শনিবার, ৩১ মে, ২০২৫  |   ২৬ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য
ব্রেকিং নিউজ
  •   ঢাকা থেকে উড্ডয়নের পরপরই তার্কিশ এয়ারলাইন্সের ইঞ্জিনে আগুন

প্রকাশ : ২৯ মে ২০২৫, ০৯:০১

ত্যাগের মহিমায় কুরবানী

মুহা. আবু বকর বিন ফারুক
ত্যাগের মহিমায় কুরবানী

ইসলামে কুরবানী একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত যা ত্যাগ, আনুগত্য, তাকওয়া এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির প্রতীক। এটি এমন একটি ইবাদত, যার মাধ্যমে একজন মুসলমান তাঁর প্রিয় বস্তু ত্যাগের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের চেষ্টা করে। কুরবানী শুধু পশু জবাইয়ের আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং এর অন্তর্নিহিত অর্থ হলো আত্মত্যাগ, আল্লাহর হুকুমের প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য এবং মানবিক মূল্যবোধের চর্চা।

কুরআনে কুরবানীর ভিত্তি

আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘নিশ্চয় আমি তোমাকে কাউসার দান করেছি। সুতরাং তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় কর এবং কুরবানী করো। (সূরা কাউসার : ১-২)।

এই আয়াতে স্পষ্টভাবে সালাত ও কুরবানীর সংযুক্তি করে বলা হয়েছে, কুরবানী একটি ইবাদত যা একজন মুমিনকে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করতে সাহায্য করে।

আরেক আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘তাদের গোস্ত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, বরং পৌঁছে তাঁর প্রতি তোমাদের তাকওয়া’। (সূরা হজ : ৩৭)।

এখানে বোঝানো হয়েছে, কুরবানীর বাহ্যিক রূপ নয় বরং অন্তরের নিঃস্বার্থতা ও তাকওয়া-ই মূল বিষয়। আমাদের ত্যাগ, আন্তরিকতা ও আল্লাহর জন্য সবকিছু উৎসর্গ করার মানসিকতাই আল্লাহর কাছে মূল্যবান।

কুরবানীর ইতিহাস : ইব্রাহীম (আ.) ও ইসমাঈল (আ.)-এর ত্যাগ

কুরবানীর প্রকৃত ইতিহাস শুরু হয় হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর ঘটনাকে কেন্দ্র করে। তিনি স্বপ্নে আল্লাহর পক্ষ থেকে আদিষ্ট হন তাঁর একমাত্র পুত্র ইসমাঈল (আ.)-কে কুরবানী করার জন্য। পুত্রকে এই কথা জানালে, ইসমাঈল (আ.) বলেন, ‘হে আমার পিতা! আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন, তা করুন। ইনশাআল্লাহ, আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের একজন হিসেবে পাবেন’। (সূরা সাফফাত : ১০২)।

এই ঘটনা ইসলামের ইতিহাসে ত্যাগ ও আনুগত্যের সবচেয়ে বড় নিদর্শন। আল্লাহর নির্দেশে ইব্রাহীম (আ.) তাঁর সবচেয়ে প্রিয় সম্পদÑনিজের পুত্রকেও কুরবানী করতে প্রস্তুত হয়েছিলেন। আর আল্লাহ তাদের এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ করে ইসমাঈলের পরিবর্তে একটি দুম্বা পাঠালেন এবং কুরআনে ঘোষণা করলেন : ‘আমি তাঁর পরিবর্তে একটি মহান কুরবানীর ব্যবস্থা করলাম’। (সূরা সাফফাত : ১০৭)।

এই ঘটনাকে স্মরণ করে আজও বিশ্বব্যাপী মুসলিমরা জিলহজ মাসের ১০-১২ তারিখ পশু কুরবানী করে থাকেন। মূলত এটি একটি প্রতীকী ইবাদত যা আমাদের মনে করিয়ে দেয়— আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর আদেশই সর্বোচ্চ, আর আমরা তাঁর জন্য সব কিছু ত্যাগ করতে প্রস্তুত।

হাদীসের আলোকে কুরবানীর ফজিলত

রাসূলুল্লাহ (সা.) কুরবানীর গুরুত্ব বর্ণনা করে বলেন, ‘আদম সন্তান কুরবানীর দিন যে আমল করে, তার মধ্যে আল্লাহর কাছে কুরবানী অপেক্ষা প্রিয় আর কোনো কাজ নেই। কুরবানী কিয়ামতের দিন তার শিং, রোম ও খুরসহ হাজির হবে। কুরবানীর রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই তা আল্লাহর কাছে পৌঁছে যায়। তাই খুশি মনে কুরবানী করো’। (তিরমিযী : ১৪৯৩)।

