শনিবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০২৫
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ২০ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:৫৯

ধারাবাহিক উপন্যাস-২০

নিকুঞ্জ নিকেতন

রাজীব কুমার দাস
নিকুঞ্জ নিকেতন

ধারাবাহিক উপন্যাস-২০

নিকুঞ্জ নিকেতন

রাজীব কুমার দাস

(পূর্ব প্রকাশের পর)

১৩.

খুব ভোরে ঘুম ভেঙে যায়। বারান্দায় চলে আসি চেয়ারে বসে সমুদ্রটার দিকে তাকিয়ে আছি। মুসল্লিরা পাশের মসজিদ থেকে ফজরের নামাজ আদায় করে বের হচ্ছে। সারোয়ার নেই রুমে হয়তো সেও নামাজের জন্য মসজিদে গিয়েছে। ভোরের আলো এখনো ভালোভাবে ফুটে ওঠেনি তাই কনকনে শীতের একটা অনুভূতি রয়ে গেছে। ওরা ঘুম থেকে জাগলে না হয় দল বেঁধে বাইরে গিয়ে ঘুরে আসতে পারতাম। যাক সকলে এত লম্বা জার্নি করে এসেছে ঘুমোক আরও কিছুক্ষণ। আমরা তো আছি বেশ কিছু দিন তখন না হয় মনভরে সমুদ্র দর্শন করব।

‘কী হে পিটার এত ভোরে উঠে গেলে যে!’

‘ঘুম ভেঙে গেল দাদা তাই এসে বারান্দায় বসেছিলাম।’

‘সকলকে উঠাও আর বলবে আমরা জগিংয়ে বীচে যাব। দশ-পনেরো মিনিটের মধ্যে ঝটপট তৈরি হতে বলবে। সারোয়ার ফিরেছে নাকি?’

‘না এখনো আসেনি।’

অনিমেষ উঠে বিছানা ছাড়ল আর সারোয়ার নামাজ শেষে ঘুরে এসে সবেমাত্র দরজা দিয়ে ঢুকছে। আমি দাদার প্ল্যানিং বলার সাথে সাথে সকলে তড়িঘড়ি করে তৈরি হয়েছে আর সারোয়ার নামাজের পায়জামা-পাঞ্জাবি খুলে ট্রাকস্যুট পড়ে তৈরি। পনেরো মিনিটের মধ্যে তৈরি হয়ে জগিং এর জন্য বেড়িয়ে পড়ি। পার্কের জগিং তো বহুবার হয়েছিল আজ একটু ভিন্নমাত্রায় এশিয়ার দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতে আমাদের জগিং। ভোরের নির্মল বাতাস আর সমুদ্রের গর্জন দিয়ে দিনের শুরুটা খারাপ হবে না। আমার ব্যকুলতা এখন প্রবল। রাস্তায় তেমন একটা মানুষ নেই। বীচের আশপাশের দোকানগুলোও ঘুমিয়ে আছে এখনো খোলেনি। আমাদের মতো বহু মানুষ এখানে হাঁটতে বের হয়েছে। সুগন্ধা বীচ থেকে কলাতলী বীচের দিকে আমরা এগোচ্ছি।

‘পিটার ভোরের সমুদ্র কেমন লাগছে তোমার?’

‘আমার জীবনের স্বপ্নটা পূরণ হয়েছে আপনাদের মাধ্যমে তাই সেটা কী মন্দ হবে কখনো!’

‘স্বপ্ন কীভাবে পূর্ণ হয়েছে সেটা গুরুত্বপূর্ণ না মুখ্য হলো তোমার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। আরে এটা কী করছ তুমি এত সকালে পা ভিজালে ঠান্ডা লাগতে পারে। এমনিতে শীতের বেলা, একবার ঠান্ডা লাগলে আমাদের পুরো ট্যুর ভেস্তে যাবে পিটার।’

‘দাদা আজ আমায় বারণ করবেন না। আমি খালি পায়ে সমুদ্রের ভেজা বালির আনন্দ নিতে চাই। ঠিক আছে আমি পা ভিজাচ্ছি না। আপনারা এগোন আমি হাঁটছি আপনাদের পাশেই।’

