প্রকাশ : ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৯:১৬
মানবিকতার সংকটে উচ্চশিক্ষা (মূল শিক্ষা)
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থিরতা ও আমাদের করণীয়

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) এবং এর পার্শ্ববর্তী জোবরা গ্রামের মধ্যে অর্ধ-শতাব্দীরও বেশি সময়ের যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতার সম্পর্ক ছিলো, তা এক রাতের সংঘর্ষে গভীর সংকটের মুখে পড়েছে। এই ঘটনা শুধুমাত্র একটি বিচ্ছিন্ন সংঘাত নয়, বরং আমাদের সমাজের মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, পারস্পরিক শ্রদ্ধার অভাব এবং নৈতিকতার চরম স্খলনকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। একটি ছোট ঘটনার জের ধরে যেভাবে পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে, তা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মূল ভিত্তি এবং ছাত্র-শিক্ষক-এলাকাবাসীর মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে।
ঘটনার সূত্রপাত ও তার ভয়াবহতা :
ঘটনার সূত্রপাত হয় শনিবার রাতে, যখন এক ছাত্রী তার ভাড়া বাসায় ঢুকতে গেলে দারোয়ানের হেনস্তার শিকার হন। এই তুচ্ছ ঘটনা দ্রুতই ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে এবং শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ হয়ে জড়ো হন। এরপর যা ঘটেছে, তা বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার ইতিহাসে এক নজিরবিহীন কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হবে। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, স্থানীয় কিছু সন্ত্রাসী গোষ্ঠী দেশীয় অস্ত্র, রামদা ও শটগান নিয়ে তাদের ওপর হামলা করে। নিরস্ত্র শিক্ষার্থীরা এলোপাতাড়ি কোপের শিকার হয়, অনেকে গ্রাম থেকে সাহায্য চেয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আর্তনাদ করেন। অন্যদিকে, স্থানীয়দের দাবি, শিক্ষার্থীরা তাদের দোকানপাট ও সম্পত্তিতে হামলা চালিয়েছিল। এই সহিংসতায় দুই উপ-উপাচার্য এবং প্রক্টরসহ প্রায় ২০০ জন আহত হন, যার মধ্যে চারজনের অবস্থা গুরুতর। একজন শিক্ষার্থীকে রামদা দিয়ে একাধিকবার কোপানো হয়েছে এবং তাকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) প্রফেসর ড. মো. কামাল উদ্দিনের ভাষায়, “আমরা কোন্ জগতে আছি? আমার শিক্ষার্থীদের স্থানীয়রা কচুকাটা করছে।” এই একটি উক্তিই পুরো পরিস্থিতির ভয়াবহতা তুলে ধরে।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সংকট সংঘর্ষ শুরু হওয়ার পর প্রায় পুরো দিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনুপস্থিতি ছিলো হতাশাজনক।
শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেছেন, বিকেল ৪টা পর্যন্ত পুলিশ বা সেনাবাহিনীর কোনো উপস্থিতি দেখা যায়নি, যা পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে তোলে। এই অনুপস্থিতি প্রমাণ করে যে, সংকট মোকাবিলায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে দ্রুত সাড়া দিতে ব্যর্থতা ছিলো। উপ-উপাচার্যরা বারবার যোগাযোগ করেও কোনো সাহায্য পাননি, যা তাদের ক্ষোভের কারণ হয়েছিল। পরবর্তীতে, হাটহাজারী উপজেলা প্রশাসন বাধ্য হয়ে ১৪৪ ধারা জারি করে এবং র্যাব, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর যৌথ অভিযান শুরু হয়। এই সময়োপযোগী পদক্ষেপটি আরও আগে নেওয়া গেলে হয়তো এত বড়ো ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো যেতো।
শিক্ষার পতন এবং এর সুদূরপ্রসারী পরিণতি :
যখন উচ্চশিক্ষার সর্বোচ্চ পীঠস্থানের শিক্ষার্থীরা স্থানীয়, অসহায় এবং দরিদ্র মানুষের সঙ্গে সহিংসতায় জড়ায়, তখন তাদের অর্জিত শিক্ষা এবং নৈতিকতার মধ্যে এক বিশাল ফারাক স্পষ্ট হয়ে উঠে। এমন শিক্ষা কি সত্যিই কোনো কাজে আসে? এই সংঘাত যদি চলতে থাকে, তবে এর ফল সুদূরপ্রসারী এবং ধ্বংসাত্মক হতে পারে।