এই হাদীসের মাধ্যমে বোঝা যায়, কুরবানী শুধু একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং এটি আল্লাহর কাছে অত্যন্ত প্রিয় একটি ইবাদত যা দ্রুত কবুল হয়।

একটি অন্য হাদীসে এসেছে : ‘যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানী করে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে’। (ইবনে মাজাহ : ৩১২৩)।

এটি কুরবানীর গুরুত্ব বোঝাতে যথেষ্ট। যারা আল্লাহর দেওয়া নেয়ামতের কৃতজ্ঞতা স্বরূপ সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানী করে না, তারা রাসূলের (সা.) সুন্নাত থেকে বঞ্চিত হয়।

কুরবানীর আধ্যাত্মিক শিক্ষা

১. আত্মত্যাগ ও আনুগত্য : কুরবানী আমাদের শেখায়, জীবনভর আল্লাহর প্রতি আমাদের পূর্ণ আনুগত্য থাকা উচিত। ইব্রাহীম (আ.) যেভাবে নিজের প্রিয় সন্তানকে আল্লাহর আদেশে কুরবানী করতে প্রস্তুত হয়েছিলেন, সেভাবে আমাদেরও প্রয়োজনে নিজের স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে আল্লাহর হুকুম মেনে চলা উচিত।

তাকওয়া ও খালিস নিয়ত : কুরবানী যেন লোক দেখানো না হয়। একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই তা করা উচিত। আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না পশুর মাংস বা রক্ত, পৌঁছায় কেবল তাকওয়া।

মানবিকতা ও সহানুভূতি : কুরবানীর গোশত আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী, দরিদ্র ও মিসকিনদের মাঝে বিলিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে আমরা সামাজিক দায়বদ্ধতা পূরণ করি এবং একটি মানবিক সমাজ গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখি।

ভোগবাদ বিরোধী চেতনা : কুরবানী আমাদের শেখায় ভোগবাদ থেকে বেরিয়ে এসে ত্যাগ ও সংযমে জীবন গড়তে। প্রতিনিয়ত আমরা যেন শুধু ভোগের পেছনে না ছুটি, বরং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজের পছন্দের কিছু ত্যাগ করতেও যেন প্রস্তুত থাকি।

কুরবানী আমাদের জীবনে বাস্তব প্রয়োগ

আজকের সমাজে কুরবানীর প্রকৃত তাৎপর্য অনেকটাই পশু জবাইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। আমরা মাংস খাওয়ার উৎসবকে বড় করে দেখি, কিন্তু আত্মত্যাগ, খালিস নিয়ত ও আল্লাহর আদেশ পালনÑএই মূল উদ্দেশ্য থেকে অনেক সময় দূরে সরে যাই। তাই, কুরবানীর মর্ম বুঝে আমাদের উচিত এই ইবাদতের মাধ্যমে জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলার প্রতিজ্ঞা করা। যে ব্যক্তি নিজের অহংকার, লোভ, হিংসা, হঠকারিতা, আত্মকেন্দ্রিকতা ইত্যাদি খারাপ গুণগুলো কুরবানী করতে পারে, সে-ই প্রকৃত কুররবানীকার।

পরিশেষে বলবো, কুরবানী ইসলামের এক মহান ইবাদত, যা আমাদের শিক্ষা দেয় কীভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য প্রিয় জিনিস ত্যাগ করতে হয়। ইব্রাহীম (আ.) ও ইসমাঈল (আ.)-এর মহান আত্মত্যাগ আমাদের জন্য আদর্শ। আমরা যদি কুরবানীর প্রকৃত শিক্ষা হৃদয়ে ধারণ করি, তাহলে কেবল ঈদের ক’দিন নয়, বরং সারাবছরই আমাদের জীবন হয়ে উঠবে তাকওয়া, ত্যাগ ও আল্লাহর আনুগত্যে ভরপুর।

আসুন, এবারের কুরবানীতে আমরা শুধু পশু নয়, আমাদের অন্তরের সকল খারাপ প্রবৃত্তি কুরবানী করি। আত্নত্যাগের এই মহান শিক্ষাকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন করিÑতবেই হবে আমাদের কুরবানী কবুল ও অর্থবহ।

মুহা. আবু বকর বিন ফারুক : বিষ্ণুপুর মনোহরখাদী মদিনা বাজার বাইতুল আমিন জামে মসজিদ, চাঁদপুর সদর, চাঁদপুর।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়