বৃহস্পতিবার, ২১ আগস্ট, ২০২৫  |   ৩২ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ২১ আগস্ট ২০২৫, ০৯:২১

চাঁদপুরের বুক থেকে উঠে আসা সুরের রাজকন্যা কণ্ঠশিল্পী নন্দিতা দাস

কবির হোসেন মিজি
চাঁদপুরের বুক থেকে উঠে আসা সুরের রাজকন্যা কণ্ঠশিল্পী নন্দিতা দাস

সংগীত এমন এক নিঃশ্বাস, যা মনকে ছুঁয়ে যায় অবলীলায়, আর সেই সুরের যাদুকরদের একজন চাঁদপুরের গর্ব, কণ্ঠশিল্পী নন্দিতা দাস। তার সংগীতযাত্রা শুরু হয়েছিল একেবারে শৈশবেই, পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে গান গেয়ে। ধীরে ধীরে নিজেকে গড়ে তোলেন তিনি। জন্ম এবং পৈত্রিক নিবাস চাঁদপুরের ঐতিহ্যবাহী হাজীগঞ্জ উপজেলায় হলেও নন্দিতা দাসের কণ্ঠের রঙ ছড়িয়েছে জেলার সীমা পেরিয়ে দেশের নানা প্রান্তের সাংস্কৃতিক মঞ্চে।

নন্দিতা দাস শুধু একজন কণ্ঠশিল্পী নন, বরং তিনি একাধারে শিল্পী, ঘরণী এবং এক সন্তানের জননী। পারিবারিক দায়িত্ব আর শিল্পী জীবনের মাঝে ভারসাম্য রেখে সাফল্যের পথে এগিয়ে চলা। তার জীবনের গল্পে আছে অধ্যবসায় আর স্বপ্নের মেলবন্ধন। দীর্ঘদিনের কঠোর পরিশ্রম আর নিয়মিত চর্চার ফলে তিনি আজ বাংলাদেশ টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত কণ্ঠশিল্পী হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন, যা নিজ জেলাসহ বৃহত্তর সংগীত অঙ্গনেও তার অবস্থানকে করেছে আরো দৃঢ় ও মর্যাদাপূর্ণ।

তিনি গেয়েছেন আধুনিক গান, ফোক, দেশাত্মবোধক গানসহ নানা ঘরানার সুরের গান। তার গানে ফুটে উঠে হৃদয়ের গভীর অনুভূতি, শ্রোতাদের জন্যে তা হয়ে উঠে নিছক বিনোদন। সংগীতের প্রতি তার ভালোবাসা, দায়বদ্ধতা এবং নিঃশর্ত বিশ্বাসই তাকে করেছে অনুপ্রেরণাদায়ী এক শিল্পী। নতুন প্রজন্মের কাছে তিনি কেবল একজন কণ্ঠশিল্পী নন, বরং প্রমাণ করেছেন যে, স্বপ্ন আর সাধনায় প্রতিকূলতাকেও জয় করা যায়।

শিল্পী নন্দিতা দাসের জীবন, স্বপ্ন আর সংগীতের প্রতি ভালোবাসা নিয়ে জানতে ‘সংস্কৃতি অঙ্গনে’ আজকের এই বিশেষ সাক্ষাৎকার। নিচে তার সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো।

সংস্কৃতি অঙ্গন : আপনার সংগীতযাত্রার শুরুটা কবে এবং কীভাবে হয়েছিলো?

নন্দিতা দাস : ২০০১ সালের দিকে। আমার ওস্তাদ নিহার রঞ্জন হালদার মিলন স্যারের হাত ধরে। তাঁর মহানুভবতা আমাকে এতো দূরে আসতে সহযোগিতা করেছে।

সংস্কৃতি অঙ্গন : ছোটবেলা থেকে সংগীতের প্রতি ভালোবাসা কীভাবে গড়ে উঠেছিলো?

