমার পিতা মরহুম কাজী ছেফায়েত উল্লাহ্ কোনো মহাপুরুষ বা মনীষী ছিলেন না। তিনি ছিলেন না কোনো রাজনীতিবিদ, কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী কিংবা উচ্চপদস্থ কোনো কর্মকর্তা। তিনি ছিলেন একজন সাধারণ মানুষ। সাধারণ্যে তাঁর জন্ম, সাধারণ ছিল তাঁর জীবনযাপন এবং সাধারণ্যে ছিলো তাঁর মৃত্যু। উল্লেখ করার মতো বিষয় হচ্ছে, তিনি ছিলেন একজন আদর্শ পিতা, যাঁর ঔরসে জন্ম নিয়েছে ১৩টি সন্তান এবং তাদের মধ্যে ১২জন মানুষ নামের সার্থকতা নিরূপণ করেছেন তাঁরই আদর্শের ধ্বজা উড়িয়ে। এজন্যেই তিনি অনুকরণীয়, অনুসরণীয় এবং তাঁর ঘটনাবহুল জীবনের বিভিন্ন দিক উপভোগ্য ও দৃষ্টান্তমূলক।
|আরো খবর
আমার পিতার নামের আভিধানিক অর্থ আল্লাহর গুণাবলি। প্রতিটি মানুষের মাঝে যেমন কম-বেশি আল্লাহর গুণাবলী প্রতিফলিত হয়, তেমনি আমার পিতার মাঝেও হয়েছিলো। তবে সেটা কম নয়, বেশি। যার কারণে তাঁকে আল্লাহর নেক বান্দা বললে অত্যুক্তি হবে না। তিনি যাঁকে তাঁর সহধর্মিণী হিসেবে পেয়েছিলেন তিনি হলেন আমার পরম শ্রদ্ধেয়া মা মোসাম্মৎ জোবায়দা বেগম। আমার নানা যাঁকে আদর করে ডাকতেন ‘জবা’। উদ্ভিদ বিজ্ঞানে পড়েছি জবা ফুল হচ্ছে একটি আদর্শ ফুল। আমার মা একজন আদর্শ মা হয়ে জবা নামের সার্থকতা ফুটিয়ে তুলেছেন। এভাবে আমার আদর্শ পিতার সাথে আদর্শ মায়ের অপূর্ব সমন্বয় ঘটায় বস্তুত আমার পিতার পরিচালিত সংসারের বাঁধন ছিলো অটুট এবং তাঁর সমগ্র জীবন ছিলো সুশৃংখল ও পরিচ্ছন্ন।
আমার নানা মরহুম চাঁদ মিয়া ছিলেন একজন দারোগা। আর আমার পিতা রেলওয়েতে স্টেশন মাস্টারের চাকুরি নেয়ার আগে ছিলেন পুলিশের সহকারী দারোগা (এ.এস.আই.)। এ প্রেক্ষিতে বলা যায়, দারোগা বিয়ে করেছেন দারোগার ঝিকে এবং তাঁরা উভয়ে ‘দুষ্টের দমন ও শিষ্টের লালনে’ একাত্ম হয়ে সংসারকে গড়েছেন তিলে তিলে। সাধারণত আমরা লক্ষ্য করি, একটি সংসারে বাবা কোনো সন্তানের প্রতি কঠোর হলে মা কোমল হন। আবার মা কঠোর হলে বাবা হন কোমল। কিন্তু আমার বাবা-মার ক্ষেত্রে এমনটি লক্ষ্য করিনি। দেখেছি, বাবা কোনো বিষয়ে ভাই, বোনদের প্রতি কঠোর হয়েছেন তো, সাথে সাথে মা-ও হয়েছেন। অর্থাৎ মা'র কাছ থেকে কেউ বাড়তি সুবিধা অর্থাৎ আস্কারা বা প্রশ্রয় পায়নি। এমন একাত্ম স্ত্রী নিয়ে আমার পিতা নিজের জীবন গড়েছেন, সংসার পরিচালনা করেছেন এবং সন্তান হিসেবে আমাদেরও গড়েছেন।
ছোট্ট একটি উদাহরণ দেই। আমি ও নজু ভাই যখন ৫ম ও ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র, তখন আব্বা একদিন আদেশ করলেন, বাদ ফজর যেন মরিচ ক্ষেত নিড়াতে যাই। পর পর দু দিন এ আদেশ অমান্য করলাম। বিষয়টি আম্মার দৃষ্টিগোচর হয়। তৃতীয় দিন যখন এ আদেশ অমান্য করতে উদ্ধত হলাম, তখন আম্মা মানে ‘দারোগার ঝি’ দারোগার ন্যায় আচরণ প্রদর্শন করে বললেন, “আমি আমার মরা বাপের কসম খেয়ে বলছি, তোরা যদি আজ তোদের আব্বার কথা মতো মরিচ ক্ষেত নিড়াতে না যাস তাহলে তোদের খাবার বন্ধ থাকবে।” দেখলাম এতে রয়েছে বাবার মৌন সমর্থন। কী আর করা। অগত্যা মরিচ ক্ষেত নিড়িয়ে এসে খাবার প্রাপ্তির নিশ্চয়তা বিধান করতে হলো। এমনিভাবে সন্তানদের কল্যাণের লক্ষ্যে তাদের সুপথে পরিচালনার নিমিত্তে যে কোনো বিষয়ে আব্বা-আম্মার ঐকমত্য ছিল লক্ষ্যণীয়।
আমার পিতার জন্ম হয়েছিল বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে। শুনেছি সংসার বিরাগী আমার দাদা কাজী আ. জাব্বার একতারা বাজিয়ে তখন আল্লাহর গুণগানে মগ্ন ছিলেন। এমতাবস্থায় তাঁর বেড়ে ওঠা ও শিক্ষা গ্রহণ কিছুটা বাধাগ্রস্ত হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু আমার প্রতিভাদীপ্ত বাবার প্রবল আগ্রহে তাঁর শ্রদ্ধেয় বড়োভাইগণ অর্থাৎ আমার জেঠাদের সহযোগিতায় তিনি বলাখাল হাইস্কুলে পড়ার সুযোগ পান এবং আমাদের বাড়ির প্রথম ব্যক্তি হিসেবে ম্যাট্রিক পাস করেন। অতএব তিনি হয়ে যান এ বাড়ির আলোকবর্তিকা, যাঁর আলোকচ্ছটায় আরো অনেকে ম্যাট্রিক পাস ও উচ্চতর শিক্ষাগ্রহণে ব্রতী হন এবং সাফল্য অর্জন করেন।
