বুধবার, ২০ আগস্ট, ২০২৫  |   ৩১ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ২০ আগস্ট ২০২৫, ০৮:৫৫

ঝিমিয়ে পড়েছে পুরাণবাজারের ক্রীড়া সংগঠনগুলোর কর্মকাণ্ড

মাঠ আছে, কমিটি আছে, নেই ক্রীড়া চর্চা ও খেলার আয়োজন

ক্রীড়া প্রতিবেদক
ঝিমিয়ে পড়েছে পুরাণবাজারের ক্রীড়া সংগঠনগুলোর কর্মকাণ্ড

চাঁদপুর জেলা শহরের প্রসিদ্ধ ব্যবসায়িক এলাকা হিসেবে পরিচিত পুরাণবাজার। এই এলাকার মধুসূদন উচ্চ বিদ্যালয় মাঠটিই হলো ক্রীড়া চর্চার একমাত্র জায়গা। জুট মিল ও পূর্বশ্রীরামদী এলাকায় খেলাধুলা করার ছোটখাটো জায়গা থাকলেও পুরাণবাজার মধুসূদন হাই স্কুল মাঠটি এখানকার খেলাধুলার জন্যে একমাত্র ভরসা। চাঁদপুর জেলা ক্রীড়া সংস্থার অন্তর্ভুক্ত চারটি ক্লাব রয়েছে এখানে। ক্লাব গুলো হলো : নিতাইগঞ্জ ক্রীড়া চক্র, ভাই ভাই স্পোর্টিং ক্লাব, পূর্বশ্রীরামদী ও পশ্চিম শ্রীরামদী ক্লাব।

স্থানীয়ভাবে এই ক্লাবগুলোর ক্রীড়া চর্চার অতীত সুনাম ছিলো বেশ। জেলা ক্রিকেট লিগ, জেলা ফুটবল লিগের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব জেলা শহরের অন্যান্য ক্লাবের সাথে এই ক্লাবগুলোরও রয়েছে। ফুটবলের জনপ্রিয়তা পিছিয়ে পড়ায় এখন আর আগের মত ক্লাবগুলোর ফুটবল টিম গঠনের তাগিদ নেই। স্থানীয় পর্যায়ে ফুটবলারদের খেলাধুলা নেই বললেই চলে। মধুসূদন স্কুল মাঠ মেয়েদের একটি হাইস্কুল সহ দুটি হাই স্কুল, একটি সিনিয়র মাদ্রাসা ও দুটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের খেলাধুলার মাঠ হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। মাঠটি মধুসূদন হাই স্কুলের হলেও এলাকার ছেলেরা এবং স্কুল শিক্ষার্থীরা এ মাঠেই নিজেদের মত করে ফুটবল, ক্রিকেটসহ অন্যান্য খেলাধুলা খেলে থাকে। তাদের দৌড়ঝাঁপ এই মাঠেই পরিলক্ষিত হয়। আগের মতো এখানে ফুটবল, ক্রিকেট, ভলিবলের আয়োজন হয় না। জাতীয় দিবস উপলক্ষে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ক্রীড়া ইভেন্টও এখন এখানে রাখা হয় না। নব্বইর দশকে ক্রীড়া সংগঠক অ্যাডভোকেট আবুল কালাম সরকার তার নতুন কুঁড়ি ক্রীড়া চক্রের মাধ্যমে বেশ কয়েক বছর টুর্নামেন্টের আয়োজন করেছিলেন। তিনি নতুন বাজারে বসতি গড়ে তোলায় আর আইনজীবী পেশায় নিযুক্ত থাকায় পুরাণবাজারে খেলাধুলা আয়োজন পিছিয়ে পড়ে। সর্বশেষ লোহারপুল এলাকার সাবেক ফুটবলার ও ক্রিকেটার সাইফুল ইসলাম, সঞ্জয় দাস সুমনের তত্ত্বাবধানে সানরাইজ স্পোর্টিং ক্লাব একটি ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন করেছিলো চলতি বছরের কয়েক মাস আগে। এই ফুটবল টুর্নামেন্টকে ঘিরে আবারো প্রাণ ফিরে পেয়েছিলো মধুসূদন হাই স্কুলের এই খেলার মাঠ। প্রচুর দর্শক সমাগমে সানরাইজ ক্লাবের ফুটবল টুর্নামেন্টের সফল সমাপ্তি হয়। এরপর আর কোনো খেলাধুলার খবর নেই।জেলা ক্রীড়া সংস্থা

এফিলিয়েশনপ্রাপ্ত ক্লাব গুলোরও নেই ক্রীড়া চর্চা।মাঠ আছে, ক্লাব আছে, কমিটিও আছে। নেই কেবল উল্লিখিত ক্লাবগুলোর ক্রীড়া কার্যক্রম। অধিকাংশ সময় খেলার মাঠে থাকছে সুনসান নীরবতা। নেই মাঠে এসে খেলা দেখার দর্শকদের সেই উচ্ছ্বাস। ক্লাবগুলোতে জমেছে ধুলাবালি। সবুজের ঘাসে বাজে না বুট ও বলের ধ্বনি। পুরো মাঠ যেন ফ্যাকাসে। দিনে বা রাতে মাঠের ভেতর বখাটেদের আড্ডা। সংরক্ষণ এবং সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি দীর্ঘ বছর থেকে। গেল বছর ৫ আগস্টের পর সাবেক ফুটবলার বোরহান খান ও সাইফুল ইসলাম উদ্যোগী হয়ে বেহাল দশার মধুসূদন স্কুল মাঠকে সমতল করার কিছুটা কাজ করিয়েছেন।অর্থের অভাবে মাঠ পুরাপুরি ঠিক করা যাচ্ছে না।

