প্রকাশ : ০৩ জুন ২০২৫, ০৯:২২
একান্ত সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক রেজাউল করিম রেজা
ক’টি বিষয়ে নজর দিলে ফরিদগঞ্জ ক্রীড়াক্ষেত্রে অনেক উন্নতি করতে পারবে

ফরিদগঞ্জের কৃতী সন্তান রেজাউল করিম রেজা। বাংলাদেশের ক্রীড়া জগতে তিনি এক সাড়া জাগানো নাম। তিনি বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের অধিনায়কত্ব করার সুযোগ পেয়েছেন। ফরিদগঞ্জের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে নিরলস চেষ্টার মাধ্যমে তিনি জাতীয় পর্যায়ের ফুটবলে নিজেকে যেভাবে তুলে ধরতে পেরেছেন, সেভাবে তাঁর এলাকার ছেলেরাও যাতে তুলে ধরতে পারে, সে লক্ষ্যে তিনি কাজ করছেন আন্তরিকভাবে। চাঁদপুর কণ্ঠের পাক্ষিক আয়োজন ‘ক্রীড়াকণ্ঠে’র পক্ষ থেকে রেজাউল করিম রেজার একান্ত সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়। প্রশ্নোত্তর আকারে সেই সাক্ষাৎকারটি নিচে পত্রস্থ করা হলোÑ
ক্রীড়াকণ্ঠ : আপনার খেলোয়াড়ি জীবন কবে থেকে শুরু? কতোদিন মাঠের খেলায় সক্রিয় ছিলেন বা আছেন?
রেজাউল করিম রেজা : আমার খেলোয়াড়ি জীবন শৈশবকাল থেকে শুরু। আমি যখন ৫ম শ্রেণীতে পড়ালেখা করি, তখন থেকেই বাড়ির উঠোনে বা কখনো কখনো স্কুল মাঠে ফুটবলের মৌসুমে ফুটবল এবং ক্রিকেটের সময় ক্রিকেট খেলতাম। আমি খেলাধুলাকে খুবই ভালোবাসতাম। বিশেষ করে ফুটবল। তখন থেকেই আমি প্রতিনিয়ত ফুটবল খেলতাম। ফরিদগঞ্জের পাটওয়ারী বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে আন্তঃ প্রাথমিক ফুটবল টুর্নামেন্টে অতিথি খেলোয়াড় হিসেবে আমি ও আমার বন্ধু রাজন আছৎকুয়ারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের হয়ে অংশগ্রহণ করি। তারপর আমি ফরিদগঞ্জ ও চাঁদপুরের আনাচে কানাচে ছোট-বড়ো বহু ফুটবল টুর্নামেন্টে খেলেছি। আমি যখন দশম শ্রেণিতে পড়ি, তখন বয়সভিত্তিক চাঁদপুর স্টেডিয়ামে অনূর্ধ্ব ষোল ফুটবল দলে খেলোয়াড় বাছাই চলছিলো। এই সংবাদ শোনার পর আমি, আমার বন্ধু রাজন ও সুমন সাইকেল চালিয়ে সকাল ৮ টায় চাঁদপুর স্টেডিয়ামে আসি। এটাই আমার চাঁদপুর স্টেডিয়ামে প্রথম আসা। সাড়ে ৯টায় মাঠে দুটি গ্রুপ করে খেলতে দেওয়া হয়। খেলাশেষে প্রশিক্ষকবৃন্দ আমাকে ড্রেসিং রুমে নিয়ে গেলেন এবং আমাকে অনূর্ধ্ব ষোল ফুটবল দলে সুযোগ দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। পরবর্তীতে আমাকে ঢাকায় বিকেএসপিতে নিয়ে যাওয়া হয়। ঐবছরই আমি এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করি এবং ভালো ফলাফল অর্জন করি। বিকেএসপিতে প্রশিক্ষণ গ্রহণকালীন বিভিন্ন ক্লাবে খেলার জন্যে ডাক পড়ে। ফরাশগঞ্জ স্পোর্টিং ক্লাবে খেলার মাধ্যমে আমার জাতীয়ভাবে খেলোয়াড়ি জীবন শুরু হয়। ২০২৪ সালে আবাহনীর হয়ে লীগ খেলার মাধ্যমে জাতীয় পর্যায়ে খেলার সমাপ্তি হয়।
ক্রীড়াকণ্ঠ : ক্রীড়াঙ্গনে আপনার উল্লেখযোগ্য সাফল্য কী কী?