ওরা সকলে দল বেঁধে এগিয়ে যাচ্ছে শুধু আমি দলছুট। শীতের অনুভূতিতে ভেজা বালি বেশ লাগছে যদিও শীতে কষ্ট হচ্ছে। ভোরের বাতাসটা কাঁপুনি দিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর আবেগ সংবরণ করে এবার জুতা পড়ে নিলাম। এখন মেরীকে খুব বেশি মনে পড়ছে আর একটা অপরাধবোধও আছে। কিছু প্রশ্ন আমার আশপাশে ঘুরঘুর করছে জবাবের জন্যÑআমি কী তাহলে স্বার্থপর? সমুদ্রের এ যাত্রা তার সাথে কেন হয়নি? আমি চাইলেই কী কখনো তাকে সমুদ্র ভ্রমণ করাতে পারতাম না? উত্তরগুলো অজানা আকাশে উড়ছে আর চোখ টলটল করছে আবেগে। জীবনের এমন অনেক প্রশ্ন আছে যার উত্তরটা খুঁজতে অনেক সময় লেগে যায়। যদি মেরী বেঁচে থাকত আর এ সময় আমার পাশে থাকত তাহলে কেমন হত? সে আমার পাশে আনন্দ নিয়ে হেঁটে যেত। তার এ বয়েসে চঞ্চল হয়ে ওঠা আমায় ভাবিয়ে তুলত। হয়তো আমি তাতে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতাম। হয়তো তার রঙ্গে একটুখানি নিজেকেও রাঙ্গিয়ে নিতাম। আমার জীবনের কিছু হয়তো আর কখনই হবে না। সমুদ্রের ভেজা বালির চকচকে অবয়বতে মনে হচ্ছে তার চেহারাটা ভেসে উঠেছে। অনেক দূর হেঁটেছি বেশ ক্লান্তি লাগছে, একটু জিরিয়ে নিই। বীচে রাখা আছে বীচ সিটগুলো সেখানে গিয়ে হেলান দিয়ে কিছুক্ষণ বসতেই এক ছেলে বয়েসি লোক এসে বলেÑ

‘স্যার আমাদের প্রতি ঘণ্টা ত্রিশ টাকা।

‘(মুচকি হেঁসে) টাকা এখন নিবে নাকি পরে?’

‘আপনার ইচ্ছে।’

পকেট থেকে ত্রিশ টাকা বের করে তার হাতে দেই সে একটা স্লিপ কেটে দিয়ে চলে যায়। শরীরে ঘাম আসছে না অথচ ক্লান্তি ঠিকই লাগছে। বসে বসে সমুদ্র দেখছি আর মেরীর ভাবনায় এতটাই বিভোর হয়ে যাই যে সময় গড়িয়ে কখন আধঘণ্টা হয়ে গেল টেরই পাইনি। বেশ কিছুক্ষণ পর মোবাইলে নক দিল নরেন্দ্র দা। আশপাশে তাকিয়ে দেখি বেশ কিছুদূরে তারাও বসেছে সিটগুলোয়।

‘এখন উঠবে নাকি আরও কিছুক্ষণ বসবে? পার্কের ডাবখাওয়াটা আজ খাব কলাতলি বীচে। তুমি আরও কিছুক্ষণ বসতে চাইলে বসতে পার আমাদের কোনো তাড়া নেই।’

‘না দাদা বসব না আর, আমি আসছি আপনাদের কাছে।’

