সোমবার, ১৬ জুন, ২০২৫  |   ৩১ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ১৬ জুন ২০২৫, ০৯:০৬

স্বাস্থ্যের প্রয়োজনে হাঁটাহাঁটি : কখন ও কতক্ষণ

ডা. পীযূষ কান্তি বড়ুয়া
স্বাস্থ্যের প্রয়োজনে হাঁটাহাঁটি : কখন ও কতক্ষণ

ব্যস্ত নাগরিক ও যান্ত্রিক জীবনে ফুরসৎ যাদের একদমই মেলে না, কিংবা যাদের শারিরীক পরিশ্রমের সিযোগ মোটেই হয় না, তাদের জন্যে নিয়মিত হাঁটা একটা ভালো ব্যায়াম। শরীর সুস্থ রাখতে হলে আপনাকে নিয়মিত হাঁটতে হবে। হাঁটলে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গে বিশেষত দিনের নিম্নাঙ্গে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পায়। হাঁটার কারণে দেহে মেদ সঞ্চিত হতে পারে না এবং দেহ অনাকাক্সিক্ষত স্থূলতা হতে রেহাই পায়। কর্মব্যস্ত দিনে সময় করে একটু হলেও হাঁটা দেহের জন্যে অত্যন্ত উপকারী।

হাঁটার উপকার

* হাঁটার মাধ্যমে দেহের অতিরিক্ত ক্যালরি খরচ হয়ে যায়। ফলে দেহে ক্যালরি সঞ্চয়জনিত কারণে স্থূলতা জমতে পারে না।

* হাঁটার কারণে রক্তের অতিরিক্ত গ্লুকোজ ব্যবহৃত হয়ে যায় এবং রক্ত-শর্করার মান নিয়ন্ত্রিত থাকে। ফলে টাইপ-২ জনিত ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে না।

* যাদের ডায়াবেটিস আছে তাদের ক্ষেত্রে হাঁটার কারণে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা সুনিয়ন্ত্রিত অবস্থায় বজায় থাকে।

* যাদের রক্তে থ্রম্বোএম্বোলিজম বা রক্তে দলা পাকানোর আশঙ্কা থাকে তাদের ক্ষেত্রে নিয়মিত হাঁটলে সে আশঙ্কা দূর হয়ে যায়।

* হাঁটার কারণে পায়ের পেশির সক্রিয়তা বৃদ্ধি পায় এবং অব্যবহারজনিত কারণে পায়ের পেশিসমূহ চিকন হয়ে যাওয়া থেকে রেহাই পায়।

* যাদের রক্তে চর্বি বা কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশি তাদের ক্ষেত্রে হাঁটলে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কমে যায়।

* যাদের কোষ্ঠ কাঠিন্য আছে, নিয়মিত হাঁটায় তাদের মলত্যাগ নিয়মিত ও সহজ হয়ে যায়।

* হাঁটার কারণে ক্ষুধা বাড়ে এবং খাবার গ্রহণের আকাক্সক্ষা বৃদ্ধি পায়।

* নিয়মিত হাঁটলে দম বাড়ে এবং কর্মপ্রেরণা জাগ্রত হয়।

* নিয়মিত হাঁটায় উচ্চরক্তচাপ প্রশমিত হয় এবং রক্তনালীর সংবহন ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।

* হাঁটার কারণে স্ট্রোক হওয়ার প্রবণতা কমে যায়।

* হাঁটলে দেহের সঞ্চিত চর্বির বিগলন হয় এবং দেহের অতিরিক্ত ওজন স্বাস্থ্যকরভাবে হ্রাস পায়।

দৈনিক বা সাপ্তাহিক কতক্ষণ হাঁটা দরকার:

* যারা সারা সপ্তাহ বসে বসে কাজ করেন বা যারা মোটেও দৈহিক পরিশ্রম করেন না তাদের ক্ষেত্রে দৈনিক তিরিশ মিনিট হাঁটা জরুরি।

* যারা দৈনিক হাঁটতে পারেন না,তারা সপ্তাহে অন্তত পঁচাত্তর মিনিট গড়ে হাঁটা দরকার।

* যারা একেবারেই হাঁটতে সময় পান না,তাদের ক্ষেত্রে যখনই সুযোগ হয় তখনই অল্প হলেও হাঁটা উচিৎ এবং এর মাধ্যমে উল্লেখযোগ্যভাবে দৈহিক উপকার অর্জিত হয়।