রেজাউল করিম রেজা : ক্রীড়াঙ্গনের সাফল্য বলতে ২০১০ সালে এস এ গেমস চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ। ২০১৫ সালে শেখ কামাল ইন্টারন্যাশনাল গোল্ডকাপ চ্যাম্পিয়ন চিটাগাং আবাহনীর হয়ে। এছাড়াও শেখ রাসেল, শেখ জামাল, বসুন্ধরা কিংস ও চিটাগাং আবাহনীর হয়ে প্রিমিয়ার লিগ চ্যাম্পিয়নশীপ অর্জন করি। বাংলাদেশের বিভিন্ন লীগে রানারআপ হয়েছি ৫ বার। ইন্ডিপেন্ডেন্ট কাপ চ্যাম্পিয়ন চারবার। চারটি ক্লাবের হয়ে ফেডারেশন কাপ চ্যাম্পিয়ন চারবার। সাউথ এশিয়ান বিচ ফুটবল চ্যাম্পিয়ন।এছাড়াও বাংলাদেশে ফরাশগঞ্জ স্পোর্টিং ক্লাব, মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়া চক্র, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, চিটাগাং আবাহনী, ঢাকা মোহামেডান, বসুন্ধরা কিংস ও আবাহনী ঢাকার হয়ে প্রিমিয়ার লীগ ও প্রফেশনাল ফুটবল লীগে অংশগ্রহণ করি।
ক্রীড়াকণ্ঠ : আপনার মূল্যায়নে ফরিদগঞ্জের ক্রীড়াঙ্গনে সোনালী অধ্যায় কোন্ সময়টায়?
রেজাউল করিম রেজা : ১৯৭০ থেকে ১৯৯০ দশক পর্যন্ত সময়কে বাংলাদেশের ফুটবলের সোনালী দিন হিসেবে অভিহিত করা হয়। সে সময় ফুটবল বাংলাদেশের অন্যতম বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত ছিলো। তখন স্টেডিয়ামভর্তি দর্শক ছিলো। নব্বই দশকের পর থেকে বিভিন্ন কারণে ফুটবলের কিছুটা ঐতিহ্য ম্লান হয়েছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্যে নানা সময়ে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে প্রতিভাবান খেলোয়াড় তৈরির উদ্দেশ্যে।
আমি বলবো, ফরিদগঞ্জের ক্রীড়াঙ্গনে সোনালী অধ্যায় বলতে আমি বুঝি ২০১৬ সালের আগের সময়টাকে। তখন ফরিদগঞ্জের আনাচে কানাচে যুব সমাজ খেলাধুলা নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। বিভিন্ন পাড়া মহল্লায়, ওয়ার্ড, ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ে যুব সমাজ খেলাধুলার প্রতি আসক্ত ছিলো। ওয়ার্ডভিত্তিক, ইউনিয়নভিত্তিক, উপজেলাভিত্তিক টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হতো। কতো যে আনন্দ হতো তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এমনকি এমপি কাপ ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হতো। টুর্নামেন্টে প্রতিটি ইউনিয়নের অংশগ্রহণ ছিলো বাধ্যতামূলক। স্বতঃস্ফূর্তভাবে উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে প্রত্যেকটা ইউনিয়ন অংশগ্রহণ করতো। ঐ টুর্নামেন্টে বিদেশী খেলোয়াড়ের অংশগ্রহণ ছিলো ব্যাপক। এক বছর এমপি কাপ ফুটবল টুর্নামেন্টে ৮নং পাইকপাড়া দ. ইউনিয়নের পক্ষে ১০ জন বিদেশি খেলোয়াড় খেলেছিলো। বহু দূর দূরান্ত থেকে কেউ পায়ে হেঁটে, কেউবা সাইকেলে, কেউবা রিক্সায়, আবার অনেকে বাস নিয়ে খেলা দেখতে আসতো। আমি সেই সময়টাকেই সোনালী অধ্যায় বলবো।
ক্রীড়াকণ্ঠ : ফরিদগঞ্জ থেকে আপনাদের মানের খেলোয়াড় বের করে আনতে কী কী পদক্ষেপ নিয়েছেন? সাড়া পাচ্ছেন কেমন?
