রবিবার, ১০ আগস্ট, ২০২৫  |   ৩১ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ১০ আগস্ট ২০২৫, ০৮:৩৪

আগে ছিল ঘুষখোর, পরে হলো দুর্নীতিবাজ, এখন হয়েছে চাঁদাবাজ : উন্নয়নের উল্টো পদচিহ্ন

রহমান মৃধা
আগে ছিল ঘুষখোর, পরে হলো দুর্নীতিবাজ, এখন হয়েছে চাঁদাবাজ : উন্নয়নের উল্টো পদচিহ্ন

বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের গল্প আজকাল পত্রিকার পাতায়, টেলিভিশনের ঘোষণায় কিংবা নেতার মুখে মুখে শোনা যায় “দেশ বদলে গেছে”, “উন্নয়ন দৃশ্যমান”, “স্বপ্নের পদ্মা সেতু হয়েছে”, “ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তব”। কথাগুলো শুনতে যেমন চমকপ্রদ, বাস্তবে তেমনই একটা নির্মম প্রশ্নও উঁকি দেয়Ñএই উন্নয়নের সুবিধাভোগী কারা? এবং উন্নয়ন বলতে আমরা কি কেবল ভবন, সেতু, কিংবা এউচ বুঝি, নাকি মানুষ ও মনুষ্যত্বেরও কোনো মানদণ্ড আছে?

একসময় যাদের আমরা বলতাম ঘুষখোর, তারা ছিলো লোকচক্ষুর আড়ালে; একটা টেবিলের নিচে টাকার খাম গলিয়ে দিতো, লজ্জা একটু ছিলো, ভয়ও ছিলো আইনের। তারপর তারা হলো দুর্নীতিবাজ পদে বসে ক্ষমতার খোলস গায়ে দিয়ে টেন্ডার ভাগাভাগি, ব্যাংক লোন লুট, প্রজেক্ট বাজেট ফাঁকি সবই নীতির নামে বৈধ করে ফেললো। এখন তারা চাঁদাবাজ, যারা আর লুকায় না, প্রকাশ্যেই বলে “এক্সট্রা দিতে হবে ভাই, নাহলে কাজ হবে না।” এটা শুধু দুর্নীতির বিবর্তন নয়, এটা একটা জাতির বিবেক হারানোর ইতিহাস।

বাংলাদেশের সংবিধানে লেখা আছে “রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব হবে জনগণের কল্যাণ সাধন।” কিন্তু বাস্তবে রাষ্ট্র যেন এক সিন্ডিকেট চালিত পণ্যবাজার যেখানে প্রশাসন, পুলিশ, রাজনীতি, ব্যবসা এমনকি বিচারব্যবস্থাও অনেক ক্ষেত্রে একটি জালায় বাঁধা, যার মধ্যে সৎ থাকতে গেলে ডুবে যেতে হয়। ১৯৭১-এর যুদ্ধ ছিলো একটি মুক্তির স্বপ্ন। তখন সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ পদ ছিলো মেজর জেনারেল, সীমিত শক্তি, সীমিত সুযোগ, কিন্তু ছিলো একরকম দেশপ্রেম। সময়ের সাথে সাথে যখন পদোন্নতি হলো লেফটেন্যান্ট জেনারেল, তারপর জেনারেল তখন কি শুধু দপ্তর বড়ো হলো, নাকি লোভও বড়ো হলো? একদিকে জিপি লাইন, পাজেরো, প্রটোকল, অন্যদিকে গরিব রিকশাচালক, অসুস্থ কৃষক, চাকরির জন্যে হাহাকার করা তরুণ। উন্নয়নের তুলাদণ্ড কি দু পাশে সমান ভার বহন করেছে?