কীভাবে হাঁটবেন

* দৈনিক তিরিশ মিনিট হাঁটার ক্ষেত্রে একটানা হাঁটা উচিৎ নয়। বিশেষতঃ যাদের বয়স চল্লিশের উপরে এবং যারা দৈহিকভাবে স্থূল তাদের ক্ষেত্রে। হাঁটার সময়কে ভাগ করে নিতে হবে। প্রতিবারে দশমিনিট হেঁটে সারাদিনে এভাবে তিনবার পুনরাবৃত্তি করতে হবে।

* সকালে দশ মিনিট, বিকালে দশ মিনিট এবং সন্ধ্যায় দশ মিনিট হাঁটলেই শরীরকে ক্ষতিগ্রস্থ না করে দরকারী উপকার লাভ করা যায়।

* হাঁটার ক্ষেত্রে কংক্রিটের রাস্তার চেয়ে ঘাসের উপর হাঁটাই উত্তম। এতে পায়ের পাতার উপর এবং কোমড়ের উপর চাপ পড়ে কম।

* হাঁটার সময় ঢিলেঢালা পোষাক পরিধানই উত্তম।এতে অতিরিক্ত উষ্ণতা তৈরি হয় না ও বিরক্তি বোধ হয় না।

* হাঁটার আগে ও হাঁটার পরে পর্যাপ্ত পানি পান করা উচিৎ।

* হাঁটার সময় প্রথমে পায়ের গোড়ালি মাটিতে স্পর্শ করা দরকার যাতে কোমড়ে চাপের সাম্য বজায় থাকে।

* প্রথমে ধীরগতির হাঁটা দরকার যাতে মাংশপেশির ওয়ার্ম আপ হয়।পরে ধীরে ধীরে হাঁটার গতি বাড়াতে হয়।

* ধীরে হাঁটার চেয়ে দ্রুত হাঁটলে দেহে সঞ্চিত ক্যালরি অধিক হারে পোড়ানো যায়।

* একটানা কুড়ি পদক্ষেপ হাঁটলে এক ক্যালরি শক্তি ব্যবহৃত হয়। দৈনিক দশ হাজার পদক্ষেপ হাঁটলে পাঁচশ ক্যালরি শক্তি পোড়ানো যায়। দৈনিক দশ হাজার পদক্ষেপ হাঁটাতে পারাটাই আদর্শ।

* অফিসে যেতে হলে একটু হেঁটে সামনে গিয়ে তারপর গাড়িতে উঠুন।

* অফিস হতে বাসায় আসার সময় এক স্টপেজ আগে গাড়ি হতে নামুন এবং বাকি পথ হেঁটে আসুন।

* বাসায় উঠার সময় লিফট এর পরিবর্তে সিঁড়ি ব্যবহার করুন। অতি উঁচু তলায় বাসা হলে কিছুটা লিফটে উঠে বাকিটা সিঁড়ি দিয়ে উঠুন।

* একটানা বেশিক্ষণ হাঁটবেন না। প্রয়োজনে দুই-একবার জিরিয়ে নিন। তাতে হার্টের ক্ষতি হবে না।

* একা একা হাঁটতে বিরক্ত লাগলে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে হাঁটুন।

* হাঁটার গ্রুপ করে দলে দলে হাঁটলে একঘেয়েমি লাগে না এবং তাতে অনীহা তৈরি হয় না।

* রাস্তায় হাঁটার চেয়ে মাঠে হাঁটুন। তাতে দুর্ঘটনা এরানো যায়।

* হাঁটার জন্যে বাড়ি হতে বেশিদূর যাওয়ার দরকার নেই। বাড়ির আশেপাশেই হাঁটুন।

* হাঁটার সময় হাল্কা ওজন বহন করা ভালো।তাতে ক্যালরি তাড়াতাড়ি দহন হয়।

* কতটুকু হাঁটলেন তা পরিমাপের জন্যে প্রয়োজনে পেডোমিটার নামে ক্ষুদ্র একটি পদক্ষেপ গণনযন্ত্র কোমড়ের সাতে আটকে রাখুন।

কখন হাঁটবেন না

* হাঁটতে গিয়ে যদি শ্বাসকষ্ট তৈরি হয় তবে তৎক্ষণাৎ হাঁটা বন্ধ করুন।

* হাঁটতে হাঁটতে যদি মনে হয় কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে, তাহলে হাঁটা বন্ধ করুন।