রেজাউল করিম রেজা : ফরিদগঞ্জ ক্রীড়াঙ্গনে যতোটুকু অবদান আমি রাখতে চাই, ততোটুকু অবদানে যদি প্লেয়াররা এগিয়ে আসতো, তাহলে এতোদিনে আরো ভালো ফলাফল পেতাম। আগে ভালো ভালো টুর্নামেন্ট হতো, এখন ওই ধরনের বড় কোনো টুর্নামেন্ট হচ্ছে না। খুব শীঘ্রই আমরা একটু বড়ো টুর্নামেন্ট করবো ফরিদগঞ্জ ফুটবল একাডেমীর পক্ষ থেকে। আমি বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলে যেদিন থেকে খেলা শুরু করি, সেদিন থেকেই আমার একটা স্বপ্ন আমি ফরিদগঞ্জের ফুটবলের উন্নয়ন করে জাতীয় মানের খেলোয়াড় বের করে আনবো। একজন ফুটবল খেলোয়াড়ের জন্যে প্রশিক্ষণ একটি বড়ো বিষয়। কিন্তু প্রশিক্ষণের জন্যে যে ধরনের সুযোগ সুবিধা প্রয়োজন, তা ফরিদগঞ্জে এতোদিন ছিলো না। তাই ফরিদগঞ্জ উপজেলার ফুটবলের ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনা তথা তৃণমূল পর্যায় থেকে ফুটবল খেলোয়াড় তৈরির লক্ষ্যে আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে ফরিদগঞ্জ ফুটবল একাডেমি নামে একটি একাডেমি প্রতিষ্ঠা করি। একাডেমিটি প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত আনতে যাঁরা সাহায্য ও সহযোগিতা করেছেন সবাইকে ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা জানাই। আমার বিশ্বাস, এই একাডেমি থেকে আমরা ভালো কিছু ফুটবল খেলোয়াড় পাবো। একাডেমিতে সুযোগ পাওয়া বেশির ভাগ ছেলেই উঠে এসেছে প্রান্তিক পর্যায় থেকে নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে। আমি দেখছি অনেক বড়ো ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন ওদের চোখে। আশা করি এই একাডেমির খেলোয়াড়রা আগামী দিনে বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলে খেলবে। আমি সেভাবেই তাদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছি। আমার বিশ্বাস, এই একাডেমিতে প্রশিক্ষণ নেওয়া তৃণমূলের মেধাবী খেলোয়াড়রা ঢাকার বিভিন্ন ক্লাবে খেলার মাধ্যমে তাদের প্রতিভা বিকশিত করার সুযোগ পাবে। আমাদের এই একাডেমি থেকে এ পর্যন্ত ৮-১০ জন খেলোয়াড় বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্লাবে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে। চাঁদপুর স্টেডিয়ামের একজন কোচের তত্ত্বাবধানে একাডেমিতে প্রায় ৬০জনের মতো খেলোয়াড় নিয়মিত প্রশিক্ষণ নিচ্ছে।
আমাদের এই একাডেমির মূল শ্লোগান হচ্ছে ‘ক্রীড়াই শক্তি, ক্রীড়াই বল মাদক ছেড়ে মাঠে চল’। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে ফরিদগঞ্জের ফুটবলের উন্নয়নেও ভূমিকা রাখা। মাদকের হাত থেকে যুব সমাজকে রক্ষার জন্যে এই ফুটবল একাডেমি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে বিশ্বাস করি। আমাদের ফরিদগঞ্জ ফুটবল একাডেমির নতুন কোচ নিয়োগ হচ্ছে ঈদের পরপরই। আমাদের প্র্যাকটিস শুরু হচ্ছে। একটা একাডেমি কখনোই কারো একার পক্ষে চালানো সম্ভব নয়। যার যার অবস্থান থেকে ফরিদগঞ্জ ফুটবল একাডেমিকে এগিয়ে নেওয়ার অনুরোধ করছি।
