প্রকাশ : ২০ আগস্ট ২০২৫, ০৮:৫৮
চাঁদপুরের সাঁতারের ঐতিহ্য ধরে রাখতে কাজ করে যাচ্ছেন
------------------------------------বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. ছানাউল্লাহ খান

চাঁদপুরের সাঁতারের ঐতিহ্য গৌরবময় ও সমৃদ্ধ। সেই ঐতিহ্য ধরে রাখতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাঁতার প্রশিক্ষক মো. ছানাউল্লাহ খান। অবিরাম ও দূরপাল্লার সাঁতারে রয়েছে তাঁর কৃতিত্ব। তিনি ১৯৯৯ সালের ১৮-১৯ সেপ্টেম্বর সাঁতারু একেএম বাদশাহ মিয়া ও রোকনুদ্দিন ভূঁইয়া বাবুলের সাথে ঢাকা-চাঁদপুর দূরপাল্লার সাঁতারে অংশ নিয়েছিলেন। এই সাঁতারের পূর্বে ও পরে চাঁদপুর সদর উপজেলার ফরক্কাবাদ উচ্চ বিদ্যালয় সংলগ্ন দিঘি, চাঁদপুর শহরের বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন শেরে বাংলা ছাত্রাবাসের পুকুরে ও চাঁদপুর আউটার স্টেডিয়ামের অরুন নন্দী সুইমিং পুলসহ অন্য স্থানে দিনব্যাপী অবিরাম সাঁতার কেটে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। ২০১৪ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত তিনি চাঁদপুর সাঁতার পরিষদের মাধ্যমে অরুন নন্দী সুইমিং পুলে সাঁতার প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালিয়ে চাঁদপুর জেলায় একজন সাঁতার প্রশিক্ষক হিসেবে বহুল পরিচিতি লাভ করেন। তারপর তিনি জেলা ক্রীড়া অফিস ও জেলা ক্রীড়া সংস্থার মাধ্যমে সাঁতার প্রশিক্ষণের বিভিন্ন উদ্যোগ সফল করতে সহযোগিতা করে চলছেন। তিনি বলেন, সাঁতার শরীরকে সুস্থ রাখে, মনকে সতেজ রাখে এবং ফিটনেস ধরে রাখার জন্যে এটি সেরা অনুশীলন। সম্প্রতি চাঁদপুর কণ্ঠের সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার মো. আবদুর রহমান গাজী ‘ক্রীড়াকণ্ঠে’র জন্যে তাঁর একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন।
ক্রীড়াকণ্ঠ : আপনার শারীরিক সুস্থতা ও ফিটনেসের পেছনে সাঁতারের ভূমিকা কেমন বলে আপনি মনে করেন?
মো. ছানাউল্লাহ খান : সাঁতার শরীরের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে সমানভাবে সক্রিয় রাখে। হৃদযন্ত্র ও ফুসফুসকে শক্তিশালী করে। নিয়মিত সাঁতার অনুশীলন শরীরের ফিটনেস ধরে রাখে ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। আমি মনে করি, সাঁতার শরীরকে সুস্থ রাখে, মনকে সতেজ রাখে এবং ফিটনেস ধরে রাখার জন্যে এটি সেরা অনুশীলন।
ক্রীড়াকণ্ঠ : আপনি অরুন নন্দী সুইমিং পুলসহ বিভিন্ন স্থানে বহু শিশু-কিশোর, এমনকি বড়োদেরও সাঁতার শেখান। আপনাকে শৈশবে সাঁতার শিখিয়েছে কে?
মো. ছানাউল্লাহ খান : শৈশবে বাড়ির পুকুর ও খালি বিলে ডুবাতাম। চাঁদপুর গণি আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে সম্ভবত ১৯৬৭ বা ৬৮ সালে বীর মুক্তিযোদ্ধা হানিফ পাটোয়ারী ভাই আমাদের বিদ্যালয়ের অনেককেই সাঁতার শেখাতেন। ওই সময় আমাদের বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর সেরা সাঁতারুদের মধ্যে মো. ওয়াজিউল্লাহ পাটোয়ারী, আব্দুল করিম, আব্দুর রাজ্জাক মিন্টু ও নুরুল আফসার ভাই বিভিন্ন জায়গায় সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশ নিতেন। তারা কুমিল্লায় বিভাগীয় পর্যায়ে বিজয়ী হয়েছেন। তাঁদের দেখে সাঁতারে আমি অনুপ্রাণিত হই। আজও আছি সেই সাঁতারের সাথেই।
ক্রীড়াকণ্ঠ : সাঁতারে আপনার উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব কী কী?
মো. ছানাউল্লাহ খান : স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে বেশ কিছু প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পেয়েছি। পাশাপাশি অসংখ্য সাঁতারুকে প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের সাফল্যে অবদান রাখতে পেরেছি, এটাই সবচেয়ে বড়ো কৃতিত্ব।
ক্রীড়াকণ্ঠ : অবিরাম ও দূরপাল্লার সাঁতারু হতে হলে একজন সাঁতারুর কী কী অতিরিক্ত যোগ্যতা লাগে?
মো. ছানাউল্লাহ খান : দীর্ঘমেয়াদী অনুশীলন, মানসিক দৃঢ়তা, শারীরিক সহনশীলতা, পানির সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক এবং সঠিক খাদ্যাভ্যাস থাকা জরুরি।
ক্রীড়াকণ্ঠ : এককালে সাঁতারে চাঁদপুরের যে গৌরব ছিলো, সেটির পেছনে কাদের অবদান ছিলো বলে আপনি মনে করেন?