শিক্ষা যে মানুষকে সব দিক দিয়ে উন্নত করে আমার পিতা তার বহু প্রমাণ রেখে গেছেন। তিনি আমাদের বাড়ির অবকাঠামোগত উন্নয়নে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। তিনি বাড়ির সাথে রেল সড়কের সংযোগকারী রাস্তা নির্মাণ এবং বাড়ির সামনে কাচারী সহ বাড়িতে প্রয়োজনীয় পাকা ল্যাট্রিন নির্মাণে উদ্যোগ নিয়ে বাড়ির শ্রীবৃদ্ধি করেন। এভাবে তিনি শাড়ির সামগ্রিক পরিবেশ উন্নয়নে আমৃত্যু কাজ করে গেছেন। যার জন্য আমাদের গ্রামের মধ্যে মধ্যবয়সী ও বৃদ্ধ প্রায় প্রতিটি মানুষের কাছে তিনি এখনো শ্রদ্ধার সাথে স্মরণীয়-বরণীয় হয়ে আছেন। এটা যে সন্তান হিসেবে আমাদের কাছে কতোটা গর্বের ও আত্মতৃপ্তির বিষয় তা’ কেবল অনুধাবন করা যায়--লিখে পুরোপুরি বোঝানো যায় না। আমাদেরকে আমাদের এলাকার এখনো কেউ যখন জিজ্ঞেস করে জানতে পারে আমরা ‘কাজী ছেফায়েত উল্লাহর’ সন্তান এবং বলেন “অহ। বড়ো ভাল লোক ছিলেন তিনি।” তখন অপরিমেয় আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাই।
আমার পিতা সত্যিই ছিলেন এজন কর্মবীর। ম্যাট্রিক পাস করেই তিনি প্রথমে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন, তারপর পুলিশে চাকুরি এবং সর্বশেষে রেলওয়ের চাকুরিতে যোগদান করেন। তিনি মানব সেবার মহান লক্ষ্যে হোমিওপ্যাথি শাস্ত্রও অধ্যয়ন করেন। রেলওয়ের চাকুরির ব্যস্ততায় তিনি হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা প্র্যাকটিস করতে পারবেন না বলে আম্মাকে হোমিওপ্যাথি শাস্ত্র সম্পর্কে জ্ঞান দেন এবং তাঁকে দিয়ে প্র্যাকটিস করান। আমার পিতার অর্থানুকূল্যে ও পৃষ্ঠপোষকতায় আম্মাকে হোমিওপ্যাথি শাস্ত্র মোতাবেক বিনামূল্যে ঔষধ দিয়ে গরীব-দুঃখী মানুষের সেবা করতে দেখেছি। আমার পিতা কতোটুকু যোগ্যতাসম্পন্ন লোক হলে আমার আম্মার মতো উচ্চ প্রাইমারী পাস একজন নারীকে চিকিৎসার মতো জটিল বিষয়ে রপ্ত করাতে পেরেছেন তা আর বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না।
আমার মাকে আমার পিতা একজন দক্ষ শিক্ষিকা হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। আমরা প্রায় সব ভাই-বোন প্রাইমারী স্কুলের লেখাপড়ায় মাকেই মোক্ষম শিক্ষিকা হিসেবে পেয়েছি। আমার পিতা আমার মাকে শিক্ষাদানের বিষয়টি যত্ন সহকারে তালিম দিতেন। এ তালিম পেয়ে মা যে কেমন দক্ষ শিক্ষিকা হয়েছিলেন তা আমাকে দিয়েই বোঝানো যায়। আমি শৈশবে অস্বাভাবিক দুষ্টামি করতাম। আমার ৬/৭ বছর বয়স কেটেছে শুধুমাত্র দুষ্টামি, অযৌক্তিক বায়না ধরা, প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে কান্নাকাটি এবং খাবার নিয়ে অহেতুক বাড়াবাড়ির মধ্য দিয়ে। আমার পিতার শাসন-সোহাগ কিছুই আমাকে শিক্ষার প্রতি অনুরাগী করে তুলতে পারলো না। আমার পিতা নিজের ব্যর্থতা অকপটে স্বীকার করে মাকে অবশেষে একদিন বলেছিলেন, “আমি আর পারলাম না, এবার তুমি চেষ্টা করো।” ঠিকই মা চেষ্টা করেছেন এবং সফলও হয়েছেন। আমাকে কোলে নিয়ে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে মা কয়েকদিন অসম্ভব রকমের আদর-সোহাগ প্রদর্শন করে প্রথমে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করান। আমি শিক্ষা গ্রহণে রাজী হলাম, তবে শর্ত হলো : বাসায় পড়বো, স্কুলে যাবো না। মাকে অবশেষে আমার চরম গোয়ার্তুমির মুখে এ শর্ত মেনে নিয়ে একটা আপোষরফায় আসতে হলো। মায়ের কাছে আমি প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর সকল পাঠই গ্রহণ করি এবং তাঁর তত্ত্বাবধানে ঘরে বসে স্কুলের ন্যায় পরীক্ষা দিয়ে ভালো নম্বর পেয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হবার পর স্কুলে গিয়ে তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হই। মায়ের এ সফলতায় আমার পিতাকে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে দেখেছি।
আমাকে নিয়ে আরেকটি প্রসঙ্গ না টেনেই পারছি না। আমার পিতা যখন চট্টগ্রামের ষোলশহর রেলস্টেশনে চাকুরি করতেন, তখন নজু ভাই ও আমাকে নিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মুসলমানি করিয়েছিলেন। আমাদের সুস্থ হতে হতে একমাস সময় লাগলো। আমরা পড়তাম হামজারবাগ মিউনিসিপ্যাল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সুস্থ হবার পর নজু ভাই স্কুলে গেলেন। আমি আর গেলাম না। কারণ স্কুলে গিয়ে শ্রেণী শিক্ষকের কাছে একমাস ক্লাস করতে না পারার কৈফিয়ত প্রকাশ্য দিয়ে সম্ভাব্য লজ্জা পেতে হবে। স্কুলের সময় হলেই আমি প্রতিদিন চট্টগ্রামের অভিজাত আবাসিক এলাকা ‘সোসাইটি’তে পালিয়ে যেতাম। আমার কোনো ভাই-ই আমাকে খুঁজে পেতো না। আব্বা একদিন ভাইদের এ ব্যর্থতায় নিজেই আমাকে খুঁজতে বেরুলেন। একসময় শুরু হলো মুষলধারে বৃষ্টি। আমি আশ্রয় নিলাম একটি চা দোকানের ভেতরে। আর