ক্রীড়াকণ্ঠ : উপরোল্লিখিত প্রশ্ন সমূহের বাইরে আপনার কোনো বক্তব্য থাকলে বলতে পারেন (বিশেষ করে ফরিদগঞ্জের ক্রীড়ার উন্নয়নে পরামর্শ সহ অন্য কিছু)
রেজাউল করিম রেজা : ফরিদগঞ্জ ক্রীড়াক্ষেত্রে খুব একটা ভালো এটা বলা যাবে না। আবার অন্যান্য উপজেলার তুলনায় খুব একটা পিছিয়ে আছে সেটাও বলা যাবে না। তবে ক’টি বিষয়ে নজর দিলে ফরিদগঞ্জ উপজেলা ক্রীড়াক্ষেত্রে অনেক উন্নতি করতে পারবে বলে আমি বিশ্বাস করি--
* ফরিদগঞ্জ উপজেলা ক্রীড়া সংস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। যারা বিগত দিনে খেলাধুলার সাথে সম্পৃক্ত ছিলো তাদেরকে সংস্থার পরিচালনার দায়িত্ব দিতে হবে।
* খেলাধুলার উন্নয়ন করতে হলে ইভেন্টভিত্তিক প্রশিক্ষণের আয়োজন করতে হবে।
* বয়সভিত্তিক ফুটবল ও ক্রিকেট টুর্নামেন্টের আয়োজন করতে হবে।
* প্রতিটি ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, উপজেলা অর্থাৎ তৃণমূল পর্যায়ে উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার আয়োজনে টুর্নামেন্টের আয়োজন ও খেলোয়াড় বাছাই করে তাদেরকে প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে।
* উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার আয়োজনে ‘উপজেলা কাপ’ ফুটবল বা ক্রিকেট বা ভলিবল বা কাবাডি খেলার আয়োজন করতে হবে।
* উপজেলা পর্যায়ের ভালো খেলোয়াড়দের ঢাকার বিভিন্ন ক্লাবে খেলার সুযোগ করে দিতে হবে।
আমার বিশ্বাস, উপরোল্লিখিত কাজগুলো সম্পন্ন করতে পারলে খেলাধুলার উর্বর ভূমি ফরিদগঞ্জ একদিন সারা বাংলাদেশে খেলাধুলায় সেরা উপজেলা হিসেবে স্বীকৃতি পাবে। এক্ষেত্রে উপজেলার সর্বস্তরের জনগণকে উপজেলা ক্রীড়া সংস্থাকে সহযোগিতা করতে হবে।
ক্রীড়াকণ্ঠ : আপনার জন্ম, জন্মস্থান, পিতা-মাতা, জীবন সংগ্রাম ও পরিবার সম্পর্কে কিছু বলুন।
রেজাউল করিম রেজা : আমার জন্মস্থান ফরিদগঞ্জ। আমার বাবা ২০১২ সালে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। আলহামদুলিল্লাহ আমার মা বেঁচে আছেন। আমরা চার ভাই চার বোন। আল্লাহ আমাদের বন্ধন অটুট রেখেছেন। শোকরিয়া আল্লাহর দরবারে। আমি খুবই সাধারণ পরিবারের একটি ছেলে। সবাই আমার জন্যে এবং আমার পরিবারের জন্যে দোয়া করবেন।
চাঁদপুরের বহুল প্রচারিত পত্রিকা দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠকে ফরিদগঞ্জ ফুটবল একাডেমির পক্ষ থেকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। আমি এর আগেও চাঁদপুর কণ্ঠে সাক্ষাৎকার দিয়েছি। বিশেষ করে আমাদের একাডেমির খেলাধুলার সংবাদগুলো খুবই সুন্দরভাবে প্রচার করে। সবচেয়ে ভালো লাগার বিষয় হলো, দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ নিয়মিতভাবে শুধুমাত্র খেলাধুলার সংবাদ দিয়ে ক্রীড়াকণ্ঠ বের করে। সত্যি বলতে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা দেওয়া ছাড়া চাঁদপুর কণ্ঠকে দেওয়ার মতো কিছু নেই। ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা চাঁদপুর কণ্ঠের প্রতি।
সাক্ষাৎকার গ্রহণ : রাজন চন্দ্র দে, সাবেক ফুটবলার ও ক্রীড়া লেখক।