প্রকাশ : ১৮ জুন ২০২৫, ০৯:৩৬
শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্য করা যাবে না

শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. চৌধুরী রফিকুল আবরার বলেছেন, ‘সবার মধ্যে শিক্ষার ছোঁয়া পড়লে সমগ্র বাংলাদেশ পরিবর্তন হতে বেশি সময় লাগবে না। শিক্ষা মানুষকে বিনয়ী করে। একজন শিক্ষার্থী যদি শিক্ষক ও পরিবারের মধ্যে থেকে সঠিক শিক্ষা পান, তিনি কখনো দম্ভ দেখাবেন না, তিনি বিনয়ী হবেন।
শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্য করা যাবেনা। শিক্ষা হচ্ছে প্রকৃত মানুষ হওয়ার মাধ্যম, এ ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। গত শুক্রবার বিকেলে চট্টগ্রাম নগরীর কাজির দেউড়িতে গুণীজন সংবর্ধনা ও কৃতী শিক্ষার্থী সংবর্ধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। বাংলাদেশ বৌদ্ধ সমিতির উদ্যোগে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। তিন পর্বের অনুষ্ঠানে প্রথেমে ধর্মীয় পর্ব, দ্বিতীয় পর্বে গুণীজন সংবর্ধনা এবং তৃতীয় পর্বে কৃতি শিক্ষার্থী সংবর্ধনা অনুষ্ঠিত হয়।
আমাদের শিক্ষা আসলে বহু পূর্বেই বাণিজ্যিক রূপ ধারণ করেছে। এটি একদিনে হয়নি কিংবা কারুর একক ইচ্ছায়ও হয়নি। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট, গ্লোবাল ভিলেজ ধারণা, শিল্পায়নসহ বিশ্ব সংস্কৃতির অংশ হিসেবে এটি হয়েছে। দেশের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে তাকালে দেখা যায় সর্বত্রই বিবিএ ও এমবিএ-তে ঠাসাঠাসি, সেখানে নেই মানবিক শিক্ষার মানবিক বিষয়গুলো। যেমন ইতিহাস নেই, ভূগোল নেই, ধর্মতত্ত্ব নেই, সাহিত্য নেই। সাহিত্য আছে, সেটিও বাণিজ্যিকভাবে।
যেমন-ইংরেজি। সেখানে দুটো স্ট্রীম --একটি হচ্ছে ল্যাংগুয়েজ অন্যটি সাহিত্য। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যায়গুলোতে ইংরেজি সাহিত্য নেই, দু চারটিতে থাকলেও তেমন জোর নেই, শিক্ষার্থী সংখ্যাও কম। কিন্তু ল্যাংগুয়েজে শিক্ষার্থী ভর্তি, শিক্ষকরাও সবাই ল্যাংগুয়েজ পড়াচ্ছেন। ছোটখাট যেসব স্টাডি হচ্ছে, বা গবেষণাও যদি বলি সেগুলো সবই হচ্ছে ল্যাংগুয়েজের ওপর অর্থাৎ বাণিজ্য। ল্যাংগুয়েজ শিখিয়ে দেশে বিদেশে,দেশীয় ও বিদেশি সংস্থায় চাকরির ব্যবস্থা যাতে করা যায়, বিষয়টিকে আমরা অবজ্ঞাও করতে পারছিনা। আগে তো পেট বাঁচাতে হবে তারপর বাকীটা! তাই, শিক্ষার্থীরা এখন সাহিত্য পড়ছেন না। বাংলা সাহিত্য তো কোনো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়না। অথচ শিক্ষার্থীরা যদি শওকত ওসমানের ‘ক্রীতদাসের হাসি’ না পড়েন তাহলে তারা কিভাবে ইতিহাস, মানবিকতা, জীবন দর্শন শিখবেন। আমাদের দেশে ২০২৪-এ যা ঘটে গেলো তার প্রকাশই তো আমরা পাই ‘ক্রীতদাসের হাসির’ মধ্যে। আমরা আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের যাঁতাকল, স্বৈরাচারী সরকারের চিত্র ও কার্যকলাপ খুঁজে পাই ক্রীতদাসের হাসির মধ্যে। একইভাবে, ইংরেজি সাহিত্যের ম্যাথ্যু আরনল্ডের ‘ডোভার বীচ’ কবিতা পড়লে