রাষ্ট্র যখন নাগরিকের ভরণপোষণের দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হয়, তখন নাগরিক হয় নিঃস্ব অথবা বিক্রি হয়ে যায়। আজকের যুবক চাকরির আশায় ঘুষ দেয়, শিক্ষকতা পেতে ঘুষ দেয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য হতে ঘুষ দেয়। তারপর যখন সে চাকরিটা পায়, তখন প্রথম কাজ হয় সেই ঘুষের টাকা সুদে আসলে তুলতে হবে ঘুষ খেতে হবে, চাঁদা তুলতে হবে, মানুষকে জিম্মি করতে হবে। এভাবে দুর্নীতি একটা চাকরির অনুষঙ্গ হয়ে যায়, আর চাঁদাবাজি হয়ে যায় নৈতিকতার পরিণতি।

যে রাষ্ট্রের হাসপাতাল অচল, শিক্ষাব্যবস্থা লুটেরাদের হাতে, বিচারব্যবস্থা পক্ষপাতদুষ্ট, গণমাধ্যম ভীত, সেই রাষ্ট্র কিসের উন্নয়ন দেখাচ্ছে? রাষ্ট্র যদি মানুষকে সুশিক্ষা, সুবিচার এবং নিরাপদ জীবন দিতে না পারে, তাহলে সেটা কেবল একটি ক্ষমতার যন্ত্র যা দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর, আর চাঁদাবাজদের জন্যে অপারেশনাল।

একটা সময় ছিলোÑস্কুলের দেওয়ালে লেখা থাকতো, “জ্ঞানই শক্তি”, কিংবা “কৃষিই জাতির মেরুদণ্ড”। কিন্তু আজকে এই কথাগুলো কেবল দেয়ালে রয়ে গেছে, বাস্তবতায় তারা মুছে গেছে। বরং এখন যেন রাষ্ট্রের অদৃশ্য সংবিধান হচ্ছেÑ“ঘুষ দাও, চাঁদা দাও, অন্যথায় তোমার অস্তিত্ব থাকবে না।”

আমরা যে প্রজন্ম তৈরি করছি, তারা চোখ থাকতেও অন্ধ। একদিকে প্রশ্নপত্র ফাঁস, অন্যদিকে স্কুলশিক্ষকের গায়ে হাত তোলাÑএই সবই একই সমাজের চিত্র। আজকের শিক্ষা ব্যবস্থায় নেই নৈতিকতা, নেই চিন্তার স্বাধীনতা, নেই কর্মমুখী দিকনির্দেশনা।

বিশ্ববিদ্যালয় এখন দলীয় অফিসে রূপ নিয়েছে, আর ছাত্ররাজনীতি মানে অস্ত্র, দখল আর ভয় দেখানো। শিক্ষক হয়ে উঠেছেন শোষণ ও নিয়ন্ত্রণের যন্ত্র, আর ছাত্র হয়ে উঠেছে ক্ষমতাবানের ভবিষ্যৎ বাহিনী।

জেনে হোক কিংবা না জেনে, আমরা গড়ে তুলছি এক নিষ্প্রভ, মেধাহীন ও চাটুকার প্রজন্মÑযাদের হাতে তুলে দিচ্ছি প্রশ্নফাঁস, গাইড বই, কোচিং নির্ভরতা, ঘুষ দিয়ে পাওয়া নিয়োগপত্র, আর ক্যাম্পাসজুড়ে দলীয় ক্যাডারতন্ত্র।

যে শিক্ষার হাত ধরে জাতি গড়ার কথা ছিলো, সেই শিক্ষাই আজ জাতি ভাঙার কারখানায় পরিণত হয়েছে।

আমরা মুখে সৃজনশীলতার কথা বলি, অথচ পাঠ্যবই মুখস্থ ছাড়া পাসের সুযোগ নেই। আমরা নৈতিকতার কথা বলি, অথচ শিক্ষকের চাকরি হয় টাকার বিনিময়ে।

যেখানে শিক্ষকই ঘুষ দিয়ে আসেন শ্রেণিকক্ষে, সেখানে ছাত্র কেন শিখবে সততার পাঠ?

আর যখন রাষ্ট্র নিজেই শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে ‘তেল মন্ত্রণালয়’তে রূপ দেয়, তখন তরুণ প্রজন্মের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে যাওয়াটাই তো স্বাভাবিক।

আমরা দেশজ উৎপাদনের চেয়ে আমদানিকে বড়ো করে তুলেছি। কৃষক যখন মাঠে ফসল পচিয়ে ফেলে দেয়, তখনই বাজারে ঢুকে পড়ে বিদেশি চাল, ডাল, পেঁয়াজ। কৃষকের পাশে দাঁড়ায় না কেউ না সরকার, না মিডিয়া, না ব্যাংক। ঘুষ দিয়ে তাকে কিনতে হয় সেচের পানি, দালালের কাছ থেকে নিতে হয় সরকারি বীজ-সার। আর সে ফসল যখন ফলায়, তখন বাজারে দাম থাকে না।

