বৃহস্পতিবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫  |   ২৯ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৯:২৩

এআই-চালিত গুজব : বাংলাদেশের নতুন সংকট ও জনসচেতনতার চ্যালেঞ্জ

তথ্য-প্রযুক্তি কণ্ঠ ডেস্ক
এআই-চালিত গুজব : বাংলাদেশের নতুন সংকট ও জনসচেতনতার চ্যালেঞ্জ

এক সময় গুজব ছড়াতো মুখে মুখে, চায়ের দোকানে, কিংবা পাড়ার মোড়ে। এখন তা ছড়ায় সেকেন্ডের মধ্যে--একটি ক্লিকেই। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তির অপব্যবহার করে গুজব ছড়ানোর প্রবণতা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, ধর্মীয় সংবেদনশীলতা, স্বাস্থ্য সংকট কিংবা সামাজিক উত্তেজনা—সব ক্ষেত্রেই এআই-চালিত বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে পড়ছে, যা জনমনে বিভ্রান্তি, আতঙ্ক এবং বিভাজন সৃষ্টি করছে।

এই ফিচারটি সেই সংকটের গভীরে প্রবেশ করে দেখবে কীভাবে এআই গুজব ছড়ানোর হাতিয়ার হয়ে উঠেছে, কেন এটি এত ভয়ংকর এবং কীভাবে আমরা সচেতনতা ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান দিয়ে এই সংকট মোকাবিলা করতে পারি।

এআই কীভাবে গুজব ছড়ায়?

এআই নিজে গুজব ছড়ায় না—মানুষই তাকে ব্যবহার করে। তবে এআই-এর ক্ষমতা এতটাই বিস্তৃত যে একে ব্যবহার করে নিমিষেই তৈরি করা যায় :

ভুয়া ভিডিও (Deepfake) : যেখানে কোনো ব্যক্তিকে এমনভাবে দেখানো হয় যেন তিনি এমন কিছু বলছেন বা করছেন যা বাস্তবে ঘটেনি।

ভুয়া ছবি : এআই দিয়ে তৈরি করা যায় এমন ছবি, যা বাস্তবের মতোই দেখায়, কিন্তু সম্পূর্ণ মিথ্যা।

স্বয়ংক্রিয়ভাবে লেখা গুজবপূর্ণ পোস্ট : এআই দিয়ে লেখা হয় এমন বার্তা যা বিশ্বাসযোগ্য, আবেগঘন এবং বিভ্রান্তিকর।

বট অ্যাকাউন্ট : হাজার হাজার স্বয়ংক্রিয় অ্যাকাউন্ট একই গুজব ছড়িয়ে দেয়, যেন তা 'জনমত'।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এআই-গুজবের উদাহরণ

বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে কিছু ঘটনা এআই-চালিত গুজবের ভয়াবহতা তুলে ধরা হলো :

নির্বাচনপূর্ব সময় : Deepfake ভিডিওতে নেতার বক্তব্য বিকৃত, যা রাজনৈতিক উত্তেজনা, সহিংসতা ছড়িয়ে দেয়।

কোভিড-১৯ : এ সময় এআই-লিখিত ভুয়া চিকিৎসা পরামর্শ। যা স্বাস্থ্য ঝুঁকি, চিকিৎসা বিভ্রান্তি তৈরি করে।

ধর্মীয় ইস্যু : ভুয়া ছবি ও ভিডিও ছড়িয়ে উত্তেজনা ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতা তৈরি করা হয়েছে।

সেলিব্রিটি মৃত্যু : এআই-লিখিত ভুয়া সংবাদ প্রচার করে জনমনে আতঙ্ক, সামাজিক বিভ্রান্তি তৈরি করা হচ্ছে।

কেন এআই-চালিত গুজব এতো ভয়ংকর?

১. বিশ্বাসযোগ্যতা : এআই দিয়ে তৈরি করা ছবি, ভিডিও বা লেখা এতোটাই নিখুঁত হয় যে, সাধারণ মানুষ সহজে বুঝতে পারে না তা ভুয়া।

২. গতি ও বিস্তার : সোশ্যাল মিডিয়ায় একবার পোস্ট হলে তা মুহূর্তেই হাজার হাজার মানুষের কাছে পৌঁছে যায়।

৩. আবেগের ব্যবহার : এআই-লিখিত গুজবগুলো এমনভাবে লেখা হয়, যাতে মানুষের আবেগ জাগে—ভয়, রাগ, দুঃখ—যা গুজবকে আরও ছড়িয়ে দেয়।