ওদের কাছে যেতেই পিটারের এলোমেলো দুষ্টামি শুরু হয়ে যায় আর আমাদের শুরু হয় বিনোদন। পার্কে হেঁটেও এতটা আনন্দ পাইনি যতটা সমুদ্র সৈকতে এসে পেলাম। মনে হয় জীবনটা আবার নতুন করে শুরু হচ্ছে ভোরের উদিয়মান সূর্যের মতো। হাসি-ঠাট্টা করতে করতে আমরা চলে এলাম কলাতলী বীচে। আশপাশে কোনো ডাবওয়ালা খুঁজে পাচ্ছি না। এত ভোরে আসে কী না তাও জানা নেই। এখন সকাল সাতটা মানুষজন একটু একটু করে বাড়ছে। এই সকালে কিছু তরুন ছেলেরা নেমেছে সাগরে। শীত উপেক্ষা করে তাদের আনন্দ অন্যরকম। তরুন বয়সে কতকিছুই রঙিন মনে হয়, কতকিছুকে আগলে নিতে ইচ্ছে করে। আমারও ইচ্ছে হচ্ছে তাদের সাথে নেমে পড়ি কিন্তু বয়সটা যে তরুন নেই, বার্ধক্য ছুঁয়ে ঝিমিয়ে পড়া মানুষের মতো হয়ে আছে। বীচ থেকে রাস্তার দিকে কিছুদূর হাঁটার পর অবশেষে পাওয়া গেল ডাবওয়ালাকে। সম্ভবত: সে এখনি এসেছে এখানে তার ঠেলাগাড়ি ঠিকঠাক বসানোও হয়নি। ডাব বিক্রির চাইতে তার ঠেলা বসানোতে মনযোগ দেখা যায়। আমরা ডাবের জন্য বলতেই অমনি দাঁ নিয়ে প্রস্তুত। চারটে কঁচি ডাবের জন্য বলা হয়।

‘জানো অনিমেষ কক্সবাজারের আশপাশে প্রচুর নারকেল গাছ আছে কারণ সমুদ্রতীরবর্তী এলাকাগুলোতে নারকেল গাছ বেশ থাকে। তাই এসব অঞ্চলে ডাবের সংকট থাকে না। তবে এরা দাম কেমন রাখে সেটাই বুঝতে হবে।’

‘ভয় পাইয়েন না স্যার আমাগো এহানে ডাবের দাম আপনেগো এলাকা থেইকা কমই হইব।’

‘তাই বুঝি, দাম কম আর বেশ জিনিস ঠিকঠাক হলেই হয়।’

‘সারোয়ার আমরা নাশতা কী এখান থেকে করে নিব?’

‘দাদা এখানে তো এখনো কোনো রেস্টুরেন্ট খোলেনি তাছাড়া সুগন্ধা বীচে রাস্তার উলটো দিকের গলিটায় ঢুকলে বেশ কিছু রেস্টুরেন্ট দেখেছি কাল। খাবারের মানও খারাপ হওয়ার কথা না, সেখানে না হয় যাওয়া যাক ততক্ষণে রেস্টুরেন্টগুলোও চালু হয়ে যাবে। আমরা পায়ে হেঁটে যাই যতদূর যাওয়া যায় পরে না হয় অটো রিকশায় উঠে পড়ব।’

‘ঠিক আছে তাহলে আমরা এগোই।’

‘দেখলে পিটার জীবনটা কত রঙিন এখনো শুধু বাঁচতে জানতে হয়। এই নতুন জায়গা আবার আমাদের সময়টাকে নতুন করে শুরু করে দিতে চাইছে, কী বল?’

‘আপনি ঠিকই বলেছেন দাদাÑবাঁচতে জানতে হয়। আমরা বোঝা সইতে সইতে গাধার মতো হয়ে যাই। জীবনে আমাদের নিজের জন্য কিছুই থাকে না আর যা থাকে সেটা শুধুই পরিবার কেন্দ্রিক আবার একটা সময় সবই হয়ে যায় অচেনা। গাধাটার মতো নিজেকেও অসহায় অবস্থায় বয়ে বেড়ানো আর কী। এখানে না আসলে জীবনকে নতুনভাবে ভাবতে পারতাম না।’

আমরা প্রায় ১০-১৫ মিনিট হাঁটলাম তারপর অটোরিকশা চেপে চলে আসি সুগন্ধা বীচের রাস্তায়। পাশের গলিতে ঢুকতেই দেখি রেস্তোরাঁগুলো খুলেছে আর জমজমাটও হচ্ছে। আমরা একটা ভালোমানের রেস্তোরাঁ দেখে ঢুকে পড়লাম। নাশতার জন্য দশ-পনেরো জন ব্যতিত তেমন কোনো লোকজন নেই। রেস্টুরেন্ট দেখে মনে হচ্ছে সত্তর থেকে আশি জন একসাথে খেতে পারবে। ম্যানুকার্ডের গেটআপ দেখে ভালো বলেই মনে হচ্ছে বাকিটা নাশতার পর বুঝা যাবে। এখন শীতকাল তাই পর্যটকদের আনাগোনা বেশি। রেস্তোরাঁ-হোটেলগুলোতে উচ্চ দামের বিষয়গুলো থাকতে পারে তাই বুঝে-দেখে ওর্ডার করতে হয়। এটার ম্যানুকার্ডে আইটেমের দামগুলো বেশি বলে মনে হচ্ছে না। আমরা সকলের জন্য একটা আইটেমই রাখছি, শুকনো পরোটা-সব্জি-ডিমের অমলেট। লোকজনের আনাগোনা একটু একটু করে বাড়ছে। আমাদের কাছ থেকে দশ মিনিটের