পর্যবেক্ষণ এবং অনুসন্ধানে দেখা যায়, এখন মাঠের কার্যক্রম আর খেলা চলে ভাড়ায়। ক্লাবগুলো তাদের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে ভাড়ায় খেলোয়াড় সংগ্রহ করে জেলা ক্রীড়া সংস্থায় তাদের বার্ষিক ক্রীড়া কর্মসূচি পালন করছে। এর কারণে তৈরি হচ্ছে না স্থানীয় পর্যায়ের প্লেয়ার। এ ছাড়া প্রতি বছর জেলার সর্বোচ্চ যে আয়োজন জেলা ফুটবল লিগ, প্রথম বিভাগ, দ্বিতীয় বিভাগ ক্রিকেট লিগ ও ডিসি গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট, সেটিও এ বছর হতে দেখা যায়নি। যার কারণে পেশা পরিবর্তন করছেন খেলোয়াড়রা।

বরাবরই অভিযোগ, জেলা ক্রীড়া সংস্থা থেকেই এমন বেহাল অবস্থা পুরাণ বাজার ক্রীড়াঙ্গনের। মাঠে টুর্নামেন্ট না থাকায় খেলোয়াড়দের মাঝে নেই প্রাণচাঞ্চল্য। এতে হতাশ খেলোয়াড় ও ক্রীড়ামোদিরা।

জানা যায়, ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে সর্বশেষ ক্রীড়া সংস্থার চার বছর মেয়াদী কমিটি হয়েছিলো। কিন্তু ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর ভেঙ্গে দেওয়া হয় জেলা-উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার সব কমিটি। এরপর মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ৭ সদস্য বিশিষ্ট এডহক কমিটি গঠনের পরিপত্র জারি করা হয়। সেই মোতাবেক জেলা ক্রীড়া সংস্থার দুটি এডহক কমিটি জমা পড়লেও অনুমোদন পেয়েছে একটি। এই এডহক কমিটি নিয়েও আছে স্থানীয় ক্রীড়াঙ্গনের বিরোধ।

পৃষ্ঠপোষকের অভাবে এবং বিভিন্ন কারণে ঝিমিয়ে পড়েছে পুরাবাজারের ক্রীড়াঙ্গন। দেখা দিয়েছে স্থবিরতা।পূর্বশ্রীরামদী ও ভাই ভাই ক্লাবের ক্লাব ভবন থাকলেও এ দুটি ক্লাবে তালা ঝুলছে। নিতাইগঞ্জ ক্রীড়া চক্র এবং পশ্চিম শ্রীরামদীর স্টেডিয়াম পাড়ায় ক্লাবঘর থাকলেও স্থানীয়ভাবে তাদের ক্লাব কার্যালয় নেই। তবে ক্লাব কর্মকর্তাদের উদ্যোগের মাধ্যমে জেলা লিগ বা টুর্নামেন্টে তাদের অংশগ্রহণ সহ খেলাধুলা কার্যক্রম সময় মত চালিয়ে নিচ্ছেন।

জানা যায়, নিতাইগঞ্জ ক্রীড়া চক্রের প্রধান সমন্বয়ক বিএনপি নেতা জসিম উদ্দিন খান বাবুল হলেও ক্লাব পরিচালনার দায়িত্বে সভাপতি হিসেবে বোরহান খান এবং সাধারণ সম্পাদক পদে আছেন আনোয়ার হোসেন মাঝি। এ দুজন চাঁদপুর জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাবেক ফুটবলার এবং ক্রিকেটার। অপরদিকে, পশ্চিম শ্রীরামদী ক্লাবের অল ইন অল রয়েছেন চাঁদপুরের ব্যবসায়ী নেতা সুভাষ চন্দ্র রায়। তাকে সহযোগিতা করছেন ব্যবসায়ী আরো দুই নেতা তমাল কুমার ঘোষ এবং সালাউদ্দিন মোহাম্মদ বাবর।

ভাই ভাই স্পোর্টিং ক্লাবের অল ইন অল মিজানুর রহমান খান বাদল থাকলেও দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এখন ক্লাবের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এই ক্লাবেরই অন্য দু কর্মকর্তা আকতার হোসেন সাগর এবং শাহজাহান কবির খোকাকে। এই ক্লাবেরই প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক বাদল খান জানিয়েছেন আপাতত ক্লাবে তালা দেওয়া রয়েছে। ক্রীড়া সংস্থার খেলাধুলা আসলে সাগর এবং খোকা সুন্দরভাবে ক্লাব পরিচালনা করবে।