শিল্পখাতের চিত্র আরও করুণ। একের পর এক কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, দক্ষ জনশক্তি পাড়ি জমাচ্ছে বিদেশে দেশে রয়ে যাচ্ছে শুধু অব্যবস্থা আর আমলাতন্ত্রের জঞ্জাল। আমরা এখন একটা ‘ভোগী জাতি’Ñনিজে কিছু উৎপাদন না করেই শুধু ভোগ করতে চাই। চীন, ভারত কিংবা তুরস্কের ওপর নির্ভর করেই চলছে আমাদের অর্থনীতি। অথচ সরকার বলে “আমরা মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছেছি।” প্রশ্ন হলো এই উন্নয়ন কার জন্যে? যেখানে গার্মেন্টস শ্রমিক ১২ ঘণ্টা খেটে ১২ হাজার টাকা পায়, আর এক প্রকল্প পরিচালক ১ কোটি টাকায় গাড়ি কেনে সেটি কি উন্নয়ন, নাকি লুণ্ঠনের ছদ্মবেশ?

সবচেয়ে ভয়াবহ চিত্র যুবসমাজে। তারা শিক্ষিত হচ্ছে, কিন্তু কর্মসংস্থান পাচ্ছে না। মেধাবী যুবক যখন মাসের পর মাস, বছরের পর বছর বেকার থাকে, তখন একসময় সে বাধ্য হয় বিকল্প খুঁজতে আর সেই বিকল্পের নাম হয় ‘যুবলীগ’ বা ‘যুবদল’। সেখানে চাকরি নেই, কিন্তু পিস্তল আছে; বেতন নেই, কিন্তু চাঁদা আছে; ভবিষ্যৎ নেই, কিন্তু মাদক আছে। রাষ্ট্র তার সবচেয়ে সম্ভাবনাময় শক্তি তরুণ সমাজকে নিজেই অস্ত্র তুলে দিচ্ছে, গডফাদারদের ছত্রছায়ায় গড়ে তুলছে একেকটি সন্ত্রাসী ইউনিট।

আজকের ছাত্র রাজনীতি মানেই চাঁদাবাজি, নিয়োগ বাণিজ্য, টিকটকে ‘লাইভ মারামারি’। একজন তরুণ যখন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করেও তিন বছর ধরে চাকরি খুঁজে পায় না, তখন তার স্বপ্ন আর কৃষি, স্টার্টআপ, প্রযুক্তি কিংবা শিল্পের দিকে যায় নাÑগিয়ে পড়ে রাজনৈতিক ছত্রছায়ার বন্দুকের নিচে।

রাষ্ট্র যখন তার যুবসমাজকে স্বপ্ন না দিয়ে অস্ত্র দেয়, তখন সে রাষ্ট্র কেবল মেরুদণ্ডহীনই হয় না সে আত্মঘাতী হয়ে উঠে।

গণতন্ত্রে বলা হয়, ‘মানুষই মালিক।’ কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতায় সাধারণ মানুষ যেন কেবল ভোটের দিনই মানুষ, তারপর সে হয়ে যায় এক নির্বাক, অধিকারহীন ভিখারি। রাস্তা বানানো হয় ভিআইপি’র জন্যে, হাসপাতালের উন্নয়ন হয় বিশেষ গোষ্ঠীর জন্যে, আর নীতি নির্ধারিত হয় কর্পোরেট ক্লাবের কাচঘেরা কক্ষে বসে। কৃষক, শ্রমিক, প্রবাসী শ্রমজীবী তারা যেন কেবল উন্নয়নের ভাষণকে অলংকৃত করার জন্যে ব্যবহৃত হয়, কিন্তু নীতির কেন্দ্রে নয়।

প্রশ্নটা বারবার ফিরে আসে এই রাষ্ট্রটা কার? যাদের ঘামে পথ তৈরি হয়, গায়ে রোদ লাগে, তারাই কি এই রাষ্ট্রের মালিক? না কি তারা, যাদের টাকা সুইস ব্যাংকে, সন্তান বিদেশে পড়ে, বছরে একবার দেশে আসে, আর টকশোতে দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে?