৪. চিন্তার বিভ্রান্তি : মানুষ যখন বারবার একই গুজব দেখে, তখন তারা সেটিকে সত্য বলে ধরে নেয়।

সোশ্যাল মিডিয়া : গুজবের প্রধান বাহক

বাংলাদেশে ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক এবং হোয়াটসঅ্যাপের মতো প্ল্যাটফর্মে এআই-চালিত গুজব ছড়ানোর হার সবচেয়ে বেশি। কিছু সাধারণ কৌশল :

- 'ব্রেকিং নিউজ' শিরোনামে ভুয়া ভিডিও পোস্ট

- ধর্মীয় বা রাজনৈতিক ইস্যুতে আবেগঘন বার্তা

- জনপ্রিয় ব্যক্তির ছবি বা নাম ব্যবহার করে বিভ্রান্তি

কীভাবে সচেতন হওয়া যায়?

এআই-চালিত গুজব মোকাবিলায় জনসচেতনতা সবচেয়ে বড়ো অস্ত্র। নিচে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দেওয়া হলো :

যাচাই করুন

- কোনো তথ্য দেখলেই বিশ্বাস করবেন না।

- 'Fact-checking' ওয়েবসাইট ব্যবহার করুন (যেমন : BD FactCheck, Rumor Scanner Bangladesh)।

উৎস দেখুন

- পোস্টটি কে করেছে? তার পরিচয় কী?

- কোনো বিশ্বাসযোগ্য সংবাদমাধ্যমে খবরটি এসেছে কি না?

ছবি ও ভিডিও যাচাই করুন

- Google Reverse Image Search ব্যবহার করে ছবির উৎস খুঁজে বের করুন।

- ভিডিওর অডিও ও ভিজ্যুয়াল মিলিয়ে দেখুন—কোনো অস্বাভাবিকতা আছে কি না।

আবেগের ফাঁদে পড়বেন না

- কোনো বার্তা যদি খুব আবেগঘন হয়, তাহলে সেটি যাচাই না করে শেয়ার করবেন না।

প্রযুক্তি জানুন

- এআই কীভাবে কাজ করে, Deepfake কী, GPT কী—এসব বিষয়ে সাধারণ জ্ঞান রাখুন।

শিক্ষার ভূমিকা

বাংলাদেশে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে 'ডিজিটাল লিটারেসি' শিক্ষা জরুরি। শিক্ষার্থীদের শেখাতে হবে :

- তথ্য যাচাইয়ের কৌশল

- সোশ্যাল মিডিয়ার নিরাপদ ব্যবহার

- প্রযুক্তির নৈতিক ব্যবহার

সরকারের করণীয়

বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে, যেমন :

- ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন

- গুজব শনাক্তে সেল গঠন

তবে আরও কিছু পদক্ষেপ প্রয়োজন :

- এআই-চালিত গুজব শনাক্তে প্রযুক্তিগত টুলস তৈরি

- সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানিগুলোর সঙ্গে সমন্বয়

- জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ক্যাম্পেইন

মিডিয়া ও সৃজনশীলদের ভূমিকা

সমাজের মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, কর্মী, সংবাদিক, গল্পকার, সম্পাদক, লেখক এবং ভিজ্যুয়াল নির্মাতারা এই সংকটে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন :

- ‍ গল্প, কবিতা, নাটকে গুজবের বিপদ তুলে ধরা

- ভিডিও ও পোস্টারে সচেতনতা বার্তা

- সংবাদ ও ফিচারে তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণ

সৃজনশীল মানুষরা যদি মানুষের সঠিক চিন্তা জাগাতে পারে, তবে এআই-চালিত বিভ্রান্তির বিরুদ্ধে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিরোধ হতে পারে।

পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশে এআই-চালিত গুজব এখন আর শুধু প্রযুক্তিগত সমস্যা নয়—এটি সামাজিক, রাজনৈতিক এবং নৈতিক সংকট। এই সংকট মোকাবেলায় প্রয়োজন সচেতনতা, শিক্ষা, প্রযুক্তি এবং সৃজনশীলতার সম্মিলিত প্রয়াস।

আমরা যদি এখনই সচেতন না হই, তাহলে ভবিষ্যতের সমাজ হবে বিভ্রান্তির, ভয়ের এবং অবিশ্বাসের। কিন্তু যদি আমরা তথ্যের আলোয় এগিয়ে যাই, তাহলে প্রযুক্তির অন্ধকারকে জয় করা সম্ভব।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়