বৃহস্পতিবার, ২৮ আগস্ট, ২০২৫  |   ২৮ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জের শীর্ষ মাদক কারবারি কামরুল আটক
  •   ফরিদগঞ্জের শীর্ষ মাদক কারবারি কামরুল আটক
  •   ফরিদগঞ্জের শীর্ষ মাদক কারবারি কামরুল আটক

প্রকাশ : ২৮ আগস্ট ২০২৫, ১৫:৪৭

মাদকের ছোবলে পরিবারে চলছে অশান্তি : আইনশৃংখলা কমিটির সভায় ক্ষোভ, মাদক ব্যবসায়ীদের গ্রেপ্তারের দাবি

তাবারক হোসেন আজাদ, লক্ষ্মীপুর থেকে।।
মাদকের ছোবলে পরিবারে চলছে অশান্তি : আইনশৃংখলা কমিটির সভায় ক্ষোভ, মাদক ব্যবসায়ীদের গ্রেপ্তারের দাবি
বুধবার রায়পুর উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় মাদক ব্যবসায়ীদের গ্রেপ্তারে দাবি।

গত এক বছরে লক্ষ্মীপুরের রায়পুরসহ পাঁচ উপজেলায় মাদক সেবন ও বিক্রি তিনগুণ বেড়েছে। বিকেল হতেই প্রতিটি ঘরে ঘরে মাদক সেবন চলছে। ছেলের হাতে বাবা, স্বামীর হাতে স্ত্রী ও বন্ধুর হাতে বন্ধু খুন সহ নানা ধরনের অপরাধ ঘটে চলেছে প্রতিনিয়ত। এছাড়াও প্রতিদিনই শহরে-গ্রামে ডাকাতি, চুরি-ছিনতাই, কিশোর গ্যাংসহ সামাজিক অপরাধ ও বিশৃঙ্খলা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব অপরাধের নেপথ্য খুঁজতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে অধিকাংশ ঘটনার পেছনেই রয়েছে মাদকের ছোবল। মাদক সেবনের জন্যে টাকা না পেয়ে বৃদ্ধ মা-বাবাসহ পরিবারের সদস্যদের মারধর ও বাসা বাড়িতে ভাংচুরের ঘটনাও ঘটছে। এ নিয়ে অভিভাবক ও সচেতন মহলে চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ছে।

বুধবার (২৭ আগস্ট ২০২৫) রায়পুর উপজেলায় আইনশৃঙ্খলা কমিটির মাসিক সভায় রাজনৈতিক, সমাজ সেবক ও সাংবাদিকসহ একাধিক বক্তা মাদকের কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে উপস্থাপন করেছেন। রাজনৈতিক মদদ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ‘ম্যানেজের’ কারণে আশানুরূপ সুফল হয় না বলে অভিযোগ উঠেছে।

সমাজ বিশ্লেষকরা বলছেন, মাদকরোধে আইনের শাসন আর রাজনীতিবিদদের অঙ্গীকার প্রয়োজন। এ ব্যবসার সঙ্গে জনপ্রতিনিধিরাও জড়িত। মাদক ব্যবসায়ীরা রাতারাতি কোটিপতি হয়। এ লোভ অন্যদেরও টানে। এ সংকট রুখতে পারিবারিক-সামাজিক আন্দোলনের পাশাপাশি নৈতিকতা-মূলোবোধ জাগ্রত করার তাগিদ দিতে হবে।

‘গ্রামেও এখন রাজনৈতিক মদদে ইয়াবা, ফেনসিডিল, গাঁজা বিক্রি হচ্ছে। মোবাইল ফোনে বিক্রেতার সঙ্গে চুক্তি করে চলার পথে মাদক হাতবদল হয়। বিকাশেও টাকা লেনদেন হয়।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রায়পুরসহ পাঁচ উপজেলার গ্রামগুলোতে ফেরি করে বিক্রি হচ্ছে ইয়াবা ও গাঁজা। এসব সেবনে নেশায় ডুবছে তরুণ-যুবকরা। এর প্রভাবে মাদকাসক্তদের ঘরে ঘরে দেখা দিয়েছে অশান্তি।