রাষ্ট্র হওয়া উচিত সেই মানুষের, যিনি অন্যের ঘর তৈরি করতে গিয়ে নিজের ঘর বানাতে পারেন না। রাষ্ট্র হওয়া উচিত সেই শিক্ষকের, যিনি ছাত্রকে স্বপ্ন দেখান অথচ বেতন পান দেরিতে। রাষ্ট্রের কাজ হলো অসম্ভবকে সম্ভব করা, প্রতিভাকে জায়গা করে দেওয়া, শ্রমিকের ঘামে মাথা উঁচু করা। কিন্তু আজ রাষ্ট্র বন্দি ধনীদের হাতে, ক্ষমতাবানদের শিকলে। আর যারা রাষ্ট্র চালায়, তারা মানুষকে দেখে ভোটের সংখ্যা হিসেবে, হৃদয়ের সত্তা হিসেবে নয়।

এই প্রশ্ন আজ আমাদের সামনে দাঁড় করিয়েছে আমরা কাদের জন্য রাষ্ট্র গড়ছি? এমন এক রাষ্ট্র, যেখানে ঘুষ ছাড়া চাকরি হয় না, হাসপাতালে সেবা নয় বরং রাজনৈতিক সভার জন্যে স্টেজ বানানো জরুরি, যেখানে মেধার চেয়ে পরিচয়, সততার চেয়ে সদস্যপদ বেশি কার্যকর। সেই রাষ্ট্রের কোনো গর্ব থাকতে পারে না।

কেন এক সৎ শিক্ষক হতাশ হয়ে আত্মহত্যা করেন, আর এক চাঁদাবাজ যুবক জনপ্রতিনিধি হয়ে উঠে? কেন উন্নয়ন মানেই হয় ভবন, রাস্তা, ব্যানার আর বিজ্ঞাপনÑকিন্তু সেই উন্নয়নে থাকে না সাধারণ মানুষের স্বপ্ন, কান্না, জীবন?

আমরা চাই এমন এক রাষ্ট্র, যেখানে শিক্ষক হবেন জাতির শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি, যুবক হবে হিরো, কৃষক হবে গর্বের প্রতীক। যেখানে পুলিশ হবে মানুষের রক্ষক, কোনো দলের নয়। বিশ্ববিদ্যালয় হবে আলোর মিনার, যেখানে ছড়াবে জ্ঞানের শক্তি, মাদকের ভয় নয়।

এখন সময় প্রশ্ন তোলার। এখন সময় ‘না’ বলার।

না ঘুষকে,

না দুর্নীতিকে,

না চাঁদাবাজিকে।

রাষ্ট্র যদি মানুষের না হয়Ñতবে মানুষকেই রাষ্ট্র হয়ে উঠতে হবে।

আসুন, আমরা ভণ্ড মুখোশটা সরাই। জিডিপি নয়, আমরা বিচার করি মানুষ হাসছে কি না। যদি মানুষ না থাকে, তাহলে উন্নয়ন কিসের জন্যে?

আজ দুর্নীতি আর অপরাধ নয়, সামাজিক দক্ষতা হয়ে উঠেছে। সৎ মানুষকে আমরা বলি বোকা, নির্লজ্জ, চাঁদাবাজকে বলি স্মার্ট। এই মানসিকতা না বদলালে ‘উন্নয়ন’ কেবল কাগজে থাকবে মানুষের জীবনে আসবে না।

আজ প্রয়োজন একটি নৈতিক মুক্তিযুদ্ধএকটি সাহসী, সৎ ও গণমুখী সংগ্রাম, যেখানে চাঁদাবাজিকে ঘৃণা করা হবে, ঘুষখোরদের জনতার কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে, আর রাষ্ট্র একদিন সাহস করে নিজের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বলবে

“জনগণ রাষ্ট্রের কর্মচারীদের সেবক নয়, বরং কর্মচারীরাই জনগণের সেবক; এটাই একটি মানবিক, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সত্যিকার আত্মা।”

যদি প্রতিজ্ঞা করি আমি আবার জনগণের রাষ্ট্র হতে চাই। আমরা কি প্রস্তুত সেই প্রতিশ্রুতি পালন করতে?

রহমান মৃধা : সুইডেন প্রবাসী বাংলাদেশি গবেষক, লেখক; সাবেক পরিচালক, ফাইজার

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়