আব্বা দাঁড়ালেন ঐ দোকানেরই সম্মুখভাগে। আব্বাকে দেখেই একজন জিজ্ঞেস করলেন, আরে মাস্টার সাহেব আপনি এখানে? জবাবে আব্বা অত্যন্ত উৎকণ্ঠার সাথে আমার পালিয়ে বেড়ানোর কাহিনী বললেন এবং আমার পড়ালেখা নিয়ে তাঁর চরম হতাশা ব্যক্ত করলেন। সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে যখন আব্বার বেত্রাঘাতে পৃষ্ঠদেশ জর্জরিত হচ্ছিলো তখন কেঁদে কেঁদে সাহস করে বলেছিলাম,” আপনি মেরে ফেললেও আমি আর এ স্কুলে যাবো না। আমাকে গ্রামের স্কুলে ভর্তি করে দেন। দেখুন, আমি পড়ি কি না।” অবশেষে চাকুরি থেকে অবসর গ্রহণের কারণে আব্বা সপরিবারে রাড়ি ফিরে এলে আমাকে বলাখাল হাইস্কুল সংলগ্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দেন। আব্বার হাতে মার খেয়ে আমি যে কথা দিয়েছিলাম এ বিদ্যালয়ে এসে তা’ রক্ষা করেছি। আমি ৪র্থ শ্রেণী থেকে প্রথম হয়ে পঞ্চম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়েছি এবং প্রাথমিক বৃত্তিও লাভ করেছি। আমার স্পষ্ট মনে আছে, একদিন ঘুমের ঘোরে শুনছি, আব্বা মাকে বলছেন “দেখেছো ছেলেটি আমার তো ঠিকই বলেছে, গ্রামের স্কুলে ভর্তি করালে সে ভালোভাবে পড়ালেখা করবে।”
আমার পিতা সন্তানদেরকে কঠোর অনুশাসনে আবদ্ধ রাখলেও তাদের যে কোনো সাফল্য মূল্যায়ন করতেন, প্রশংসা করতেন। কারো সাথে বড় ভাইয়ের প্রসঙ্গ আসলেই বলতেন, “বাচ্চুকে ওয়ালিউল্লাহ্ পাটোয়ারীর মতলব হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করিয়েছি। আর কিছু না হোক আমার এ ছেলেটির হাতের লেখা বড্ড চমৎকার।” মেঝো ভাইকে নিয়ে আব্বার গর্ব করার সীমা ছিল না। তিনি হৃষ্টচিত্তে, পরম তৃপ্তি ও প্রশান্তির প্রতিতাসে প্রোজ্জ্বল হয়ে বলতেন, “ছেলেটা আমার ইংরেজিতে এম.এ. পাস করে প্রফেসারি করছে। দোয়া করবেন।” সেজো ভাই (সামছু ভাই) সোনাইমুড়ি হাইস্কুল থেকে এস. এস.সি. পাস করার পর আব্বাকে আনন্দ উৎসব পালন করতে দেখেছি। স্কুলের শিক্ষক, তাঁর সহকর্মী, গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে তিনি সোনাইমুড়ি স্টেশনের ওয়েটিং রুমে মিষ্টি খাওয়ার বিরাট অনুষ্ঠান করেছিলেন। সে অনুষ্ঠানে পরিবেশিত চৌকোণ এক জাতীয় সুস্বাদু মিষ্টির কথা মনে পড়লে আজো আমার জিভে পানি এসে যায়।
আমার পিতা পুত্রদের নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখতেন। তাঁর স্বপ্নের কিয়দংশ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তিনি পাকিস্তান আমলে মাত্র ২৭ শ' টাকায় আমাদের বাড়ির লাগ পশ্চিম পাশে খালের পাড়ে ‘বাগ’ নামের একটি উঁচু জমি কিনেছিলেন। এ জমিতে তিনি পুত্রদের জন্যে পৃথক পৃথক ঘর নির্মাণের উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা করেছিলেন। অথচ এ জমিকে ঘিরে চাকুরি থেকে তাঁর অপ্রত্যাশিত আগাম অবসরগ্রহণের দুঃসহ স্মৃতি জড়িত। একদিন বাড়ি থেকে চিঠি এলো, এ জমিটি নিয়ে কুখ্যাত হাকিম মাওলানা (যার ওপর আমার আমৃত্যু অভিসম্পাত) একটি মিথ্যা মামলা (প্রিয়েম্পশন কেস) করেছে, আমার পিতাকে সে মামলার জবাব দিতে ও আদালতে হাজিরা দিতে বাড়ি যেতে হবে। আমার পিতা তড়িঘড়ি করে ছুটি নিয়ে বাড়ি গেলেন। ষোলশহর স্টেশন মাস্টারের চেয়ারটিতে হেলান দিয়ে তাঁর সর্বশেষ বসার তৃপ্তিটুকু তিনি আর দ্বিতীয়বারের জন্যে পেলেন না। কারণ তিনি যখন বাড়িতে তখন ষড়যন্ত্রমূলকভাবে সম্পূর্ণ বিনা অপরাধে তাঁকে নির্দিষ্ট সময়ের ছয়মাস পূর্বে অবসর গ্রহণ করার চিঠি সংশ্লিষ্ট উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ থেকে এনে জনৈক করিম সাহেব ষোলশহর স্টেশন মাস্টারের চেয়ারে উপবিষ্ট হলেন। আমার পিতা থেকে চার্জ বুঝে নেবার অপেক্ষাটুকু পর্যন্ত তিনি করেন নি। মামলা সংক্রান্ত কাজ শেষে আব্বা বাড়ি থেকে ষোলশহর ফিরলেন। ট্রেন থেকে স্টেশনের প্লাটফর্মে নামলেন। তাঁর রুমের দিকে এগুলেন। ঢুকতেই দেখলেন তাঁর চেয়ারে আরেকজন বসা। অস্ফুট যন্ত্রণায় তিনি কঁকিয়ে উঠলেন। অবশেষে সব জানলেন এবং দেখলেন, সমগ্র স্টেশন জুড়ে কেমন নির্বান্ধব পরিবেশ। তাঁর সহকর্মীদের মধ্যে অল্প ক’দিন পূর্বেও যারা তাঁকে দেখলেই ছিলো ভক্তিতে গদগদ, আজ তারা কেমন যেন না চেনার ভান করছে। শরীরে হতাশার কাফন জড়িয়ে অস্বাভাবিক মলিন মুখে তিনি বাসায় ফিরলেন এবং বেদনার্ত অনুভূতিতে অনেক কথার সাথে এ কথাটিও বলেছিলেন, “হায়রে জগত। চেয়ারে থাকলে কতো দাম, আর না থাকলে সে দাম যায় কোথায়!”