নন্দিতা দাস : আমার পিসি ও আর বাবার কাছে তাদের ছোট বেলার গল্প শুনেছি। তারা স্কুলে খুব ভালো গান করতেন। অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। সে থেকে গানের প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়।

সংস্কৃতি অঙ্গন : আপনার জীবনের প্রথম মঞ্চ অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?

নন্দিতা দাস : দারুণ ছিলো। ১ম দিন দর্শক আমার গান খুব পছন্দ করেছে। অনেক আনন্দ করেছে দর্শক। মনে রাখার মতো ছিলো দিনটি।

সংস্কৃতি অঙ্গন : চাঁদপুরসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠান করার অভিজ্ঞতা থেকে কোনো স্মরণীয় ঘটনা শেয়ার করবেন কি ?

নন্দিতা দাস : একবার চট্টগ্রামে শো করতে গিয়ে ৩০ মিনিট দেরি করে যাওয়ায় এক পয়সাও সম্মানী দেয়নি, উল্টো শো শেষ করে মাঝরাতে গাড়ি থেকে নামিয়ে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে রাস্তায় একা রেখে চলে যায়। এ বিষয়ে কোতোয়ালি থানায় একটি অভিযোগও করা হয়েছিলো।

সংস্কৃতি অঙ্গন : বিটিভির তালিকাভুক্ত কণ্ঠশিল্পী হিসেবে গান গাওয়ার অভিজ্ঞতাগুলো কেমন?

নন্দিতা দাস : বেশ ভালোই। তবে শিল্পীদের সম্মানী বাড়ানো উচিত এবং শিল্পীদের মাসিক বা বার্ষিক একটা সম্মানীর ব্যবস্থা নেওয়া খুব জরুরি।

সংস্কৃতি অঙ্গন : আপনার প্রিয় গানের ধারা বা ঘরানা কোনটি?

নন্দিতা দাস : লোক সংগীত ও নজরুল সংগীত। কারণ নজরুলের গান নিয়ে প্রচুর কাজ করা যায়, আর লোক গানের সাথে মাটি ও মায়ের একটা ব্যাপার আছে।

সংস্কৃতি অঙ্গন : সংগীতের এই দীর্ঘ যাত্রায় সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জগুলো কী ছিলো?

নন্দিতা দাস : পরিবার থেকে। এর বিরুদ্ধে নিজেকে সংগীত শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করাটাই অনেক বড়ো চ্যালেঞ্জ।

সংস্কৃতি অঙ্গন : একজন নারী শিল্পী হিসেবে আপনাকে কী ধরনের বিশেষ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়?

নন্দিতা দাস : অনেক সময় পরিবারের ও সমাজের অনেক কথা শুনতে হয়েছে। এখনো হয়। নারী হয়ে রাত বিরাতে কিসের অনুষ্ঠানে যাওয়া, করতে হবে গান বাজনা? কেন করতে হবে এসব? কত সময় লোকজন চরিত্র নিয়ে বাজে বাজে মন্তব্য করেছে।

সংস্কৃতি অঙ্গন প্রতিবেদক : পরিবার, বিশেষ করে আপনার সন্তানের সাথে সময় কীভাবে ভাগ করেন?

নন্দিতা দাস : সব কিছু নিয়ে ম্যানেজ করতে কষ্ট হয়, তবে পরিবারের সহযোগিতা রয়েছে এ বিষয়ে। যতোটুকু সময় পাই সন্তানদের সাথে কাটাই।

সংস্কৃতি অঙ্গন : আপনার প্রেরণার উৎস বা সবচেয়ে প্রভাবিত শিল্পী কে?

নন্দিতা দাস : কুমার শানু। তিনি সব ছেড়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিল গানের জন্যে।

সংস্কৃতি অঙ্গন : নতুন প্রজন্মের যারা গানের জগতে আসতে চায়, তাদের জন্যে আপনার পরামর্শ কী?

