শুক্রবার, ২২ আগস্ট, ২০২৫  |   ৩০ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ২২ আগস্ট ২০২৫, ১১:৪৪

উদয়াচল

বিমল কান্তি দাশ
উদয়াচল

অহংবিদ্ধ গাম্ভীর্য হলো একজন একনায়কতান্ত্রিক শাসকের মূল বৈশিষ্ট্য। যুগে যুগে এসবের জন্যে শাসকরা ধিকৃত-তিরস্কৃত এবং লাঞ্ছিত হয়েছে। কথায় আছে ‘তুমি অধম তাই বলে কি আমি উত্তম হতে পারি না?’ মানব সমাজ এজন্যে আজ আদর্শিক চর্চা থেকে বহু দূরে সরে গেছে। কোনো কিছুর অবস্থান্তরই হলো উন্নয়ন বা অবনয়ন। যেমন রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন ‘নিদর্শন’ দ্বারা নির্দেশিত হয়। সংস্কৃতিগত উন্নয়ন অত্যুজ্জ্বল মনমানসিকতা দ্বারা বিম্বিত হয়। আবার রাষ্ট্রীয় সৌজন্য বিধির সুস্পষ্ট ব্যত্যয় নিষ্ক্রিয়তা ভংগুর প্রশাসনিক শিকল তৈরি করে দেয়, যা অরাজক পরিস্থিতির একমাত্র নিয়ামক এবং দ্বি-চারিতার নিশ্চিত ধনাত্মক প্রভাবক।

সার্বিক বৈচিত্র্যবহুল এই বাংলা। এক সময় বাংলার মানুষ কথা বলতো, কিন্তু বুলি আওড়াতো না। ঘটনা ঘটতো কিন্তু ঘটাতো না। মুখে মানুষ যা বলে কাজে কিন্তু তা করে না। আবার কাজে যা করে তা কিন্তু আদৌ বলতো না। এতোসব ভ্রান্তিমূলক অভিব্যক্তিতে দেশ আজ নিরবচ্ছিন্ন অনিশ্চয়তার গহ্বরে নিমজ্জিত। এই বাংলার মানুষের অবচেতন মনের স্মৃতিকোষে স্তূপীকৃত দুঃসহ বেদনাবিধূর স্মৃতি ‘গোল্ডেন ফিশ’ সদৃশ কিয়তক্ষণপর বিস্মৃত হয়ে যায়। তাই এখানে কেতাবী যোগ্যতার ব্যাপক সমাহার, পক্ষান্তরে প্রশাসনিক সক্ষমতায় অবর্ণনীয় ধস নেমেছে।

প্রাচীন স্বতঃসিদ্ধ মতবাদ অনুযায়ী মহীতে প্রথম জীবসত্তা নিয়ে এসেছে মানুষ। এই জীবসত্তায় এসেছে মনুষ্যত্ব নামক একটা অলংকার এবং পশুত্ব নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে বিকার। মনুষ্যত্বের অমোঘ নিদর্শনে কেউবা মরিয়া ও অমর থাকে ঘোষণে। আবার চারিত্রিক দূষণে বা দ্বি-চারিতায় ক্লিষ্ট হয়ে কেউ বা জীবন্মৃতে থেকে যায়।

এক সময়ের এই বাংলা পশ্চিমে আফগানিস্তান ও বেলুচিস্তান, উত্তরে কাশ্মীর, দক্ষিণে দাক্ষিণাত্য মালভূমি জুড়ে বিস্তৃত ছিলো। কালের বিবর্তনে সেই তিলোত্তমা বাংলা আজ রাজনৈতিক হানাহানিতে। স্বাধীন-সার্বভৌম বহুমাত্রিক বাংলাদেশটি আজ একান্তই একমাত্রিকতার পথে গমনের উদগ্রীবতায় লিপ্ত রয়েছে। মতান্তরে বহুমাত্রিকতার উদাহরণে এসে যায় এক সময়ের রাজনৈতিক দলের প্রথম বিভক্তি অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ। তারপর ১৯৭২ সালের বিভিন্ন সময়ে একই দলের বিভক্তিগুলো জাসদ (বর), জাসদ (সিরাজ), জাসদ (ইনু) এবং জাসদ (খালেক) ইত্যাদি। আবার একই সময়ে জাতীয় পার্টি বর্তমানে ছয়টি দলে বিভক্ত আছে। এতদ্ব্যতীত বাংলাদেশের বহু রাজনৈতিক দল ভাঙ্গাভাঙ্গির মুখোমুখি। এদেশে এমন অনেক ছোট দল গড়ে উঠেছে এবং স্বীকৃতি পেয়েছে, যারা শুধুই বড়ো জোট ভুক্ত হওয়ার কাজে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এসব দলের বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য বড়ো বড়ো পদে অতি সহজে অন্তর্ভুক্ত হওয়া যায়। পরে নিজের বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগায়ে রাজনৈতিক ফায়দা অর্জন করা যায়। এরাই এদেশে বোল পাল্টানোর পেশাগত রাজনীতিবিদ। নেশাগত রাজনীতিবিদ না হলে কখনো জননন্দিত নেতা হওয়া যায় না। আবার কিছু কিছু রাজনৈতিক দলের সদস্যদের চঁাদা উপজীব্য। তারাই সমাজে ত্রাস সৃষ্টিকারী। সংকটকালে তারা জামিনে মুক্ত হয়ে আসলেই ভয়ংকর কিশোর সন্ত্রাসীর ন্যায় হয়ে যায়।