মনে হয় অফুরন্ত দীর্ঘশ্বাস নিয়েই আমার পিতা তাঁর প্রিয় কর্মস্থল ছেড়ে স্থায়ীভাবে গ্রামের বাড়ি চলে এলেন। সে কী নিদারুণ পরিস্থিতির মুখোমুখি হলেন তিনি। বড়ো ভাই ও বড়ো দু বোন ছাড়া তাঁর ওপর বাকি ৯ ভাই-বোনের নির্ভরশীলতায় তিনি তখন ভারাক্রান্ত। ভাই-বোনদের কেউ ইউনিভার্সিটিতে, কেউ কলেজে, কেউ স্কুলে পড়ছিলো। তাঁর গ্রাচ্যুইটির টাকা নিয়েও দেখা দিলো সমস্যা। এমতবস্থায় তিনি কী করবেন কোথায় যাবেন--চোখে মুখে যেন দেখছিলেন ঘোর অন্ধকার। তার ওপর স্বপ্ন বিলাসের ধন ‘বাগ’ নামক উঁচু জমিটি নিয়ে চলছিলো মামলা। এ মামলা চালাতে উকিল-মোক্তারের নিকট আর আদালতে দৌড়াদৌড়ির বাড়তি ঝামেলাও ছিল তাঁর। এছাড়া লাগাতার শারীরিক অসুস্থতা তো ছিলোই। অতএব কেমন বিভীষিকাময় দিন তিনি অতিবাহিত করছিলেন, তা’ ধারণা করলেই বোঝা যায়। এমন সমস্যাসঙ্কুল অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে আমার পিতা প্রথমেই সিদ্ধান্ত নিলেন মামলাটি আর চালাবেন না। বিলওয়াইর জনৈক জয়নাল মাস্টারের মধ্যস্থতায় তিনি ২৭ শ' টাকার বিনিময়ে সম্পত্তিলোভী হাকীম মাওলানাকে ‘বাগ’ ফেরত দিলেন। আর চরম আর্থিক সংকট দূরীকরণে তিনি কিছু জায়গা বিক্রি করেন। জায়গা বিক্রিকালে তিনি আমার মায়ের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, “জায়গাগুলো আর রাখতে পারলাম না। তবে জায়গা বিক্রি করে আমি আমার সন্তানদের পড়ালেখা করিয়ে তাদের মাঝে যে শিক্ষার আলো রেখে যাবো, তা’ কেউ কোনোদিন নিভাতে পারবে না বা বিক্রি করতে পারবে না।”
অস্বাভাবিক ও অন্যায়ভাবে চাকুরি থেকে অবসরগ্রহণ এবং এর প্রতিবাদ করতে না পারার যন্ত্রণায় আমার পিতা হঠাৎ করেই যেন স্বাধীন পেশা ব্যবসার প্রতি ভীষণ অনুরক্ত হয়ে পড়েছিলেন। তিনি বলতেন, ব্যবসা করলে কারো গোলামি করতে হয় না । সবসময় টাকা চালাচালিতে মন থাকে সতেজ। স্বাধীনভাবে এদিক-সেদিক যাওয়া যায়। তিনি যে কোনো ব্যবসার প্রসঙ্গে আসলে লাভের হিসেবটা অগ্রিম করে ফেলতেন এবং লাভের টাকা কোন্ কোন্ খাতে খরচ করবেন তারও পরিকল্পনা করতেন। এ সময় আম্মা, জেঠীআম্মা আব্বাকে রসিকতা করে বলতেন, “বুঝেছি যে ব্যবসায় লাভের হিসাব আগে করা হয় সে ব্যবসা আপনাকে দিয়ে আর হবে না।” আমার পিতা কিন্তু তাঁর ব্যবসা-প্রীতিকে অটুট রাখার জন্যে বলাখাল বাজারে ধানের ব্যবসা শুরু করেছিলেন। কিন্তু অভিজ্ঞতা ও পুঁজির অভাব এবং মুনাফ বেপারী নামে এক ব্যক্তির একই বাজারে উদ্দেশ্যমূলকভাবে হঠাৎ ধানের ব্যবসায় আগমনহেতু আমার পিতা ব্যবসায় সফলতা না পেয়ে তা আবার গুটিয়ে ফেললেন।
আমার পিতা জীবনের প্রথমভাগে এবং জীবনের শেষভাগে কঠোর সংগ্রাম করেছেন। তাঁর জীবনের মধ্যভাগটা ছিল তুলনামূলকভাবে সুখকর ও স্বস্তিদায়ক। রেলওয়ের স্টেশন মাস্টার হিসেবে তিনি সুদূর আসাম, সিলেট ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্টেশন সহ কুমিল্লা, নোয়াখালী ও চাঁদপুরের বিভিন্ন স্টেশনে চাকুরি করেছেন। বদলিতে তিনি অখুশি হতেন না। তিনি বলতেন, চাকুরিতে বদলি হবার সুবাদে সরকারি খরচে দেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করে মানুষের সাথে মেশা যায় এবং ভিন্ন ভিন্ন ভাষা, সমাজ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। আমার বড়ো ভাই, মেজো ভাই, সেজো ভাই সরকারি চাকুরি করেন এবং আব্বার ন্যায় দেশের আনাচে-কানাচে, সুদূরে- অদূরের কর্মস্থলে স্বাচ্ছন্দ্যে ও সুনামের সাথে সততা ও নিষ্ঠার পরিচয় দিয়ে কাজ করার নজির স্থাপন করেছেন। বিশেষ করে কাস্টমস ইন্সপেক্টর হিসেবে কর্মরত আমার মেজোভাই সিলেটের সীমান্ত এলাকা শেওলা, রংপুরের সীমান্ত এলাকা বুড়িমারী থেকে শুরু করে নিজের থানা সদর হাজীগঞ্জ, জেলা সদর চাঁদপুর, সাবেক জেলা সদর কুমিল্লা, বিভাগীয় শহর চট্টগ্রাম, দাউদকান্দি, ঢাকা আন্তজার্তিক বিমান বন্দরসহ যেখানেই তাঁকে কর্তৃপক্ষ বদলি করেছেন, হাসিমুখে নির্দ্বিধায় কাজ করে এসেছেন। আমার এ ভাই চট্টগ্রামের রাউজান ও সীতাকুন্ড এবং ফেনীর ছাগলনাইয়ায় অবস্থিত কলেজগুলোতে সরকারি চাকুরি লাভের পূর্ব পর্যন্ত অধ্যাপনা করেছেন। বিভিন্ন কর্মস্থলে চাকুরি করার ক্ষেত্রে আমার পিতার মানসিকতাকে লালন করে আমার মেজোভাই অভিজ্ঞতার ভান্ডারকে করে তুলেছেন সমৃদ্ধ, যা সত্যিই প্রশংসনীয়। আমার পিতা এতো দক্ষতার সাথে কাজ করেছেন যে, তাঁর সাড়ে তিন দশকের স্টেশন মাস্টারের চাকুরিজীবনে তাঁর স্টেশনে কখনো কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি। আমার পিতা তাঁর সহকর্মীদের খুব আন্তরিকতা ও যত্নের সাথে কাজ শিখাতেন এবং ভালোবাসতেন। তাঁর কর্মজীবনের সুনাম আজো তাঁর সহকর্মী, এমনকি রেল কর্মকর্তাদের মুখেও শোনা যায়।
