প্রকাশ : ১৩ জুন ২০২৫, ১১:০৩
বৃদ্ধাশ্রমে ঈদের দিন

ঘড়িতে তখন সকাল আটটা। জুন মাসের ঈদের সকাল। শহরের কোলাহল থেকে একটু দূরে একটি সাদামাটা বৃদ্ধাশ্রম। নাম “নির্ভরতা নীড়।” বয়সের ভারে নুয়ে পড়া, জীবনের ছন্দ ভুলে যাওয়া কয়েকটি মানুষ এখানে নতুন করে বঁাচার চেষ্টা করেন। তবে আজকের সকালটা একটু ভিন্ন। আকাশে মেঘ নেই, গাছের পাতায় শিশির নেই, তবুও যেন বাতাসে এক ধরনের খুশির ঘ্রাণ লেগে আছে।
মোমেন চাচা চাতালের ধারে একটি কাঠের বেঞ্চিতে বসে মাটির দিকে তাকিয়ে ছিলেন। চোখে চশমা, মুখে হালকা দাড়ি। তঁার শরীরের চামড়া কুঁচকে গেছে, তবুও চোখে এক অভিজাত স্মৃতির ছাপ। তিনি একসময় শহরের নামকরা স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। আজ তঁার কাছে ঈদের সকাল মানে শুধু একাকীত্ব আর স্মৃতির ধুলো।
হঠাৎ পাশ থেকে কেউ বলল, “চাচা, চা খাবেন?”
মোমেন চাচা মুখ তুলে তাকালেন। শিউলি দাদি হাতে একটি ট্রে নিয়ে দঁাড়িয়ে। মুখে হাসি, কিন্তু চোখে অদ্ভুত এক অভিমান।
“না মা, এখন খেতে ইচ্ছে করছে না,” মোমেন চাচা ধীরে বললেন।
শিউলি দাদি মুখ ফিরিয়ে বললেন, “আজ ঈদ চাচা... কিছু না খেয়ে থাকবেন?”
মোমেন চাচা মনে মনে বললেন, “ঈদ তো অনেক আগেই ফুরিয়েছে... সেই যেদিন শেষবারের মতো ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলাম।”
শিউলি দাদি চলে গেলেন, আর মোমেন চাচা হারিয়ে গেলেন পুরোনো স্মৃতিতে। ছোটবেলায় ঈদের সকালে বাবা মার হাত ধরে মাঠে নামাজে যেতেন। সাদা পাঞ্জাবি, মাথায় টুপি, নতুন জুতা সবকিছু আজও মনে পড়ে। নামাজ শেষে মিষ্টির দোকানে দঁাড়িয়ে দই-মিষ্টি খাওয়া হতো। বাড়ি ফিরে মার হাতের সেমাই আর বাবার দেয়া সালামি।
তারপর জীবন অনেক পথ ঘুরেছে। বিবাহ, সন্তান, চাকরি, অবসর... আর এখন? সন্তান ব্যস্ত জীবনে তঁাকে “ঝামেলা” ভেবে এই আশ্রমে রেখে গেছে।
এদিকে শিউলি দাদি আয়নার সামনে দঁাড়িয়ে নিজের চুলে সাদা ফুল গুঁজে নিচ্ছেন। হাত কঁাপছে, তবুও চোখে একরকম আশা।
“ছেলেটা বলছিল, এইবার ঈদে আসবে। গত বছর তো ব্যস্ত ছিল, এবার নিশ্চয়ই আসবেৃ”
রোকেয়া খালা পাশে বসে বললেন, “হুঁ, আসবেৃ তোমার মতো আমিও প্রতি ঈদে এই কথা ভাবি। কিন্তু কই, ওরা তো ঈদের ব্যস্ততা ভুলে গেছে আমাগো।”
শিউলি দাদি মুখ ফিরিয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে হাসলেন, “তবুও মনে হয়, যদি একবার দেখে যায়!”
আশ্রমের অন্যান্য বাসিন্দারাও আজ একটু ব্যতিক্রম আচরণ করছেন। সেলিনা খালা নিজের পুরনো সালোয়ার কামিজ বের করে আয়রন করছেন। কাদির কাকা বিছানা গুছিয়ে গুনগুন করে গাইছেন পুরনো ঈদের গান “ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশির ঈদ।”
আশ্রমে নতুন এসেছেন জয়নাল কাকা। মাত্র কয়েকদিন হলো এসেছেন, মুখচোখ গম্ভীর। কেউ তেমন কথা বলেন না। তবে আজ সকালে তিনিও মসজিদের দিকের জানালার পাশে বসে ছিলেন কিছুক্ষণ, চোখে ছিল এক ধরনের বিষণ্ণতা।
বৃদ্ধাশ্রমের ম্যানেজার সোহেল ভাই সকাল থেকেই ব্যস্ত। ঈদের সেমাই নিজে দঁাড়িয়ে রান্না করিয়েছেন। রান্নাঘরের পাশে দঁাড়িয়ে মুনা আপা ওরফে নার্সিং হেড নিজের হাতে প্রতিটি বাসিন্দার জন্য ছোট ছোট ঈদের প্যাকেট বানাচ্ছেন।
“আমাদের বাবা-মায়ের মত মানুষ, ওরা যদি আজও একটা হাসি পায়, সেটাই আমাদের ঈদ,” মুনা আপা বললেন এক স্বেচ্ছাসেবক তরুণকে।
ঠিক দশটার দিকে গেটের বাইরে কয়েকটি তরুণ-তরুণী ভিড় করে। তঁাদের হাতে ছোট উপহারের ব্যাগ, বেলুন, কার্ড, কিছুজনের হাতে ছোট ছোট বাক্স।