কোনো জাতিকে সার্বিক সুখ সাগরে ভাসতে হলে যে সমস্ত নিয়ামক প্রয়োজন, সেগুলোর মধ্যে প্রধানত দ্বি-চারিতা মুক্ত দেশপ্রেম-পারস্পরিক সংবেদনশীলতা-অকৃত্রিম সহমর্মিতা-শ্রেণী বিভক্তিমুক্ত শক্তিশালী সমাজকল্যাণ ব্যবস্থা এবং সুস্থ মনের বৈষম্যমুক্ত মানবিক অনুভূতি প্রবণতা। এর ব্যত্যয় হলো চির দুর্যোগময় অশান্ত দেশের নির্দেশক। আর প্রত্যয় হলো চির শান্ত দুর্যোগমুক্ত দেশের নির্দেশক।

জাতিসংঘের ২০২৫ সালের ‘ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস’ রিপোর্টের মর্মানুযায়ী ইউরোপীয় দেশ ফিনল্যান্ড হলো বিশ্বের ১৯৫টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে সুখী এবং মানবতায় সমৃদ্ধ দেশ। অপর পক্ষে তালিকাভুক্ত ১৩৭ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের কুড়িটি অসুখী দেশের শীর্ষ স্থানে রয়েছে (সূত্র : ২৭ জুলাই, ২০২৫, বাংলাদেশ প্রতিদিন )। ফিনল্যান্ডের রাষ্ট্র প্রধান একটি অবিসংবাদিত কর্তৃপক্ষ, যার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত। জনসংখ্যাধিক্যে খ্রিস্টান, তারপর নাস্তিক্যবাদী এবং অন্যান্য সংখ্যাল্প সম্প্রদায়ের পাশাপাশি নির্দ্বান্দ্বিক অবস্থানে রয়েছে। যেখানে নেই কোনো ধর্মীয় আপেক্ষিক তত্ত্বের বাড়াবাড়িজনিত দ্বেষ এবং ক্লেশ।

ধর্ম বিশ্বাসটা অটুট নির্ভেজাল এবং ঔদার্য নিত্যতাপূর্ণ। এই সর্বংসহা ধরিত্রীর একটা ক্ষুদ্রাংশ হলো আমাদের বাংলাদেশ। ১৭৫৭-১৯৪৭ পর্যন্ত পর শাসনের নিষ্ঠুর যঁাতাকলে আক্রান্ত হয়েছিলাম এবং বাংলা মায়ের বহু বিপ্লবী সন্তান অকাতরে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিল। তারপর ১৯৪৮-১৯৭১ পর্যন্ত বাংলা মায়ের অগণিত দেশপ্রেমিকের অকুতোভয় সংগ্রামে ত্রিশ লক্ষ শহিদ এবং দুই লক্ষ বীরাঙ্গনার আত্মত্যাগে তৃষিত বাংলার রাজপথ নরশোণিতে রঞ্জিত হয়েছিল। তারপর এসে গেলো স্বাধীন বাংলাদেশ।

বহু উত্থান-পতনের ডামাডোলের পর জুলাই ২০২৪ সালে ঢাকার রাজ পথে ছাত্র সমাজের ‘কোটা বিরোধী’ আন্দোলনের বাতাবরণে চলমান একটি শান্ত আন্দোলন হঠাৎ জ্বলে উঠে আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতে নির্গত উত্তপ্ত লাভার ন্যয় বাংলাদেশে ‘সরকার হটাও’ আন্দোলনে রূপান্তরিত হলো। বে-ঘোরে সফলতাও পেলো, কিন্তু ঝরে গেলো অগণিত শহিদের টগবগে রক্ত।

এভাবে চক্র-ক্রমিক ঘূর্ণনে একটার পর একটা রক্ত-ঝরা আন্দোলন-সংগ্রামে এই সুশান্ত বাংলায় যে রক্ত রঞ্জিত পদ্মা-মেঘনা-যমুনা প্রবহমান রয়েছে, তাতে আমরা ঐতিহাসিকভাবেই নিন্দিত রয়ে গেলাম। এতে করে ভাব বিপ্লবোত্তর রেনেসঁাস গলাবাজরাই সাধারণ মানুষের দণ্ডমুণ্ডের অধিকর্তা সেজে যায় এবং বাক্ স্বাধীনতার উপলব্ধির চিন্তা মাথা থেকে বিতাড়িত করে দেয়। এই সর্বংসহা দেশ মাতৃকার বক্ষে ক্ষমতালিপ্সু অপশক্তির যে জগদ্দল পাথর চাপা পড়ে আছে, তাতে বাকরুদ্ধ মানুষ শুধুই অপলক দৃষ্টিতে দেখছে আর বধির-বত শ্রুত হচ্ছে। এর প্রাকৃতিক প্রতিক্রিয়া ঐতিহাসিক ভাবে অনিবার্য। একটা প্রবাদে রয়েছে : ঘরমযঃ রং ফধৎশবংঃ নবভড়ৎব ফধহি. অঁাধার বিদারী প্রত্যুষার্ক বাংলার ভূমণ্ডলে উড়ম্বর রয়েছে। আবার নিশ্চয়ই নিঝুম গোধূলীতে শ্রান্ত পাখিরা নীড় পানে ধাবিত হবে এবং প্রত্যুষে পাখির সুমধুর কলরবে দিনেশ বিচ্ছুরিত রশ্মিতে রোদসী বাংলার আকাশের ঘন কালো অঁাধার কেটে যাবে এবং দেদীপ্যমান বাংলা চরম অবস্থায় ফিরে আসবেই।

বিমল কান্তি দাস : কবি ও প্রাবন্ধিক; অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র শিক্ষক, বলাখাল যোগেন্দ্র নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয় ও কারিগরি কলেজ, হাজীগঞ্জ, চঁাদপুর।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়