মানুষের ক্ষয়িঞ্চু মানবতা, মানবিক গুণাবলি কিভাবে ধীরে ধীরে ধ্বংস হচ্ছে তার উদাহরণ দেখতে পাই। কবিতার শেষ লাইন দুটোতে লেখা আছে বিশ্বে অজ্ঞ সেনারা একে অপরের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত, কেন তারা যুদ্ধ করছেন নিজেরাই জানেন না। যুদ্ধ শুধু ধ্বংসই ডেকে আনছে, মানবতা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিচ্ছে গোট বিশ্বে। অথচ সেই সেনাবাহিনী পোষার জন্য তথাকথিত সভ্য ও আধুনিক বিশ্ব বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করছে শুধুমাত্র সৃষ্টির সেরা জীবকে ধ্বংস করার জন্য। কি হচ্ছে ফিলিস্তিনে? কি হচ্ছে আফ্রিকার দেশগুলোতে, কি হচ্ছে রাশিয়া- ইউক্রেনে? অতি সম্প্রতি ইরান-ইসরায়েলের সংঘর্ষে? এসব পড়লে শিক্ষার্থীদের জীবনের ওপর যে নৈতিকতা ও মানবতার ছাপ পড়ে সেটি ব্যক্তিজীবন, দেশ ও গোটা বিশ্বকে শান্তির পথে নিয়ে যায়। কিন্তু আমরা দেখছি সবাই বিবিএ, এমবিএ পড়ছেন যেখানে ব্যবসা শিক্ষাই মূল। কিভাবে কাষ্টমারদের আকৃষ্ট করতে হবে, কিভাবে ব্যবসা বাড়াতে হবে ইত্যাদি নিয়ে শিক্ষার্থীদের দৌঁড়, ব্যস্ততা আর সবকিছু। কোথায় সাহিত্য, কোথায় মানবিকতা আর কোথায় নৈতিকতা? বর্তমান জগতের এই বাস্তব বিষয়গুলো আমরা এড়াতে পারবো না, অবজ্ঞাও করতে পারবো না। এরসঙ্গে যদি নৈতিকতা, মানবিকতা, সহানুভূতি চর্চার ক্ষেত্র ও জায়গা থাকতো, মানবিক বিষয়গুলো এগুলোর সঙ্গে গুরুত্ব সহকারে শেখানো হতো তাহলে সেটি হতো সোনায় সোহাগা। কিন্তু সেই কাজটি কে করবেন, কীভাবে করবেন? রাষ্ট্রীয় একটি প্রচেষ্টা থাকতে হবে, তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজ নিজ কারিকুলাম যদি সেভাবে তৈরি করে তাহলে সমাজে অনেকটাই পরিবর্তন আসবে। সেটি তো কেউ করছি না, শুধু বলছি শিক্ষা মানুষকে পরিবর্তন করে, কীভাবে করবে সেটি ? আমরা কেউ বাতলে দিচ্ছিনা, আর তাই হচ্ছেওনা।
এবার যদি স্কুল ও কলেজের শিক্ষার দিকে তাকাই তাহলে সর্বত্রই দেখা যায় ব্যবসা আর ব্যবসা। আপনি পাঁচশত অভিভাবককে প্রশ্ন করবেন আপনার ছেলে বা মেয়েকে কি বানাতে চান? সম্ভবত একজনও পাবেন না যে, যিনি বলবেন যে আমার ছেলে বা মেয়েকে শিক্ষক বানাবো। অথচ শিক্ষকরাই কিন্তু সমাজ ও রাষ্ট্রকে মানবতা শিক্ষা দেয়, দিতে পারেন। সবাই বলবে ডাক্তার বানাবো, কেন সেখানে প্রচুর পয়সা উপার্জনের সুযোগ আছে, সামাজিক মর্যাদা অর্থাৎ সমাজ ঐ পেশাটাকে মর্যাদা দিতে শিখেছে। ইঞ্জিনিয়ার বানাবে কারণ অর্থ আছে, বিসিএস অফিসার বানাবে কারণ ঘুষ আছে, অর্মি অফিসার বানাবে কারণ দাপট আছে আর প্রচুর সুযোগ সুবিধা আছে---তার মানে সর্বত্রই বাণিজ্যিক চিন্তা। কাজেই আমরা একটি বা দুটি কথায় এসব চেঞ্জ করতে পারবোনা।
স্কুল কলেজে যেসব শিক্ষক বাণিজ্যিকভাবে কিছু বিষয় পড়াতে পারেন, তাদেরকে সমাজ পছন্দ করে, অভিভাবকরা পছন্দ করেন। যেমন গণিতের শিক্ষক, বিজ্ঞানের শিক্ষক, ইংরেজির শিক্ষক কারণ তারা অতিরিক্ত পয়সা কামাতে পারেন। অন্য বিষয়ের শিক্ষকদের কাছে অনেক অভিভাবক মেয়ে বিয়ে দিতে চাননা কারণ তারা জানেন তাদের উপার্জন সীমিত। তার মানে সব জায়গায় বাণিজ্য!
শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করবে কি বই? এনসিটিবির বই তারা পড়েন না, পড়তে চাননা, শিক্ষকরাও পড়ান না। কারণ বাজারে প্রচুর গাইড বই আছে। গাইড বই থাকায় দোষ নেই কিন্ত দোষটা হচ্ছে তারা সহজ থেকে সহজতর করার প্রতিযোগিতায় নেমে শিক্ষার্থীদের ধ্বংস করছে। শিক্ষার্থীরা কোনো কিছু না বুঝে না জেনেই প্রচুর নম্বর পেয়ে উচ্চতর গ্রেড পাচ্ছে শুধুমাত্র ঐসব নির্দিষ্ট কোম্পানির গাইড পড়ে। সেইসব গাইড আবার দেশজুড়ে নামকরা। শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক সবাই দেদারছে কিনছেন সেগুলো।এখানেও বিশাল বাণিজ্য! কি দিয়ে আমরা ঠেকাবো এসব বানিজ্য? হাঁ, যদি পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন কিংবা প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষার প্রশ্ন ঠিকমতো করা যায় যেখানে শিক্ষার্থীদের জানতে হবে, বুঝতে হবে, নিজের সৃজনশীলতা প্রকাশ করার সুযোগ থাকবে তাহলে গাইড-নোটগুলোরও পরিবর্তন হবে। কিন্তু আমরা সেসব জায়গায় হাত না দিয়ে যদি বলি শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল হতে হবে, সেটি কিভাবে হবে?
উপদেষ্টা বলেছেন, মহামতি গৌতম বুদ্ধ সুস্পষ্টভাবে জ্ঞান আহরণ ও মূল্যবোধ সৃষ্টির প্রতি গুরুত্বারোপ করেছিলেন। সেই আড়াই হাজার বছর আগে প্রচারিত গৌতম বুদ্ধের বাণী আমাদের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিফলন ঘটাতে পারলে প্রত্যেকের বাস্তব জীবন সফল ও সুন্দর হবে। এটি সত্যি কথা। তিনি আরো বলেছেন, আমাদের শিক্ষা পদ্ধতি হতে হবে আনন্দমুখর। যেখানে মানবিক মূল্যবোধ ধারণ করে সমাজ একজন ভালো মানুষ হওয়ার পথে নিজেকে গড়ে তুলতে পারে। প্রতিযোগিতামূলক শিক্ষা কখনো ভালো মানুষ সৃষ্টি করতে পারেনা।
শিক্ষার্থীরা প্রতিযোগিতার মাধ্যমে শিখবে না, শিখবে আনন্দের মাধ্যমে। আসলে যদি বলা হতো যে, অসুস্থ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা ভাল মানুষ হয়না, প্রকৃত জ্ঞান অর্জন করতে পারেন না, সেটি অধিক যুক্তিযুক্ত হতো। লেখাপড়ায় প্রতিযোগিতা থাকতে হবে, সেটি হবে সুস্থ, সৃজনশীল। প্রতিযোগিতা না থাকলে শিক্ষার্থীদের অবস্থা হবে তথাকথিত ‘কম্পিটেন্সি বেজড’ । কারিকুলামের নামে যা শুরু করা হয়েছিলো যেখানে প্রতিযোগিতা আর আনন্দের কথা বলে ‘আম ও ছালা’ দুটোই খোয়াতে হয়েছিলো শিক্ষার্থীদের। শিক্ষা অবশ্যই আনন্দময় হতে হবে, নতুন বিষয়ের সঙ্গে পরিচিত হওয়া, জানা, বড় বড় লেখকদের ও বিজ্ঞানীদের চিন্তাধারার সঙ্গে পরিচিত হওয়া বিরাট আনন্দের ব্যাপার। সেটি ঘটাতে জানাতে হবে এবং ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের শিক্ষার্থীরা সংক্ষেপে পাসের আশায় সবকিছু বিসর্জন দিয়ে অতি সংক্ষিপ্তভাবে সবকিছু পড়ে বেশি নম্বর আর উচ্চতর গ্রেড পেয়ে যাচ্ছেন যেটি শিক্ষাও না, জানাও নয়, আনন্দও নয়, প্রকৃত সৃজনশীলতাও নয়। এগুলো সবই ব্যবসা, সবই বাণিজ্য। এই বাণিজ্য থেকে
রেহাই পাওয়া খুব সহজ নয়, তবে অসম্ভবও নয়। এজন্য কাজ করতে হবে সবাইকে একসঙ্গে। বুঝতে হবে আর বুঝাতে হবে বাণিজ্যিক লেখাপড়ার বিশাল ও দীর্ঘস্থায়ী অসুবিধাগুলো।