“আমরা ‘ঈদ-সাথী’ ক্লাব থেকে এসেছি,” একজন বলল।
ম্যানেজার সোহেল ভাই তাদের সাদর অভ্যর্থনা জানালেন।
তরুণরা বৃদ্ধাশ্রমে ঢুকতেই জায়গাটির পরিবেশ বদলে গেল। কেউ কারো হাত ধরে বলল, “ঈদ মোবারক, দাদু।”
মোমেন চাচার চোখ ছলছল করে উঠল। এতদিন পর কেউ তঁাকে “দাদু” বলল।
তরুণটি হাত ধরেই বলল, “চলুন দাদু, একসাথে সেলফি তুলি।”
শিউলি দাদি বললেন, “তোমরা সত্যিই আমার ছেলের মতো লাগছো, বেটারা।”
রোকেয়া খালা পাশ থেকে যোগ করলেন, “এতদিন পরে মনে হচ্ছে কেউ আমাদের কথা মনে রেখেছে।”
তরুণরা গান গাইছে, কেউ কেউ আবৃত্তি করছে, আবার কেউ গল্প করছে জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে। একজন স্বেচ্ছাসেবক বৃদ্ধদের নিয়ে খোলা উঠানে বল খেলা শুরু করে দেয়—একটা ছোট রাবারের বল। সবাই মিলে খেলায় মেতে ওঠে। এমন দৃশ্য আগে কেউ দেখেনি।
ঈদের নামাজ পড়ার জন্য সবাই প্রস্তুত হলেন। আশ্রমের পিছনের উঠানে সাদা চাদর পেতে তৈরি হল নামাজের স্থান। সবাই একসাথে ঈদের নামাজে অংশ নিলেন—কেউ হুইলচেয়ারে, কেউ সহায়তায় দঁাড়িয়ে।
নামাজ শেষে আলিঙ্গন, সালাম আর কঁাধে হাত রেখে দোয়া চলল। মোমেন চাচা চোখের পানি মুছে বললেন, “আজ মনে হচ্ছে, আমি এখনও বেঁচে আছি।”
এরপর শুরু হল খাওয়ার পালা। ম্যানেজার নিজ হাতে প্রতিটি বাসিন্দাকে সেমাই পরিবেশন করলেন। তরুণ স্বেচ্ছাসেবকরা খাবার পরিবেশনে সাহায্য করলেন।
মুনা আপা একটা মাইকে বললেন, “এখন শুরু হবে আমাদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। যারা গান করতে চান, আসুন।”
সেলিনা খালা একটি পুরনো নজরুলগীতি গাইলেন। কণ্ঠ কঁাপছিল, কিন্তু মনের ভিতর ছিল ঈদের আনন্দ। কাদির কাকা তঁার কণ্ঠে পাঠ করলেন—“ঈদ মানে খুশি, ঈদ মানে শান্তি। যে ভালোবাসে, সেই পায় ঈদের আসল অর্থ।”
এক তরুণী আবৃত্তি করল জীবনানন্দের কবিতা। অন্যজন গিটার বাজিয়ে আধুনিক গান গাইল, বৃদ্ধরা হাততালি দিলেন। জয়নাল কাকা হঠাৎ বললেন, “আমি একটা গল্প বলবো।”
সবাই চুপ। জয়নাল কাকা বললেন, “আমি একদিন ছেলেকে বললাম, বাবা আমার সঙ্গে ঈদের নামাজে চল, সে বলল ‘আজ মিটিং আছে বাবা।’ এখন এখানে এসেছি, কিন্তু আজ মনে হচ্ছে আমি ঠিক জায়গায় আছি।”
তরুণরা তাদের প্রজেক্টরের মাধ্যমে একটি ছোট ভিডিও দেখালেন। বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দাদের ছোট ছোট স্মৃতি আর তাদের জন্য শুভেচ্ছা বার্তা। ভিডিও শেষে এক তরুণ বলল,
“দাদু-নানু, আপনাদের জন্য আমরা রইলাম। যেখানেই থাকুন, আজ থেকে আপনারা একা নন।”
এই কথা শুনে শিউলি দাদি একরকম ফুপিয়ে উঠলেন।
“তোমরা যদি এতো আগে আসতেৃ অনেক আগেই তোমাদের অপেক্ষা করতাম।”
বিকেল হতেই রোদের আলো নরম হয়ে এল। আশ্রমের উঠানে সবাই গোল হয়ে বসে গল্প করছে। মোমেন চাচা বললেন, “এই বয়সে এসে কেউ যদি একবার বলে ‘আপনার কথা ভাবি’, তবেই বোঝা যায় জীবনের অর্থ।”
রোকেয়া খালা বললেন, “আজ অনেক দিন পরে মনে হচ্ছে, আমরা মানুষ, অবাঞ্ছিত নই।”
সন্ধ্যার আগে তরুণরা বিদায় নিল। তাদের হাতে মোমেন চাচা নিজ হাতে লেখা চিঠি দিলেন—“যদি কখনও ভুলে যাও, এই মুখগুলো মনে রেখো।”
সন্ধ্যায় আশ্রমে আবার নিঃশব্দতা নেমে এল। কিন্তু সেই নিঃশব্দতা আজ আর কঁাটার মতো নয়। আজকের ঈদ দিনটুকু তাদের মনে গেঁথে গেল—একটা ঈদ, যেখানে ভালোবাসা ছিল, সম্মান ছিল, মানবতা ছিল।
মোমেন চাচা চাতালে বসে সন্ধ্যার আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আজ আমার ঈদ হয়েছে।”