পূর্ব শ্রীরামদী ক্লাবটি চাঁদপুর জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং সাবেক জাতীয় ফুটবলার গোলাম মোস্তফা বাবুর তত্ত্বাবধানেই তার পাড়ায় দীর্ঘ বছর থেকে পরিচালিত হয়ে আসছিলো। এ ক্লাবের সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন সাবেক ফুটবলার মঞ্জু মাঝি। এ ক্লাবের কর্মকর্তা আব্দুস সামাদ বাদল জানিয়েছেন, আপাতত তাদের ক্লাবটি তালাবদ্ধ রয়েছে।

নিতাইগঞ্জ ক্রীড়া চক্রের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার মাঝি জানান, খেলাধুলা তো ক্রীড়া সংস্থাতেই নেই। আমাদের ক্লাবগুলো ক্রীড়া সংস্থাভিত্তিক খেলাধুলা করে থাকে। ক্রীড়া সংস্থার খেলা থাকলে তো আমাদের খেলাধুলা থাকবে, খেলাধুলা নেই এই কারণে। এছাড়া রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে হয়তো এমনটা হয়েছে। তার মতে, ক্রীড়া সংস্থার খেলাধুলা না হবার কারণে ক্রীড়া সংস্থা ভিত্তিক আমরা ক্লাবগুলো খেলাধুলায় অংশ নিতে পারছি না। ক্রীড়া সংস্থার খেলাধুলা আয়োজন হলেই ক্লাবগুলো দল গঠনে ভূমিকা এবং তখন খেলাধুলার চর্চা হবে।

আনোয়ার মাঝি বলেন, আমরা ছোটবেলা থেকে নিজেরা প্র্যাকটিস করতাম, নিজেদের ক্লাবের হয়ে ফুটবল, ক্রিকেট খেলতাম। তখন ছিলো খেলাধুলার রমরমা অবস্থা। এখন আমরা সিনিয়র হয়ে প্লেয়ার থেকে ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে আছি। তাই আগের মতো খেলাধুলা হয়ে উঠছে না। আমরা সিনিয়রাও এখন অক্ষমতার পরিচয় দিচ্ছি। পাঁচ আগস্টের পূর্বে যে পরিস্থিতি ছিলো তাতে আমরা এডজাস্ট করতে পারি নি। প্র্যাকটিসের জন্যে অফিসিয়াল আনঅফিসিয়াল কোনো খেলাধুলা এখন আর আগের মতো হচ্ছে না। রাজনৈতিক সরকার আসলে হয়তো বা ক্লাবগুলোর কার্যক্রম আবারো জোরদার হবে।

এলাকার খেলাধুলাপ্রেমী তরুণেরা বলেন, বর্তমানে যতোটুকু খেলাধুলা হয়, তার সবটুকুই নিজেদের উদ্যোগে। নিজেদের দেওয়া চাঁদার টাকায় খেলার সামগ্রী কিনে মাঝে মধ্যে তারা খেলেন।

প্রায়ই এলাকার তরুণদের নিয়ে খেলাধুলার আয়োজন করেন স্থানীয় খেলোয়াড়রা।

খেলার প্রতি প্রচণ্ড ভালোবাসা থেকেই তাদের এই উদ্যোগ। তারা জানান, এখানে মাঠ থাকলেও খেলাধুলার কোনো আয়োজন নেই। আমরা নিজেরা চাঁদা তুলে বল কিনে শিক্ষার্থীদের নিয়ে টুকটাক খেলাধুলা করি। এতে করে চর্চাটা ধরে রাখা শুধু।

ক্রীড়া সংস্থা বা সরকারিভাবে কোনো উদ্যোগ নিয়ে টুর্নামেন্ট ছাড়া হলে তরুণেরা খেলাধুলায় আগ্রহী হতো। করোনার সময়টাতেও আমরা নিজের চেষ্টায় খেলাধুলাটা চালু রেখেছি। এতে করে শিক্ষার্থীরা খারাপ অভ্যাসে জড়াবে না। সুস্থ মনমানসিকতা বজায় রাখা ও মাদকমুক্ত সমাজ গড়তে খেলাধুলার কোনো বিকল্প নেই বলেও মনে করেন তারা।

স্থানীয় তরুণদের দাবি, ক্রীড়া সংস্থার কমিটির বড়ো পদগুলোতে ক্রীড়া অনুরাগীদের রাখা হোক। তাতে খেলাধুলার প্রতি তাদের টান থাকবে।

গত বছর ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ৮ আগস্ট দায়িত্ব নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের এক বছর পূর্ণ হয়েছে গত ৮ আগস্ট ।

দেশের খেলাধুলাকে এগিয়ে নিতে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্রীড়া কার্যক্রম শুরু করার যুগান্তকারী নির্দেশ প্রদান করেছে। সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ১৬টি খেলার চর্চা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের খেলাধুলার প্রতি আগ্রহ বাড়ানোর পাশাপাশি তাদের বিপথগামিতা ঠেকাতেই নেয়া হয়েছে এমন উদ্যোগ।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়