প্রকাশ : ১৩ জুন ২০২৫, ০৮:০৬
বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে টুইন পিট ল্যাট্রিন নির্মাণে পুকুর চুরি

জাতিসংঘ কর্তৃক টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যগুলোর মধ্যে ৬ নাম্বার লক্ষ্য বিশুদ্ধ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন। এটি বিশ্লেষণ করে জাতিসংঘ বাংলাদেশের জন্যে এর ব্যাখ্যায় ৬.২ ক্যাটাগরিতে নারী ও মেয়েসহ অরক্ষিত পরিস্থিতিতে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর চাহিদার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রেখে ২০৩০ সালের মধ্যে সকলের জন্যে পর্যাপ্ত ও সমতাভিত্তিক পয়ঃনিষ্কাশন ও স্বাস্থ্যবিধিসম্মত জীবন রীতিতে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা এবং খোলা জায়গায় মলত্যাগের অবসান ঘটানোর বিষয়ে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।
|আরো খবর
জানা গেছে, ২০২০ সালের ২২ ডিসেম্বর তৎকালীন জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)-এর সভায় ‘মানবসম্পদ উন্নয়নে গ্রামীণ পানি সরবরাহ, স্যানিটেশন এবং স্বাস্থ্যবিধি’ শীর্ষক প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়। সেই লক্ষ্যে ‘মানবসম্পদ উন্নয়নে গ্রামীণ পানি সরবরাহ, স্যানিটেশন এবং স্বাস্থ্যবিধি’ শীর্ষক এ প্রকল্পের আওতায় দেশের ৩০ জেলার ৯৮টি উপজেলায় দরিদ্র জনগণের জন্যে নিরাপদ পানি সরবরাহ ব্যবস্থা ও স্বাস্থ্যসম্মত ল্যাট্রিন স্থাপন কার্যক্রম চলছে। বিশ্বব্যাংক ও এশীয় অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যাংক (এআইআইবি) থেকে ৯৭ শতাংশ ঋণ নিয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। বাকি ২ শতাংশ টাকা নিজস্ব তহবিল থেকে জোগান দিচ্ছে সরকার। স্থানীয় সরকার বিভাগের জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। কাজ শেষ হবে ২০২৫ সালে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এই প্রকল্পের আওতায় নির্বাচিত এলাকায় অতিদরিদ্রদের জন্যে ৩ লাখ ৫১ হাজার ২৭০টি টয়লেট নির্মাণ কাজ চলছে।
এদিকে এই প্রকল্পের অধীনে চলমান ফরিদগঞ্জে টুইন পিট ল্যাট্রিন নির্মাণে অনিয়ম ও অর্থ নয়ছয়ের তথা পুকুর চুরির অভিযোগ উঠেছে। প্রতিটি ল্যাট্রিন নির্মাণের জন্যে বরাদ্দকৃত অর্থের এক তৃতীয়াংশ অর্থে এসব নির্মাণ কাজ চলছে। ফলে প্রশ্ন রয়েছে এসবের মান নিয়েও। অভিযোগ রয়েছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের কর্মকর্তারাও এর সাথে জড়িত।
সূত্র জানায়, প্রকল্পের আওতায় হতদরিদ্র পরিবারের জন্যে বিনামূল্যে টুইন পিট ল্যাট্রিন নির্মাণের লক্ষ্যে ফরিদগঞ্জ উপজেলার পৌরসভা বাদে উপজেলার ১৫টি ইউনিয়নে ইউপি চেয়ারম্যানদের সহায়তায় প্রতিটি ইউনিয়নে ২২৯টি পরিবারের তালিকা তৈরি করা হয়। প্রথমে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যদের কাছ থেকে একটি তালিকা সংগ্রহ করে প্রকল্পের সহযোগী এনজিও JV-3 DORP & Water Aid- এর স্থানীয় প্রতিনিধিরা। এই তালিকা যাচাই -বাছাই করে তারা তালিকা চূড়ান্ত করে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী অফিস জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অফিসকে প্রদান করেন। যার একটি কপি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানকেও দেয়া হয়েছে। সেই হিসেবে ফরিদগঞ্জ উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নে কম-বেশি প্রায় ৩ হাজার ৪৩৫টি টয়লেট নির্মাণ