মায়ের সাথে আমার আব্বার সুমধুর সম্পর্ক ছিলো। আব্বা বেতন পেয়ে সম্পূর্ণ টাকাটাই মায়ের কাছে গচ্ছিত রাখতেন। আর আমার মা আমানতের ন্যূনতমও খেয়ানতও করতেন না। আব্বার অনুমতি বা সম্মতি ছাড়া মা গচ্ছিত অর্থ থেকে কোনোরূপ খরচ করতেন না। আমার মনে আছে, আব্বাকে মায়ের কাছে টাকা গচ্ছিত রাখতে দেখে একদিন আমি সে টাকা থেকে মাত্র চার আনা/আট আনা দেয়ার জন্যে পীড়াপীড়ি ও কান্নাকাটি করেও কোনো ফলোদয় হয় নি। আব্বা মাকে অসম্ভব ভালোবাসতেন বলে তাঁকে সামনে রেখেই সজ্ঞানে কলেমা পড়ে মৃত্যুকে বরণ করেছেন। মৃত্যু যন্ত্রণা টের পেয়ে আব্বা মা’র হাত ধরে নাকি বলেছিলেন, আমি তোমাকে ধন সম্পত্তি সহ উল্লেখযোগ্য তেমন কিছুই দিয়ে যেতে পারিনি, তবে আমার বিশ্বাস ও আমি দোয়া করছি, তোমার ছেলেরা সৎ ও কর্মনিষ্ঠ হবে এবং তারাই হবে তোমার জন্যে প্রকৃত ধন।
নিছক স্মৃতিচারণ করলেই আমার পিতার সম্পূর্ণ আদর্শিক অবয়ব ফুটে উঠবে না। তাই তাঁর কিছু গুণ ও অভ্যাসের কথা বলা প্রয়োজন।
আমার পিতা বড়ো স্বাস্থ্য সচেতন ছিলেন। সুন্দর স্বাস্থ্য রক্ষার প্রয়োজনে খেলাধুলার ব্যাপারে তিনি আমাদের সকল ভাই-বোনকে প্রচণ্ড তাগিদ দিতেন। খাবারের পুষ্টিমান সম্পর্কে তিনি ছিলেন খুব সজাগ। শাক-সবজি খাওয়ার জন্যে তিনি মায়ের মাধ্যমে আমাদের সবার ওপর সর্বদা ফরমান জারি করে রাখতেন। পাটের শাক ও করলা তিতা হওয়া সত্ত্বেও এগুলো শরীরের জন্যে খুব উপকারী বিধায় তিনি নিজ তত্ত্বাবধানে এগুলো আমাদের খাওয়াতেন। আব্বার আদেশে শীতকালে রোদে বসে গরম ভাতের সাথে ঘি মিশিয়ে আমাদের খেতে হতো। ঘি-ভাত কার কাছে কেমন লাগতো জানি না, তবে আমার কাছে বেশ মজা লাগতো।
তাজা শাক-সবজি, খাঁটি দুধ, ঘি, ডিমের প্রয়োজনে আমার পিতা সরকারি বাসার আশেপাশে খালি জায়গায় বাগান করতেন এবং গাভী ও হাঁস-মুরগী পালন করতেন। লালমাইতে আমার পিতা একটি গাভী পালন করেছিলেন, যেটি ছিল অত্যন্ত দুগ্ধবতী। আদর করে আব্বা এটির নাম রেখেছিলেন মুক্তা। এ গাভীটিকে নাকি আব্বা আমাদের নানার এলাকা থেকে বাছুর অবস্থায় সংগ্রহ করে লালন-পালন করে বড়ো করেছেন। এ গাভীটিকে আব্বা যেদিন বিক্রি করে দেন সেদিন আব্বা ও মা সহ আমাদের পরিবারের সকল সদস্য কম-বেশি মর্মাহত ও অশ্রুসজল অবস্থায় লক্ষ্য করেছি। আব্বা সান্ত্বনা দিয়ে সবাইকে বলেছিলেন, তোমরা সবাই মন খারাপ করছো কেন?--গরু তো আর মানুষ নয়। অথচ সান্ত্বনা প্রদানকারী আমার পিতাকেই অনেকদিন যাবত ‘মুক্তা’ নামক এ গাভীটির খোঁজ-খবর নিতে দেখেছি। এ গাভীটির যত্নে নিয়োজিত ছিলেন জনৈক আবুল হাসেম।
এই আবুল হাসেমের বাড়ি লালমাই স্টেশনের নিকটবর্তী একটি গ্রামে। আবুল হাসেমকে তার শৈশবকালে আমার পিতা আমাদের ঘরের নানা কাজে সহযোগিতা ও গাভী পালনের সুবিধার্থে সংগ্রহ করেছিলেন। কাজের লোক বলে আব্বা তাকে অবজ্ঞা, উপক্ষো ও অযত্ন করেন নি। তাকেও আমাদের মতো স্নেহ করতেন। ফলে আবুল হাসেম আমার আব্বা ও মাকে আব্বা-আম্মা বলেই ডাকতো। আর আমরা যারা বয়সে ছোট ছিলাম, আমরা তাকে আব্বা-আম্মার নির্দেশে ‘হাসেম ভাই’ বলেই সম্বোধন করতাম এবং আজো তাকে সে সম্বোধনই করি। এভাবে হাসেম ভাইয়ের মাধ্যমে আমার পিতা আমাদের এ শিক্ষা দিয়েছেন, মানুষের মাঝে নানা কারণে বিশেষত ধনী-দরিদ্রহেতু ভেদাভেদ থাকতে পারে, কিন্তু এজন্যে একজন আরেকজনের কাছে অমর্যাদার পাত্র হতে পারে না।
আমার পিতা রমজানের ইফতারকে কেন্দ্র করে খাবার-দাবারের বিরাট আয়োজনে মশগুল থাকতেন। সোনাইমুড়ির বাসায় রমজান মাসের একদিন বিকেল ৩/৪ টার দিকে রান্নাঘরে বসে মাকে রান্নাবান্নারত অবস্থায় চুপিসারে কাঁদতে দেখে আমি কৌতূহলী হলাম। কেন কাঁদছেন বার বার জিজ্ঞেস করায় জবাব দিলেন, তোর আব্বা আমাকে ইফতারের যেসব সামগ্রী তৈরি করতে বলেছেন তা আমি যথাসময়ে শেষ করতে পারবো কিনা সে চিন্তায় কাঁদছি। এটা খুব একটা বড়ো ঘটনা নয়। তবে আমার পিতার ইফতার আয়োজনের বিশালত্বের দিকটাকে সুস্পষ্টভাবে ইঙ্গিত করে বলে এ ঘটনাটি আমি আজো ভুলতে পারিনি।
আমার পিতার মসজিদ গড়ার কাহিনী বড়োদের কাছে শুনেছি। কিন্তু রমজান মাসে বাড়ির সবাইকে চাঁদার মাধ্যমে একটা বড়ো ধরনের মিলাদ মাহফিল আয়োজনে উদ্বুদ্ধ করার ঘটনাটা তো নিজের চোখেই দেখেছি। তিনি বাড়ির সবাইকে বলতেন, প্রতি ঘরে পৃথক পৃথক ভাবে মিলাদ আয়োজনের চাইতে সম্মিলিতভাবে মিলাদ আয়োজনের মাহাত্ম্য অনেক। এতে পারস্পরিক মনোমালিন্য দূর হবার সুযোগ হয়, সম্প্রীতি সৌহার্দ্য বাড়ে, সর্বোপরি অনেক খরচ বাঁচে। তাঁর এ যৌক্তিক বিশ্লেষণে আমাদের বাড়িতে সত্তরের দশকে বেশ ক’বছর যাবত প্রতি রমজানে সম্মিলিতভাবে বিরাটাকারে মিলাদ হতো, যা তাঁর মৃত্যুর পর আর কোনো রমজানে হতে দেখিনি।