ভাড়া সংকটের আশঙ্কা :
শিক্ষার্থীরা হয়তো ভবিষ্যতে আর স্থানীয়দের কাছে বাসা ভাড়া পাবে না, যা উচ্চশিক্ষার জন্যে এক বড়ো ধাক্কা।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার ঝুঁকি :
এই ধরনের অস্থির পরিবেশ নতুন শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে নিরুৎসাহিত করবে, যার ফলে দীর্ঘমেয়াদে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধও হয়ে যেতে পারে।
মানবসম্পদের ক্ষতি :
শিক্ষাই যেখানে উন্নতির মূল চাবিকাঠি, সেখানে শিক্ষার পীঠস্থানেই যদি এমন অস্থিরতা থাকে, তবে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন থমকে যাবে।
এই পরিস্থিতিতে কেবল শিক্ষার্থীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, বরং স্থানীয় ছেলে-মেয়েরাও উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হবে। এভাবে আমরা নিজেরাই নিজেদের দেশের সবচেয়ে বড়ো সম্পদ মানবসম্পদকে হুমকির মুখে ফেলবো।
সংকট থেকে উত্তরণের পথ :
এই গভীর সংকট থেকে উত্তরণের জন্যে জরুরি ও গঠনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ :
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে আহত শিক্ষার্থীদের দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে এবং তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
দোষীদের বিচার : এই ঘটনায় যারা শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করেছে, তাদের কঠোরতম শাস্তির আওতায় আনা আবশ্যক। একইসঙ্গে, যদি কোনো শিক্ষার্থী এই ঘটনার জন্যে দায়ী থাকে, তবে তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর একাডেমিক শাস্তির ব্যবস্থা করা উচিত। একটি নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করে সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করা অপরিহার্য।
গঠনমূলক সমাধান :
কেবল শাস্তি বা প্রশাসনিক ব্যবস্থা যথেষ্ট নয়। এই সমস্যার মূল কারণ খুঁজে বের করতে হবে। ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক, কর্মচারী, স্থানীয় লোকজন, প্রশাসন এবং সরকারের সমন্বয়ে একটি ঐক্যবদ্ধ কমিটি গঠন করা এখন সময়ের দাবি। এই কমিটি সমস্যার মূল কারণগুলো চিহ্নিত করবে এবং ভবিষ্যতে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা যাতে না ঘটে, তার জন্যে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করবে।
মূল্যবোধের শিক্ষা : আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় মানবিক মূল্যবোধের ওপর জোর দেওয়া এখন সময়ের দাবি। শুধু ভালো ফল করা বা সার্টিফিকেট অর্জন করাই শিক্ষার মূল লক্ষ্য নয়। প্রকৃত শিক্ষা হলো মানবিক গুণাবলি অর্জন করা, যেখানে একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা এবং সহমর্মিতা থাকে।
উপসংহার :
এই সংকট থেকে আমাদের সবাইকে শিক্ষা নিতে হবে। যদি আমরা এখন জেগে না উঠি, তবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একটি সংঘাতময় ও মানবিকতাশূন্য দেশে বাস করবে। আসুন, সবাই মিলে একটি সুন্দর, শান্তিময় এবং মানবিক সমাজ গড়ে তোলার জন্যে কাজ করি। কবির ভাষায় বলতে হয়, “গাহি সাম্যের গান।” এই বাণীটি শুধু বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ না রেখে আমাদের আচরণ এবং কর্মের প্রতিফলন ঘটাতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, আমরা একই দেশের নাগরিক এবং আমাদের সবার লক্ষ্য একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। আইন হাতে তুলে না নিয়ে, প্রশাসনকে সম্মান করে এবং দেশকে ভালোবেসে আমরা এই সংকট মোকাবিলা করতে পারি।
লেখক : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, ভাইস চেয়ারম্যান (কোরিয়া-বাংলা প্রেসক্লাব)।