জানা যায়, গত বছরের আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত রায়পুরসহ জেলায় মাদকাসক্তদের হাতে ৭টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে আলোচিত সদরের বশিকপুরে বসতঘরের দরজা তালা দিয়ে পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে দুই সন্তানসহ স্ত্রীকে হত্যা, রামগতির চরকলাকোপা গ্রামে কুপিয়ে স্ত্রী-শ্বশুরকে হত্যা উল্লেখযোগ্য । সদরের গঙ্গাপুর গ্রামে ছেলের হাতে মা, উত্তর টুমচর গ্রামে ভাইয়ের হাতে ভাই খুন এবং গত ১ জুন মাদক ব্যবসার দ্বন্দ্বে সদরের উত্তর জয়পুরে আজাদ হোসেন বাবলু নামে একজনকে কুপিয়ে হত্যা করে প্রতিপক্ষ। গত ১১ জুন রায়পুর উপজেলার উত্তর চরবংশী গ্রামে মাদক ব্যবসার প্রতিবাদ করায় বৃদ্ধ আলী দেওয়ানকে কুপিয়ে হত্যা করে মামুন নামে মাদকাসক্ত ছেলে। ১১ এপ্রিল সদরের পূর্ব চৌপল্লী গ্রামে মাদকের দ্বন্দ্বে রুবেল হোসেন নামে একজনকে গুলি করা হয়। ৯ এপ্রিল উত্তর তেমুহনীর নিউ মার্কেটের ছাদে কলেজ ছাত্র সিরাজ ৩ বন্ধুকে গাঁজা সেবনকালে ছাদ থেকে ফেলে ঢাকায় নেওয়ার পথে তিনি মারা যান। ১৫ মার্চ রাতে পৌরসভার কালু হাজী সড়কের ভাড়া বাসায় ঘুমন্ত স্ত্রী রিনা বেগমের দুই পায়ের রগ কেটে মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে জখম ও পাথর দিয়ে হাত-পা থেতলে নির্যাতনের অভিযোগ উঠে মদ্যপ স্বামী আলমগীরের বিরুদ্ধে।

গত ৮ সেপ্টেম্বর সদরের লতিফপুর গ্রামে প্রতিবাদ করায় অষ্টম শ্রেণির ছাত্রসহ ১০ তরুণ-যুবকের বিরুদ্ধে মামলা করে মাদক কারবারি আবুল কালাম জহির। তিনি ৬ মাদক মামলার আসামি ও পুলিশের তালিকাভুক্ত ব্যবসায়ী।

‘মাদক নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে কঠোর অবস্থান প্রয়োজন। মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে পুলিশ যথাযথ তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করলেও মানুষ আদালতে সাক্ষ্য দেয় না। মাদকের সঙ্গে পুলিশের কোনো দুর্বলতা-আপস নেই। এর উদ্ধার ও বিক্রেতাদের গ্রেফতারে নিয়মিত অভিযান চলছে।’

র‌্যাব-১১ জানিয়েছে, ২০২৩ সালের ৩ জানুয়ারি লক্ষ্মীপুরে সবচেয়ে বড়ো ইয়াবার চালানসহ সদরের চর রমনী ইউপি সদস্য (মেম্বার) মনির হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়। তার কাছে ৮৫ হাজার ইয়াবা পাওয়া যায়। এরপর মনির ও তার সহযোগীদের তথ্য মতে, কয়েক ধাপে লক্ষাধিক ইয়াবা উদ্ধার করা হয়।

পুলিশ জানিয়েছে, ৯ মার্চ রায়পুরে ইয়াবা-গাঁজাসহ মাদক ব্যবসায়ী দেলোয়ার হোসেন মাইকেল ও পরান হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়। ওই দুই যুবকের বিরুদ্ধে থানায় ২১টি মামলা রয়েছে। তারা গ্রেফতার হলে আইনের ফাঁক দিয়ে অল্প সময়ের মধ্যে জামিনে বের হয়ে ফের এ ব্যবসা শুরু করেন। অন্য মাদক কারবারিদেরও একই অবস্থা। ২০১৬ সালে জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কার্যালয়ের কার্যক্রম শুরু হয়। এর আগে নোয়াখালী থেকে এ জেলা নিয়ন্ত্রণ করা হতো।

জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কার্যালয় সূত্র জানায়, সদর, রায়পুর, রামগঞ্জ, কমলনগর ও রামগতিতে গত এক বছরে তাদের ১ হাজার ২৮৭টি অভিযান হয়। এ সময়ে ২ হাজার ৯২৯ পিস ইয়াবা, ৪৭ কেজি গাঁজা, দেশীয় মদ উদ্ধার করা হয়। এসব ঘটনায় ১৬৬টি মামলায় ১৬৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়। সদর ও রায়পুরসহ ৫ উপজেলায় মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত আছে ৪২ জন। গডফাদার ৮, পাইকারি বিক্রেতা ১৩ ও খুচরা বিক্রেতা ১৯ জন।

জেলা পুলিশ বিভাগ জানান, গত এক বছরে অভিযানে ১৮ হাজার ১৭৬ পিস ইয়াবা, ৪ মণ গাঁজাসহ বেশ কিছু বিদেশি ও চোলাই মদ উদ্ধার করা হয়। এসব ঘটনায় ২৬০টি মামলায় ৩৪০ জনকে গ্রেফতার করা হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে রায়পুর ও সদর উপজেলার চারজন ইউপি চেয়ারম্যান ও ৫ জন মেম্বার জানান, গ্রামেও এখন রাজনৈতিক মদদে ইয়াবা, ফেনসিডিল, গাঁজা বিক্রি হচ্ছে। মোবাইল ফোনে বিক্রেতার সঙ্গে চুক্তি করে চলার পথে মাদক হাতবদল হয়। বিকাশেও টাকা লেনদেন হয়।

রায়পুর উপজেলা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক তাবারক হোসেন আজাদ বলেন, সকলের সম্মিলিত সমন্বয় প্রয়োজন। মাদক কারবারিরা রাতারাতি কোটিপতি হয়। প্রতিটি গ্রামে মাদক কেনাবেচা চলছে। এ লোভ অন্যদেরও টানে। মামলার দুর্বলতার কারণেই আসামিরা জামিনে বেরিয়ে ফের মাদক ব্যবসা শুরু করে। আমরা বলে-লেখেও লাভ নেই।

জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কার্যালয়ের পরিদর্শক আবদুর রহিম বলেন, লক্ষ্মীপুরের ৫টি উপজেলায় মাদকের ব্যবহার ও বিক্রি আগের চেয়ে তুলনামূলক কিছুটা বেড়েছে। রাজনৈতিক মদদে অনেকে এ ব্যবসা করছেন। তবে আমাদের নিয়মিত অভিযান চলছে। পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রতি মাসেই আমরা স্কুল-কলেজে আলোচনা সভা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা করছি।

লক্ষ্মীপুর জজ আদালতের অ্যাডভোকেট (এপিপি) আবদুল আহাদ শাকিল বলেন, পুলিশ জোরালো অভিযান না করায় মাদক ব্যবসা বেড়েছে। এজন্যে সেনাবাহিনীসহ যৌথ অভিযান প্রয়োজন। এ ব্যবসার সঙ্গে যারাই জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে ব্যবস্থা নেয়া হোক।

লক্ষ্মীপুর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড আপস) মো. হাসান মোস্তফা স্বপন বলেন, মাদক নিয়ন্ত্রণে জেলার সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে কঠোর অবস্থান প্রয়োজন। মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে পুলিশ যথাযথ তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করলেও মানুষ আদালতে সাক্ষ্য দেয় না। মাদকের সঙ্গে পুলিশের কোনো দুর্বলতা-আপস নেই। এই মাদক উদ্ধার ও বিক্রেতাদের গ্রেফতারে নিয়মিত প্রতিদিন অভিযান চলছে।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়