আমার পিতা সবসময় বলতেন, কাউকে কথা দিলে নিজের ক্ষতি হলেও তা রক্ষা করতে হয়। তিনি এর গুরুত্ব সবার উপলব্ধিতে ধরিয়ে দেবার জন্যে বলতেন, জবানের মূল্য লাখ টাকা। তাইতো তাঁকে দেখেছি কোনো বিয়ে-শাদীর ব্যাপারে তিনি কাউকে পাকা কথা দিয়ে তা রক্ষা না করে ছাড়েন নি। এজন্যে তিনি যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকতেন।
সময়কে কাজে লাগানোর ব্যাপারে আমার পিতার ছিলো তীক্ষ্ণ সচেতনতা। লক্ষ্য করতাম, তিনি সুবহে সাদেক বা তারও পূর্বে ঘুম থেকে ওঠে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়েছেন, তারপর ফজর নামাজ এবং নামাজ শেষে কোরাণ তেলাওয়াত ও দরূদ পাঠ, মাঠে গিয়ে ফসল পর্যবেক্ষণ বা প্রাতঃভ্রমণ, নিড়ি কাঁচি দিয়ে ক্ষেতে নিড়ানি দেয়া, কোদাল দিয়ে ক্ষেত কোপানো বা মাটির চাকা ভাঙ্গা ও তারপর নাস্তা খাওয়া, বাজারে যাওয়া, বাজার শেষে রান্নার কাজে আমার মাকে সহযোগিতা দেয়া, ক্ষেতের কাজ থাকলে তা করা, কিংবা প্রতিবেশীদের খবরাখবর নিতে বেরিয়ে পড়া, কাউকে সৎ পরামর্শ দেয়া, খোশগল্প করা, দুপুরে গোসল, যোহরের নামাজ, আহার ও বিশ্রাম, আসর নামাজ শেষে বৈকালিক ভ্রমণ বা ক্ষেতে কাজ করা, মাগরিবের নামাজ আদায় ও ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা তত্ত্বাবধান, মায়ের সাথে সুখ-দুঃখের আলাপ, এশার নামাজ আদায় এবং রাতের খাবার শেষে সামান্য পায়চারি ও ১০টার মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়া ছিলো আব্বার অবসরকালীন জীবনের প্রাত্যহিক রুটিন। তিনি এ রুটিনমাফিক জীবন পরিচালনার ব্যাপারে সব সময় গুরুত্ব দিতেন।
মানুষের সাথে কথা বলার মাঝে আমার পিতা পেতেন নির্মল আনন্দ। তাঁর এ স্বভাবের কারণে বাড়ি থেকে আধা মাইল দূরবর্তী বাজারে আসা যাওয়ায় অনেক সময় দু ঘন্টা সময়ও কুলাতো না। কারণ বাজারের পথে যতো লোকের সাথে তাঁর দেখা হতো তাদের সাথে তিনি কুশল বিনিময় হতে শুরু করে দেশের রাজনীতি সংক্রান্ত আলাপ-আলোচনা সেরে নিতেও কসুর করতেন না। এর ফলে বাজারে গিয়ে অনেক সময় তাজা মাছসহ প্রয়োজনীয় জিনিস পাওয়া যেতো না। আব্বার বাজার নিয়ে ফিরতে পথে দেরি হবার কারণে মাছ পচে যাবার ঘটনাও ঘটতো। মা কখনো এজন্যে একটু আধটু বকুনি দিলে আব্বাকে বলতে শুনেছি, এমন করো কেন, মানুষকে টাকা দিয়ে সাহায্য করতে পারি না; একটু কথা বলে দুঃখে সান্ত্বনা দিলে, সুখে আনন্দ প্রকাশ করলে কিংবা বিপদে-আপদে সৎপরামর্শ দিলে মানুষ খুশি হয়।
আমার পিতা খুব সুন্দর চিঠি লিখতে পারতেন এবং আমাদেরকে বড়ো ভাই-বোন, নানা-নানী, মামা-মামী, খালা-খালু, জেঠা-জেঠীসহ সকল আত্মীয়স্বজনের কাছে চিঠি লিখার তাগিদ দিতেন। তিনি নিজে যখন চিঠি লিখতে অসুবিধা বোধ করতেন, তখন আমাদেরকে দিয়ে লিখাতেন। ডিক্টেশন প্রদানকালে তিনি শব্দের বানান সঠিক হচ্ছে কিনা তা’ চেক করে দেখতেন। চিঠি লিখা শেষ হলে পড়ে শোনাতে বলতেন। পড়তে গিয়ে উচ্চারণ ভুল হলে তা’ শোধয়ে দিতেন। এ প্রসঙ্গে ৪র্থ শ্রেণীতে পড়াকালীন একটি ঘটনার কথা না বলে পারছি না। ডিসেম্বরের শেষে একদিন দুপুরে ক্লাসে প্রথম হবার ফলাফল নিয়ে চরম আনন্দে বাড়ি ফিরছিলাম। পথিমধ্যে হাতে পেলাম আমাদের হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে একটি লিফলেট। এটির শিরোনাম ছিল 'পাগলা সাঁকো নাড়িস্ না'। আমি সযতনে এ লিফলেটটি নিয়ে দুপুরে আহাররত আমার পিতার হাতে দিয়ে বললাম, “আব্বা দেখেন দেখেন, কী লিখেছে: ‘পাগলা সাঁকো নাড়ি সনা’। আব্বা আমার এ কথা শুনে তো হেসে কুটিকুটি। আমি কিছুটা বিস্মিত হলাম। আব্বা আমার এ বিস্ময়ের ঘোর কাটাতে গিয়ে বল্লেন, “বাবা, তোমার উচ্চারণ তো ঠিক হলো না। তুমি হসন্ত (্) দেখনি? তুমি তো নাড়ি সনা বলেছ, আসলে হবে নাড়িস্ না। এমন সময় আব্বা বললেন, আচ্ছা বলতো পাগলা যদি সাঁকো নাড়েই, আর তুমি যদি খরস্রোত বহমান পানিতে পড়ে যাও এবং সাঁতার না জানার কারণে সবার অগোচরে পানিতে ডুবে মারা যাও ও নিরুদ্দেশ হও, তাহলে তোমার কী হবে? আমি জবাব দিতে দেরি হচ্ছে দেখে আম্মা বলে দিলেন, সলিল সমাধি হবে। আব্বা সাথে সাথে বলে দিলেন, খেয়াল রেখো সলিল সমাধি শব্দের প্রয়োগ নৌকা, জাহাজ বা লঞ্চ ডুবিতে মারা যাওয়ার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। সত্যিই আব্বার এ শিক্ষা আজো ভুলতে পারি না।
যে কোনো পরীক্ষার শেষে ২দিন পড়ালেখা না করলে আমার পিতা তা অপরাধ হিসেবে ধরতেন না। এমন দুদিনে আব্বার সাথে বন্ধুসুলভ আচরণ করতাম। ভাই-বোনেরা বাসা-বাড়ির আঙ্গিনায় পাটি বিছিয়ে আব্বাকে শুইতে দিয়ে গল্প শোনাতে বলতাম। আব্বা এ অনুরোধ রক্ষা করতেন। আব্বার মুখে আপন-দুলালের কিংবা আলীবাবা চল্লিশ চোরের দীর্ঘ গল্প শুনতে শুনতে আমরা তন্ময় হয়ে যেতাম।