সময় চেয়ে নিল বেয়ারা।

‘আচ্ছা তোমাদের কী সেন্টমার্টিন যাওয়া হয়েছে?’

‘না দাদা আমাদের কারো যাওয়া হয়নি।’

‘তাহলে সেখানে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।’

‘সেখানে কী আছে?’

‘আরে বলে কীÑকী আছে? সেখানকার পরিবেশটাই অন্যরকম। একটা দ্বীপ যেখানে চারপাশে সমুদ্র এবং সকাল ও বিকাল এই দু সময়ে ক্রুজগুলো পর্যটক নিয়ে আসে যায়। কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকত আর ওখানকার সৈকতে একটু ভিন্নতা আছে। প্রচুর প্রবাল দেখতে পাবে আর এই প্রবালের কারণে তীরবর্তী সমুদ্রের জল বেশ স্বচ্ছ। আমি সেখানে গিয়েছিলাম বেশ কয়েকবার। রাতে না থাকলে বুঝতে পারবে না সেন্টমার্টিনের মজা কারণ রাত আটটা পর্যন্ত জেনারেটর দিয়ে বাতি জ¦ালানো হয় তারপর পুরো দ্বীপ অন্ধকার। দোকান রেস্তোরাঁ আর রিসোর্টগুলোতে জ¦লে হ্যারিকেন, কুপিবাতি আর কোথাও মশাল। তখন মনে হবে এই আধুনিক জনজীবন থেকে আমরা একটু ভিন্নতায় আছি, এক পলকে যেন বহুবছর পিছিয়ে গিয়েছি। যদি নারিকেল জিঞ্জিরায় যেতে হয় তাহলে খুব ভোরে জোয়ার আসার আগেই যেতে হবে। সেখানে প্রবাল এত বেশি মাত্রায় দেখা যায় যে মনটা ভরে উঠে আবার লাল কাঁকড়াও দেখতে পাবে। ছেড়া দ্বীপ, দারুচিনি দ্বীপ এগুলো সবই আশপাশে আছে। এই ছেড়া দ্বীপটা পুরোপুরি প্রবাল দ্বীপ যেটা জোয়ারের সময় মূল দ্বীপ থেকে আলাদা হয়ে যায়।’

‘আমি বেশ কিছু তথ্য উইকিপিডিয়ায় দেখেছিলাম বহু আগে দাদা।’

‘চল তাহলে এবার স্বচোখে গিয়ে দেখে নেই, কী বল সকলে?’

‘আমরা প্রস্তুত, কী করতে হবে সেটা বলুন?’

‘আমাদের রিসোর্টের রিসিপশনে আলাপ করে দেখি ওদের ব্যবস্থা আছে কী না সেখানে, না হলে বীচের আশপাশে বহু ট্রাভেল পয়েন্ট আছে সেখানে গিয়ে বুকিং দিয়ে আসব। আগে তো টেকনাফ থেকে যেতে হতো এখন নাকি কক্সবাজার থেকে সরাসরি বোটশিপগুলো নিয়ে যায়। টেকনাফ থেকে বঙ্গোপসাগরের প্রায় ৯-১০ কি.মি. দক্ষিণে গিয়ে সেন্টমার্টিন দ্বীপ। তখন সময় লাগত বেশ। আমার খেয়াল আছে কেয়ারী সিন্দাবাদ নামের একটা বোটশিপ ছিল। এটার ছাদ খোলা তাই গিয়ে মজা পাওয়া যায়।’

‘তাহলে আমাদের বুকিং এর ব্যবস্থা করা যাক কী বল সকলে।’

[পরের পর্ব আগামী সংখ্যায় প্রকাশিত হবে]

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়