মো. ছানাউল্লাহ খান : বাংলাদেশের গর্ব চাঁদপুরের ছেলে এম এ মালেক, অরুন নন্দী ও একেএম বাদশাহ মিয়ার অবদান সবচেয়ে বেশি। তাঁরা আন্তর্জাতিক ও জাতীয় অঙ্গনে চাঁদপুরের নাম উজ্জ্বল করেছেন।
ক্রীড়াকণ্ঠ : চাঁদপুর জেলা ক্রীড়া সংস্থার দুটি স্থাপনার নাম যথাক্রমে মালেক ক্রীড়া ভবন ও অরুন নন্দী সুইমিং পুল। এ দুটি নাম কিংবদন্তিতুল্য। সাঁতারু এম এ মালেক ১৯৬৫ সালে ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করেন এবং অরুন নন্দী ১৯৭১ সালে অবিরাম সাঁতারে বিশ্ব রেকর্ড সৃষ্টি করেন। এঁদের নামে দুটি স্থাপনা করেই কি জেলা ক্রীড়া সংস্থা সাঁতারের জন্যে অনেক কিছু করে ফেলেছে, না আরো অনেক কিছু করার আছে?
মো. ছানাউল্লাহ খান : নামকরণ গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু সাঁতারের উন্নয়নে এখনও অনেক কাজ বাকি আছে, বিশেষত প্রশিক্ষণ, প্রতিযোগিতা আয়োজন ও অবকাঠামো উন্নয়ন। এছাড়া প্রতিটি উপজেলায় ছোট ছোট সুইমিং পুলের ব্যবস্থা করা এবং স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসায় এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করা।
ক্রীড়াকণ্ঠ : সত্যি কথা বলতে কী, চাঁদপুরের সাঁতারের গৌরব ও ঐতিহ্য আগের মতো নেই। কারণ কী কী আপনি বলতে পারবেন?
মো. ছানাউল্লাহ খান : নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও প্রতিযোগিতার অভাব, তরুণদের অনাগ্রহ এবং পর্যাপ্ত পৃষ্ঠপোষকতার ঘাটতি মূল কারণ।
ক্রীড়াকণ্ঠ : সম্প্রতি আপনি অরুন নন্দী সুইমিং ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন। এই ক্লাবের মাধ্যমে কেবল অরুন নন্দীর স্মৃতি রক্ষা করবেন, না সাঁতারের উন্নয়নে কাজ করবেন?
মো. ছানাউল্লাহ খান : স্মৃতি রক্ষা তো আছেই, পাশাপাশি চাঁদপুরের সাঁতারকে আবারও শীর্ষে নিয়ে যাওয়ার জন্যে কাজ করছি।
ক্রীড়াকণ্ঠ : সম্প্রতি বাংলাদেশ সুইমিং ফেডারেশন সুইমার্স টেলেন্ট হান্ট কার্যক্রম সম্পন্ন করেছে চাঁদপুরে। এই কার্যক্রমের মাধ্যমে কি চাঁদপুর থেকে সাঁতারের প্রতিভা খুঁজে পাওয়া গেছে? আপনি এ কার্যক্রমের কী মূল্যায়ন করবেন?
মো. ছানাউল্লাহ খান : বেশ কিছু সম্ভাবনাময় প্রতিভা পাওয়া গেছে। সঠিক প্রশিক্ষণ পেলে তারা জাতীয় পর্যায়ে সফল হতে পারবে।
ক্রীড়াকণ্ঠ : আপনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধকালীন আপনি কি নৌকমান্ডো ছিলেন? যাঁরা নৌকমান্ডো ছিলেন, তাঁরা কি সবাই ভালো সাঁতারু ছিলেন?
মো. ছানাউল্লাহ খান : আমি নৌকমান্ডো ছিলাম না। তবে অনেক নৌকমান্ডোই অসাধারণ সাঁতারু ছিলেন। আমি বিএলএফের সশস্ত্র একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং প্রশিক্ষক ছিলাম।
ক্রীড়াকণ্ঠ : আপনি পেশাগতভাবে কী করেছেন ও করছেন? আপনার স্ত্রী, পুত্র-কন্যারা কে কী করছেন? তাদের কাউকে কি সাঁতারু বানিয়েছেন?
মো. ছানাউল্লাহ খান : পারিবারিকভাবেই আমাদের পরিবারের বাবা এবং ভাই-বেরাদররা ছিলেন পুস্তক ব্যবসায়ী। আমাদের ইসলামিয়া ও তাজমহল লাইব্রেরী রয়েছে। ফাঁকে প্রবাসে ছিলাম একযুগ। এখন বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন নিয়ে কাজ করছি। স্ত্রী ও সন্তানরা নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে ব্যস্ত, তবে কাউকে পেশাদার সাঁতারু বানাইনি।
ক্রীড়াকণ্ঠ : সাঁতারের এমন কোন্ স্মৃতি আপনাকে এখনও গৌরবান্বিত করে?
মো. ছানাউল্লাহ খান : আমার প্রশিক্ষণে যারা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সাফল্য অর্জন করেছে, তাদের সাফল্যই আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো গৌরব।
আমার তিন ছেলে তিন মেয়ে। বড়ো ছেলে মোহাম্মদ কামরুজ্জামান খান ও ছোট ছেলে মো. মাহফুজুর রহমান খান তারা দুজনেই পুলিশে চাকরি করছেন। আর মেজো ছেলে মো. মাসুদ খান ব্যবসা করছেন। অপরদিকে তিন মেয়ে সেলিনা আক্তার, ফারজানা আফরোজ দিপা ও ফারিয়া আক্তার তারা সবাই সুগৃহিণী।