আমার পিতা এক সময় পুলিশে চাকুরি করেছিলেন বলেই কিনা জানি না চোর ধরার খায়েস ছিল তাঁর প্রচণ্ড। অনেক সময় ‘চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে’ এমন মহড়ায় অংশ নিতে তাঁকে দেখেছি। আমাদের মূল ঘরের পাশে পুরাণো হয়ে যাবার পরও ‘নয়া ঘর’ নামে একটি ঘরের অবস্থান ছিল। এ ঘরের সর্ব উত্তরের কক্ষে চৈত্র মাসের এক রাতে আমি আব্বার সাথে ঘুমাচ্ছিলাম। জানালা ছিলো খোলা। রাত আনুমানিক ২/৩ টা হবে। এক লোক জানালার পাশে এসে আব্বাকে বললো, “কাজী সাব, কাজী সাব, উঠেন তাড়াতাড়ি, গরুচোর ধরতে হবে।” আব্বা উঠলেন এবং বাড়ির লোকজনকে সাথে নিয়ে সদলবলে ঐ লোকের কথামত গরুচোর তাড়া করতে বেরুলেন। আব্বার সে কী উচ্ছ্বাস! আজ তিনি চোর ধরে শায়েস্তা করার সুযোগ পাবেন। কিন্তু না, সে সুযোগ তার হলো না। কারণ যাকে ঐ লোকটি গরুচোর ভেবেছিলো, সে গরু চোর ছিলো না, সে ছিলো একজন পরিশ্রমী কৃষক। চাঁদনী রাতে সে হালের গরু নিয়ে বাড়ি থেকে মাঠের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছিলো। আর ঐ সময় লোকটি তাকে গরুচোর আন্দাজ করে। আব্বা লাঠিসোটা নিয়ে সদলবলে যখন রেললাইনের উত্তর পাশে গেলেন, তখন দেখলেন লোকটি নিমগ্নচিত্তে জমিতে হাল চাষ করছে। আব্বা একেই আদর্শ কৃষক হিসেবে চিহ্নিত করে আমাদেরকে জমি চাষাবাদে অধিক মনোযোগী হওয়ার জন্যে বহুবার উপদেশ দিয়েছেন।
আমার পিতা বলতেন, তুমি যখন যেখানে যাবে সব মানুষের সাথে ভালোভাবে পরিচিত হবে। এতে অনাত্মীয় আত্মীয় হয়ে যাবে এবং তুমি বিপদ-আপদ থেকে বাঁচতেও পারবে। হ্যাঁ, আমার আব্বা এমনিভাবে বিরাট বিপদ থেকে একবার আল্লার অশেষ কৃপায় সপরিবারে বেঁচেও গেছেন। সম্ভবত একাত্তর সালের এপ্রিল মাস। যুদ্ধ শুরু হওয়ায় দু নৌকাযোগে সোনাইমুড়ী থেকে আমরা বাড়ি ফিরছিলাম। পথিমধ্যে ভুল তথ্যের ভিত্তিতে তাজুল ইসলাম নামে এক মুক্তিযোদ্ধা আমাদের দুটি নৌকা আটক করেন এবং যুদ্ধ শুরু হবার পরও আব্বা কেন চাকুরি করলেন সে অপরাধে দুটি নৌকা বোঝাই আমাদের পরিবারের সকল সদস্যকে চাটখিল বাজারে লাইনে দাঁড় করিয়ে এক গুলিতে হত্যা করবেন বলে জানান। এ অবস্থায় আব্বা সবাইকে শেষবারের মত খাবার খেয়ে নিতে বল্লেন এবং আল্লাহকে ডাকতে বল্লেন। আব্বা যোহর নামাজ পড়ে চাটখিল বাজারে গেলেন। উদ্দেশ্য : মানুষের সাথে পরিচিত হওয়া এবং আমাদের মৃত্যুর খবর বাড়িতে পৌঁছে দেবার জন্যে কাউকে অনুরোধ করা। বাজারের এক চা দোকানে বসলে আব্বাকে দেখার জন্যে জনতার উপচেপড়া ভিড় জমে। কৌতূহলী কারো প্রশ্নের জবাবে আব্বা একে একে নিজের বাড়ি ও শ্বশুর বাড়ির ঠিকানা বল্লেন। আমার নানার নাম বলতেই চা দোকানে বসা আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা (নাম মনে নেই) লাফ দিয়ে উঠলেন এবং নিজেকে আমার নানার দূর সম্পর্কের নাতিন জামাই পরিচয় দিয়ে আব্বাকে খালু বলে বুকে জড়িয়ে ধরে বল্লেন, আপনাকে কে গুলি করে, আমি দেখবো। এরপর তিনি আমাদের সবাইকে নৌকা থেকে উঠিয়ে নিয়ে গেলেন এবং তার বাড়িতে বাত্রি যাপনের ব্যবস্থা করলেন, সামর্থ্যমত আদর-আপ্যায়ন করলেন, সারারাত আমাদের পাহারা দিয়ে রেখে ভোরে নৌকায় তুলে দিলেন এবং নৌকাগুলোকে সাইকেল আরোহী দু ব্যক্তির প্রহরায় হাজীগঞ্জ অভিমুখী খাল পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গেলেন।
আমার পিতা তাঁর সহোদর ভাই-বোনদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ ছিলেন। এমনকি তাঁর জেঠাত মামাত-ফুফাত ভাই-বোনদের মধ্যেও সর্বকনিষ্ঠ ছিলেন। সহজ কথায় বলি, আমাদের কোনো চাচা ছিলো না, ছিলো অনেক জেঠা। আব্বা শিক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও তার ভাবীদেরকে ‘ভাবী’ না বলে ‘ভাজ’ বলে সম্বোধন করতেন। এ নিয়ে আমরা প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে কতো হাসাহাসি করেছি। কিন্তু এক্ষেত্রে আব্বা তাঁর উচ্চারণগত পরিবর্তন আনেননি। আব্বা তাঁর ভাজদের মধ্যে বড় ভাজ আমাদের বড়ো জেঠী আম্মা আম্বিয়া খাতুনকে খুব শ্রদ্ধা করতেন। শুনেছি, আব্বা খুব শৈশবে তাঁর মাকে হারান। আব্বার মাতৃশোক ভোলাতে মাতৃসম স্নেহ- যত্ন বিলিয়ে দিতে আমার এ জেঠী আম্মা ছিলেন নাকি অকৃপণ। সেজন্যে আব্বা আমার এ জেঠী আম্মাকে খুব শ্রদ্ধা করতেন এবং তাঁর অধিকাংশ কর্মস্থলে বেড়াতে নিয়ে যেতেন। তাঁর সেবা-যত্ন করতেন। অবসরকালীন জীবনে আব্বা তাঁর সুখ-দুঃখের সমভাগী করেছেন এ জেঠী আম্মাকে। আব্বা তাঁর ভাতিজাদের খুব ভালোবাসতেন। তাঁর খুব আদুরে এক ভাতিজা হচ্ছেন আমাদের জেঠাত ভাই কাজী মালুম ইসলাম, যিনি আব্বার প্রিয় কর্মস্থল লালমাইয়ে দীর্ঘদিন যাবত চাকুরি করেছেন।
