শনিবার, ০৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫  |   ২৮ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জে কচুক্ষেত থেকে কিশোরের মরদেহ উদ্ধার

প্রকাশ : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৬:২৮

কায়কাউসের কালো থাবা: অর্থ পাচার ও জঘন্য অপরাধের জাল

জনতার প্রশ্নের মুখে ক্ষমতা: কেন এই দুর্নীতির বিচার আজও অধরা?

অনুসন্ধানী প্রতিবেদক :মো. জাকির হোসেন
জনতার প্রশ্নের মুখে ক্ষমতা: কেন এই দুর্নীতির বিচার আজও অধরা?
ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে দীর্ঘদিন ধরেই একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে—

কেন ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতি ও অপরাধের বিচার আজও অধরা থেকে যাচ্ছে?

সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়ত অর্থনৈতিক বৈষম্য, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং আইনের শাসনের অভাবের শিকার হলেও, ক্ষমতাবানদের বিরুদ্ধে ওঠা ভয়াবহ অভিযোগগুলো থেকে যায় ধুলোবালিতে ঢাকা।

এই প্রশ্ন আরও জোরালো হয়েছে এক কায়কাউস নামের ব্যক্তিকে ঘিরে। এক সময় সাধারণ ব্যবসায়ী, পরে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় রূপ নিয়েছেন অদৃশ্য ক্ষমতার খেলোয়াড়ে।

দুর্নীতি, অর্থপাচার, ভুয়া বিনিয়োগ, জমি দখল থেকে শুরু করে হত্যার দায় এড়ানো—সবকিছুতেই তাঁর নাম উঠে এসেছে। কিন্তু বিচার? নেই কোথাও।

ঢাকার একটি অভিজাত এলাকায় আলোচিত মুনিয়া হত্যাকাণ্ডে আফ্রিদ নামের এক প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে। সেসময় কায়কাউসকে ঘিরে অভিযোগ আসে, তিনি ক্ষমতার বলয়ে থেকে এই মামলাটি ধামাচাপা দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। গণমাধ্যমে নানা প্রশ্ন উঠলেও প্রভাবশালী মহলের হস্তক্ষেপে মামলার গতি থেমে যায়। বাংলাদেশে কি বিচার কেবল গরিবের জন্য?

কায়কাউসের রাজনৈতিক উত্থান ছিল হঠাৎ। স্থানীয় পর্যায়ে সীমিত ব্যবসায় জড়িত থাকলেও অল্প কয়েক বছরের মধ্যে হয়ে ওঠেন বহুমুখী ব্যবসার মালিক। বিদ্যুৎ খাতে সরকারি প্রকল্পে ভুয়া দরপত্র ও কমিশনের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ, ব্যাংক খাতে ঋণ খেলাপি হয়েও নতুন ঋণ নেওয়া এবং রিয়েল এস্টেট সেক্টরে জোরপূর্বক জমি দখল—সবই ছিল তাঁর দাপটের অংশ। অথচ প্রশাসন ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বরাবরই ছিলেন নিশ্চুপ।

কায়কাউস একা নন। তাঁর চারপাশে গড়ে ওঠে এক শক্তিশালী সিন্ডিকেট, যেখানে থাকেন ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী মন্ত্রী, আমলা ও ব্যবসায়ী মহলের বড় খেলোয়াড়রা। আইন মন্ত্রণালয়ের প্রভাবশালীরা মামলা এড়াতে সহায়তা দেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কিছু কর্মকর্তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তাঁকে রক্ষা করেছে একাধিক অপরাধে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ভেতরের এক অংশ কায়কাউসকে কোটি কোটি টাকার ঋণ দিতে সহায়তা করেছে, যার বড় অংশ বিদেশে পাচার হয়। এ সিন্ডিকেটই ছিল তাঁর মূল শক্তি, যা ভাঙা না গেলে বিচার সম্ভব নয়।

দুদকের একাধিক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কায়কাউস এবং তাঁর সহযোগীরা নিয়মিত অর্থ পাচার করতেন দুবাই, কানাডা, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে। দুবাইয়ে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, কানাডায় ‘সেকেন্ড হোম’ সুবিধা, লন্ডনে রেস্তোরাঁ ব্যবসায় বিনিয়োগ এবং নিউইয়র্কে সম্পত্তি ক্রয়—সবই এসেছে বিদ্যুৎ প্রকল্পের ভুয়া চুক্তি, ব্যাংক ঋণ কেলেঙ্কারি ও কমিশন বাণিজ্য থেকে। অথচ এসব প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও মামলা আলোর মুখ দেখে না।

বাংলাদেশে ক্ষমতাশালীদের বিরুদ্ধে মামলা হলে সাধারণত একই ধারা অনুসৃত হয়। প্রথমে জনরোষ প্রশমনে মামলার নাটকীয় ঘোষণা, এরপর দীর্ঘসূত্রতা, তদন্তের নামে সময়ক্ষেপণ, সাক্ষীর হুমকি ও প্রমাণ গায়েব হয়ে যাওয়া। শেষপর্যায়ে মামলার চূড়ান্ত অবসান বা বেকসুর খালাস। কায়কাউসের ক্ষেত্রেও ঘটেছে তাই। আজও কোনো মামলা আদালতে টিকে নেই।

আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগের রিপোর্টে বাংলাদেশের দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের নাম এসেছে বহুবার। কায়কাউসের বিরুদ্ধেও বিদেশি গণমাধ্যম যেমন The GuardianAl Jazeera অনুসন্ধান চালালেও দেশের আদালত এখনো নির্বিকার।

দেশের ভেতরে এসব রিপোর্টকে বরাবরই “ষড়যন্ত্র” আখ্যা দিয়ে এড়িয়ে যাওয়া হয়।

বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ আজ প্রশ্ন তুলছে— কেন কায়কাউসের মতোদের বিচার হয় না? আইনের শাসন কি কেবল দুর্বলদের জন্য? অর্থপাচারকারীরা কেন বিদেশে বিলাসবহুল জীবনযাপন করবে, আর সাধারণ মানুষ ভোগ করবে দারিদ্র্য? এই প্রশ্নগুলো প্রতিদিন সোশ্যাল মিডিয়া ও জনআলোচনায় ভেসে উঠছে।

আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন করতে হবে, ক্ষমতাসীনদের অর্থপাচার মামলায় বিশেষ ট্রাইব্যুনাল চালু করা জরুরি, বিদেশে পাচার হওয়া সম্পদ ফিরিয়ে আনার জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাড়াতে হবে এবং মিডিয়ার স্বাধীনতা রক্ষা করতে হবে। কায়কাউসের মতো ক্ষমতাধর অপরাধীরা যদি বিচারের মুখোমুখি না হয়, তবে জনগণের বিচারব্যবস্থায় আস্থা আর কখনো ফিরবে না।

— ডিসিকে/এমজেডএইচ

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়