নন্দিতা দাস : ধৈর্য ধরে শেখার। আর প্রচুর চর্চা করে পরিবেশনে আসার। গুরুর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে অবশ্যই।

সংস্কৃতি অঙ্গন : ভবিষ্যতে সংগীত ক্যারিয়ার নিয়ে আপনার স্বপ্ন বা পরিকল্পনা কী?

নন্দিতা দাস : পরিকল্পনা ছিলো বা ভীষণ ইচ্ছে আছে, বাংলাদেশের বাইরে আরো ১০ দেশে সংগীত শিল্পী হয়ে সংগীত পরিবেশন করার এবং সংগীতকে নিয়ে আমরণ কাজ করার।

সংস্কৃতি অঙ্গন : আপনি যদি নিজেকে এক লাইনে প্রকাশ করতে চান, কী বলতেন?

নন্দিতা দাস : একজন কণ্ঠ শ্রমিক।

সংস্কৃতি অঙ্গন : আপনার পছন্দের কোনো গান বা লাইন আছে যা আপনাকে শক্তি বা সাহস দেয়?

নন্দিতা দাস : আছে। নজরুলের এই দুটি লাইন--

আকাশের মতো বাধাহীন

মোরা মরু সঞ্চার বেদুইন।

বন্ধনহীন জন্ম স্বাধীন চিত্ত মুক্ত শতদল।

সংস্কৃতি অঙ্গন : আপনার গাওয়া কোন্ গানটি আপনার কাছে সবচেয়ে প্রিয়? কেন?

নন্দিতা দাস : জন্মে আমি ধন্য আমার জেলা চাঁদপুর। যে গান আমার চাঁদপুরকে নিয়ে। তাই আমার ভীষণ পছন্দ এই গানটি।

সংস্কৃতি অঙ্গন : চাঁদপুরের সংস্কৃতি ও সংগীতের ঐতিহ্য নিয়ে আপনার ভাবনা কী?

নন্দিতা দাস : যারা অতীতে সংগীতে চাঁদপুরকে সমৃদ্ধ করেছেন, তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা। চাঁদপুরের ঐতিহ্য লোক সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করার ইচ্ছে রয়েছে। আমি অতীতেও চাঁদপুরের ঐতিহ্য নিয়ে একটি মৌলিক গান করেছি।

সংস্কৃতি অঙ্গন : অবসর সময়ে গান ছাড়া আর কী করতে ভালো লাগে?

নন্দিতা দাস : প্রচুর ঘুরতে ভালো লাগে। আর ছবি তুলতে।

সংস্কৃতি অঙ্গন : আপনার মতে, ভালো শিল্পী হওয়ার জন্যে সবচেয়ে জরুরি গুণটি কী?

নন্দিতা দাস : ধৈর্য ও পরিশ্রম। অনেক বেশি চর্চা করার ধের্য রাখতে হবে। আর অনেক কাজ করতে হবে সংগীতকে নিয়ে।

সংস্কৃতি অঙ্গন : ভবিষ্যতে চাঁদপুর বা নিজের এলাকা নিয়ে কোনো বিশেষ প্রকল্প বা স্বপ্ন আছে?

নন্দিতা দাস : আছে, মানুষের জন্যে মানবিক কাজ করতে চাই। অসহায় মানুষের পাশে থাকতে চাই। ভালো একটা সংগীত একাডেমি খুলতে চাই। যেন চাঁদপুরকে শুদ্ধ সংগীত উপহার দিতে পারি।

সংস্কৃতি অঙ্গন : অবশেষে, আপনার ভক্ত ও শ্রোতাদের জন্যে কিছু বলতে চান?

নন্দিতা দাস : বলতে চাই ভিউ দেখে সংগীতের বিচার না করে শুনে মান বিচার করার। আর ভালো গান শোনার।শিল্পীদের সম্মান দেওয়ার জন্যে অনুরোধ করবো। কারণ শিল্পী হতে ঈশ্বরের আশীর্বাদ লাগে। সুর না থাকলে হাজার বছরের চেষ্টায় শিল্পী হওয়া সম্ভব নয়।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়