আব্বার খুব আদুরে সন্তানদের মধ্যে আমিও ছিলাম একজন। এর কারণ আমি তাঁর অভিপ্রায় অনুযায়ী ক্লাসে প্রথম হওয়া এবং প্রাথমিক ও জুনিয়র বৃত্তি লাভে সক্ষম হয়েছিলাম। এজন্যে আমাকে নিয়ে তাঁর গর্ব-অহংকারের কমতি ছিল না এবং এটার মাত্রা এতো বেশি ছিলো যে, তিনি কখনো কখনো আমাকে তাঁর আলাপ-আলোচনা, গল্প-গুজবের মুখ্য চরিত্রে নিয়ে আসতেন। আব্বার চাকুরি থেকে অবসর গ্রহণের পর তাঁর প্রাত্যহিক জীবনের বিরাট অংশ জুড়ে থাকতাম আমি ও আমার চতুর্থ ভাই (নজু ভাই)। বাড়ির সামনের ৩/৪ টি মরিচ ক্ষেতে নিড়ি দেয়া, লাউ, শিম, টমেটো, কালো বেগুন ইত্যাদি শাক-সবজি ক্ষেতের যাবতীয় তদারকিতে আব্বার সাথে শরীক হয়ে আমরা তাঁর বন্ধুর মতো হয়ে গিয়েছিলাম। আব্বা, নজু ভাই ও আমি এ তিনজন একত্রে বসে মরিচ ক্ষেত নিড়ানিতে বসতাম। আব্বার মুখ কি বন্ধ থাকতো? তিনি নিড়ানির কাজ করতে করতে দেশের রাজনাতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, পারিবারিক সমস্যা, তাঁর বর্তমান ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সহ বহু বিষয়ে আলোচনা করতেন। এমনকি নিড়ানির সময় তিনি ইংরেজি ট্রান্সলেশন পর্যন্ত শিখাতেন। বিকেলে আমাকে নিয়ে হাঁটতে বেরুলে তিনি তাঁর অনেক অভিমত ও অভিপ্রায় আমাকে শোনাতেন।
আমার পিতা আমাকে ডাক্তার হতে বলেছিলেন। তিনি বলতেন, ডাক্তারি এমন এক পেশা যার দ্বারা পয়সাও কামানো যায় এবং মানুষের বিরাট সেবা করা যায়। প্রাথমিক বৃত্তি লাভের কারণে তিনি আমাকে বেশিদিন বলাখাল হাইস্কুলে পড়াননি। ৭ম শ্রেণীতে উঠলেই তিনি আমাকে বড়ো দুলাভাইয়ের সহযোগিতায় চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। আমি থাকতাম বড়ো আপার বাসায়। এ স্কুল থেকেই আমি জুনিয়র বৃত্তি লাভ করি। জুনিয়র বৃত্তি প্রাপ্তির পর আব্বা তাঁর কল্পনার জগতে আমাকে এপ্রোন পরা অবস্থায় রোগীর চিকিৎসারত একজন ডাক্তারের অবয়বে ভাবতেও বোধহয় দ্বিধাবোধ করেননি। আমি ডাক্তার হবো এমন নিশ্চয়তা ব্যক্ত করে বাড়ির আশেপাশের লোকজনের সাথে আব্বা এতো গল্প-গুজব করতেন যে, এক পর্যায়ে পাশের বাড়ির, আমাদের ঘরের ও বাড়ির কেউ কেউ আমাকে ‘ডাক্তার’ বলেই ডাকা শুরু করলো। আমাদের পুবের বাড়ির আরশাদ তো আমাকে অন্তত দশবছর যাবত ‘ডাক্তার’ বলেই সম্বোধন করেছে। একদিন তাকে ভালো করে বুঝিয়ে বলার পরে যে এখন আর আমাকে ডাক্তার ডাকে না।
হ্যাঁ, আমার পিতার অতিমাত্রিক অভিপ্রায় অনুযায়ী আমি ডাক্তার হবার মত ফলাফল এস.এস.সি.তে করতে পারিনি। আমি ভোগছিলাম চরম অপরাধবোধে আর আব্বা ভুগছিলেন চরম মানসিক যন্ত্রণায়। এজন্যে এসএসসি’র ফলাফল প্রকাশের পর আব্বার সাথে দেখা করতে চট্টগ্রাম থেকে আর বাড়ি আসিনি। চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হয়ে চালিয়ে যাচ্ছিলাম লেখাপড়া। অতএব আব্বার সাথে এসএসসি পরীক্ষার পূর্বে কবে আমার শেষ দেখা হয়েছিল এবং শেষ কী কথা হয়েছিলো মনে নেই। এটুকু মনে আছে, চট্টগ্রাম থেকে একবার বাড়ি গেলে আব্বাকে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ে মোনাজাতে বলতে শুনেছি, হে আল্লাহ্। তুমি ঈমানের সাথে আমার মউত কবুল করিও। কাউকে কষ্ট দিয়ে আমাকে যেন মরতে না হয়। বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে আসার পর সারাপথ আব্বার এ মোনাজাতের কথা আমার কানে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়েছে।
আল্লাহ্ আমার পিতার এ মোনাজাত কবুল করেছেন। তিনি কাউকে কষ্ট দিয়ে মৃত্যুবরণ করেননি। ১৯৮০ সালের ২০ জুলাই (৮ রমজান) তিনি আকস্মিকভাবে আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মৃত্যু মহিমায়ই আমাদের কাছে মহীয়ান হয়ে আছেন। আল্লাহ পরকালে তাঁর বেহেশত নসিব করুন। আমিন।
আমার বড়ো আপার বাসায় ফেনীর অধিবাসী একজন গৃহশিক্ষক ছিলেন। তিনি একদিন আমাদেরকে এক অদ্ভুত প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ করালেন। বললেন, ১ মিনিটের মধ্যে কে কতো তাড়াতাড়ি চোখে পানি আনতে পারবে। আমরা কেউ এ প্রতিযোগিতায় উত্তীর্ণ হতে পারিনি। দেখলাম, স্যারের চোখে পানি। ব্যাপারটা আশ্চর্যজনক মনে হলো। বললাম, স্যার আপনি এটা কীভাবে পারলেন? স্যার জানালেন, তাঁর মায়ের মৃত্যুর কথা মনে করলেই যে কোনো সময় তাঁর চোখে পানি এসে যায়। সেজন্যে তিনি এটা পেরেছেন। সেদিন স্যারের এ কথাটার ততোটা গুরুত্ব দেইনি। মনে মনে বলেছি--এটা কি সম্ভব? অথচ আজ বুঝি এটা কতোটা সম্ভব। কেননা আমার পিতার মৃত্যুর কথা চিন্তা করলে এক মিনিট পুরো লাগে না, কয়েক সেকেন্ডেই চোখে পানি এসে যায়। বার বার মনে হয়, আমরা এমন এক আদর্শ পিতাকে হারালাম, যার নমুনা পৃথিবীতে সত্যিই বিরল।
লেখক : মরহুম কাজী ছেফায়েত উল্লাহর নবম সন্তান ও পঞ্চম পুত্র; প্রধান সম্পাদক, দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ; দুবারের সাবেক সভাপতি, চাঁদপুর প্রেসক্লাব; সাবেক মহাপরিচালক (২০১৩-২০২২), সাহিত্য একাডেমী, চাঁদপুর; সাবেক সভাপতি, চাঁদপুর রোটারী ক্লাব।