কাজ শুরু হয়েছে ।
জানা গেছে, প্রতিটি টুইন পিট ল্যাট্রিন নির্মাণে ৩৫ হাজার টাকা বরাদ্দ রয়েছে। ফলে শুধু ফরিদগঞ্জ উপজেলাতেই ব্যয় হবে ১২ কোটি ২২লাখ ৫ হাজার টাকা।
সূত্র জানায়, প্রতিটি টুইন পিট ল্যাট্রিন নির্মাণে ৩৫ হাজার টাকা বরাদ্দ রয়েছে। সেই হিসেবে ফরিদগঞ্জ উপজেলাতেই ব্যয় হবে ১২ কোটি ২২লাখ ৫ হাজার টাকা।
কিন্তু বাস্তব অবস্থা ভিন্ন। কাজ চলছে নামকাওয়াস্তে। বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে কাজ এতো নিম্নমানের হওয়ায় বিস্ময় প্রকাশ করছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। প্রতিটি ল্যাট্রিন নির্মাণে কিছু ইট, ১০টি রিং, দুটি স্লাব এবং ৪ ইঞ্চি ব্যাসার্ধের সিমেন্টের তৈরি পিলার এবং টিন প্রয়োজন। কিন্তু নির্মাণকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এই উপকরণ নির্মাণে দুর্নীতির আশ্রয় নিচ্ছেন। কাজগুলো নিম্নমানের হচ্ছে। ইটের গুঁড়া ৮০%, আর ১৮% কক্রিট, বাকি ২% বালি ও সিমেন্ট। তারা ১০টি রিং তৈরি করছে দেড়/দুই বস্তা সিমেন্ট দিয়ে। এমনটাই জানিয়েছেন কর্মরত লেবাররা।
অভিযোগ রয়েছে, প্রতিটি টয়লেট নির্মাণে প্রকল্প কর্তৃক ব্যয় ৩৫ হাজার টাকা ধরা হলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হচ্ছে বা পাচ্ছে সর্বোচ্চ ২২/২৩ হাজার টাকা। আর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এগুলো নির্মাণে সর্বোচ্চ ১০/১২ হাজার টাকা ব্যয় করছেন। বাকি টাকা হাওয়ায় উড়ছে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, নিম্নমানের ইটের সুড়কি দিয়ে তৈরি করা হয়েছে রিং ও স্ল্যাব। যার ফলে এগুলোর মান নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
একটি টয়লেট পাওয়া রূপসা উত্তর ইউনিয়নের বাসিন্দা মেহেরাজ হোসেন বলেন,এই টয়লেট এক বছরও টিকবে না। এটা থেকে ভেঙ্গে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
রূপসা বেপারী বাড়ির বোরহান উদ্দিন জানান, তার বাড়িতে তিনটি টয়লেট নির্মাণ হবে। কিছুদিন আগে এসে ঠিকাদারের লোকজন কিছু রিং তৈরি করে যায়। কিন্তু বৃষ্টিতে সেগুলো ভেঙ্গে নষ্ট হয়েছে।
ধানুয়া গ্রামের সিএনজি চালক হানিফ জানান, একমাস পূর্বে শুধু ফ্লোর পাকা করে চলে গেছে। আর খবর নেই। আমরা খুব কষ্টে আছি।
ফরিদগঞ্জ দক্ষিণ ইউনিয়নের খোকন জানান, তার কাছ থেকে এক জনপ্রতিনিধি তালিকায় নাম উঠাতে ২ হাজার টাকা নিয়েছেন। তার ও আশপাশের বাড়ির জন্যে ঠিকাদার কর্তৃক নিয়ে আসা রিং ক'টি ভেঙ্গে গেছে।
অভিযোগ রয়েছে, প্রকল্পের এই কাজের পেছনে জেলা জনস্বাস্থ্য নির্বাহী প্রকৌশলী থেকে শুরু করে উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী সকলেই জড়িত। তথ্য জানতে চাইলে তারা লুকোচুরি করছে। নির্মাণ কাজের বিষয়ে তথ্য জানতে চাইলেও কেউই তথ্য দিতে অনাগ্রহী। অন্যদিকে নাম তালিকাভুক্ত করতে জনপ্রতিনিধিরাও নিয়েছেন অর্থ--এমন তথ্য জানিয়েছেন ল্যাট্রিন পাওয়া লোকজন।