* হাঁটার সময় যদি দুই হাতের ঊর্ধবাহু ব্যথা করে বা গলার আশেপাশে চেপে আসে তবে হাঁটা বন্ধ করুন।

* রোগের কারণে যাদের হাঁটাচলা নিষেধ তারা জোর করে হাঁটবেন না।

ভাত খাওয়ার পর হাঁটা-না হাঁটা

ভাত খাওয়ার পর পর হাঁটা কখনোই উচিৎ নয়। খাওয়ার পরে আমাদের পাকস্থলীর খাদ্য হজমে প্রচুর রক্তের সরবরাহ প্রয়োজন হয়। কেননা রক্তের মাধ্যমে পরিবাহিত অক্সিজেন এর সহায়তায় পাকস্থলী খাদ্য হজম করে। এই কাজ পূর্ণাঙ্গভাবে সম্পন্ন করতে পাকস্থলির দেড় থেকে দুই ঘন্টা লাগে। আমাদের দেহে মোট পাঁচ থেকে ছয় লিটার রক্ত পরিসঞ্চালিত হয়। খাওয়ার পর হার্ট সিংহভাগ রক্ত পাকস্থলীতে পাঠায়। অবশিষ্ট রক্ত হতে কিছুটা মস্তিষ্কে, কিছুটা কিডনীতে, কিছুটা ফুসফুসে ও অন্যান্য দরকারি অঙ্গে পাঠায়। এতে করে নিজের জন্য তার রক্ত থাকে অল্প। যখন খাওয়ার পর পর কেউ ব্যয়াম করে বা হাঁটে, তখন হার্টকে পা ও নিম্নাঙ্গের দিকে রক্ত সরবরাহ করতে হয়। ফলে হার্ট নিজের জন্য প্রয়োজনীয় রক্ত পায় না। পরিণামে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক হতে পারে।

তবে ভাত খাওয়ার ঘন্টাখানেক পরে হাঁটা যায়।

ঘুমানোর আগে-পরে হাঁটা

ঘুমানোর দুই ঘন্টা আগে থেকে কোন কড়া ব্যায়াম করা বা হাঁটা উচিৎ নয়। তাতে দেহের বায়োলজিক্যাল ক্লক এর কার্যক্রমের বিভ্রাট হতে পারে। দেহের লিম্বিক সিস্টেম উত্তেজিত হয়ে পড়ে এবং নিদ্রার স্বাভাবিকতা নষ্ট হয়ে যায়।

ঘুম থেকে উঠা মাত্রই কোন ব্যায়াম বা হাঁটা উচিৎ নয়। কেননা এ সময় দেহের হৃদপিন্ডের পক্ষে দ্রুত তাল সামলানো কঠিন হয়ে পড়ে। পরন্তু ঘুম হতে জেগে ওঠার অব্যবহিত পরেও স্নায়ু প্রান্তগুলোর পর্যাপ্ত জাগরণ ঘটেনা। ফলে এসময়ের ব্যায়াম শরীর তার উপকারে লাগাতে পারে না।

কখন হাঁটা ভালো

* অতি ভোরের চেয়ে সকালে হাঁটা উত্তম। এতে দেহের সাড়া তৈরি হয়। অতি ভোরে দৈহিক তাপমাত্রা কম থাকে, মাংসপেশির সাড়া কম থাকে। কিন্তু সকালের দিকে তা ঠিক হয়ে আসে।

* বিকেল চারটা হতে ছয়টায় হাঁটা চমৎকার। এসময় শরীর অধিক সক্রিয় থাকে। বিকেল চারটার দিকে আমাদের ফুসফুসের সক্রিয়তার মাত্রা থাকে অধিক আর ছয়টার দিকে আমাদের হরমোন লেভেল থাকে সর্বাধিক।

* রাতে আটটার দিকে হাঁটা যেতে পারে। তাতে অফিস ফিরতির ক্লান্তি দূর হয় এবং রাতের খাবার গ্রহণের পরিবেশ তৈরি হয়।

হাঁটার সময় যা পান করবেন না

* ধূমপান

* অ্যালকোহল পান

* কোমল পানীয় পান

* দুধ ও দুধ জাতীয় পানীয়

* কার্বোনেটেড ওয়াটার

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়