প্রকল্পের সহযোগী এনজিওর ফরিদগঞ্জ উপজেলার একজন ফ্যাসিলিটেটর জানিয়েছেন, গোবিন্দপুর দক্ষিণ ইউনিয়নে তারা টয়লেট নির্মাণ কাজ তদারকি করতে গিয়ে দেখেছেন নিম্নমানের ইট, বালু দিয়ে রিং স্লাব তৈরি হচ্ছে। এই বিষয়ে তারা তাৎক্ষণিক প্রকল্প অফিসকে অবহিত করেছেন। বাধা দিয়েও লাভ হচ্ছে না। জনস্বাস্থ্য বিভাগের উপজেলা ও জেলা নির্বাহী প্রকৌশলী এসব দেখেও না দেখার অবস্থায় রয়েছেন।
রূপসা উত্তর ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জহিরুল ইসলাম বলেন, টয়লেট নির্মাণে নিম্নমানের কাজ হচ্ছে। আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে রিংগুলো গাড়িতে উঠানোর সময়েই ভেঙ্গে যায়। এতোবড় প্রকল্প, অথচ কাজ নিম্নমানের। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের লোকজনের যোগসাজশে এসব কাজ হচ্ছে বলে তিনি মনে করেন।
গোবিন্দপুর উত্তর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান শাহ আলম শেখ বলেন, কাজের গুণগতমান ঠিক হচ্ছে না। ধানুয়া স্কুলের পাশের একটি বাড়িতে টয়লেট নির্মাণের জন্যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ওই হতদরিদ্রকে কিছু ইট, বালি এবং নগদ অর্থ রাখতে বলেছেন। এগুলো দেখার কেউ নেই।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক জনপ্রতিনিধি জানান, বিশ্বব্যাংকের প্রায় সাড়ে ১২কোটি টাকার কাজ হচ্ছে। স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে এগুলো কিছুই জানি না আমরা। তবে কাজের গুণগতমান দেখে বোঝা যাচ্ছে, বড়ো অংকের টাকা লুটের আয়োজন চলছে।
এনজিওর স্থানীয় প্রতিনিধি নুরুন্নাহার চৌধুরী বলেন, আমাদের কাজ হচ্ছে, যে পরিবারের স্যানিটেশন সমস্যা তা নিশ্চিত করে তালিকা করা। নির্মাণের বিষয়টি তদারকি করছেন জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর।
স্থানীয় ঠিকাদার জানান, প্রতিটি টয়লেট নির্মাণে তারা সর্বোচ্চ ২৩ হাজার ৫শ' টাকা পাচ্ছেন ।
ভ্যাট, ট্যাক্স এবং অফিস খরচ এর মধ্যে।
ফরিদগঞ্জ উপজেলা জনস্বাস্থ্য উপ-সহকারী প্রকৌশলী ফরিদ হোসেন বলেন, কাজের গুণগতমান স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় চলমান রয়েছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি কথা এড়িয়ে যান।
বিশ্ব ব্যাংকের চাঁদপুর জেলা কো-অর্ডিনেটর আবু হুয়ারা প্রথমে এই প্রকল্প বিষয়ে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। পরে তিনি মুঠোফোনে বলেন, এ রকম একটি প্রকল্প চলমান রয়েছে, অথচ ওই প্রকল্প সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের চাঁদপুর জেলা নির্বাহী প্রকৌশলী আবু মুসা মুহাম্মদ ফয়সালের সাথে একাধিকবার মোবাইল ফোনে চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। পর পর তিন দিন তার অফিসে গিয়ে সাক্ষাতের জন্যে দীর্ঘসময় অপেক্ষা করেও তার দেখা মিলে নি। এমনকি খুদে বার্তারও তিনি জবাব দেননি।
জনস্বাস্থ্য চাঁদপুর অফিসের প্রধান তথ্য প্রদানকারী কর্মকর্তা ও সহকারী প্রকৌশলী মোহাম্মদ জাহিদ হাসানের কাছ থেকে এই সংক্রান্ত তথ্য জানতে চাইলে তিনি জানান, সকল কিছুই জানেন নির্বাহী প্রকৌশলী।