মঙ্গলবার, ১৯ আগস্ট, ২০২৫  |   ৩০ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ১৯ আগস্ট ২০২৫, ০৮:৩৩

ভারতের বিরুদ্ধে ইউনূসের নয়া কৌশল

‘মাইর হবে কিন্তু সাউন্ড হবে না’

মইনুদ্দিন লিটন
‘মাইর হবে কিন্তু সাউন্ড হবে না’

বাংলাদেশের সাথে আমেরিকার বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এটা নিয়ে অনেকের অনেক কথা পড়লাম, শুনলাম, দেখলাম। এতে যতোটা না ‘আমেরিকা’, তারচে’ বেশি যে বিষয়টা গোপনে গোপনে কাজ করছে, সেটাকে ‘ভারতের আনুগত্য’ মেনে নেয়ার মানসিকতা বলতে চাই। আগে এই চুক্তির বিষয়টা নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক। এই চুক্তিতে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বাংলাদেশের সাথে বাণিজ্য শুল্ক ৩৫ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশে নামিয়ে এনেছেন। এমনটা কেন হলো এবং কীভাবে হলো? এর কী মানে? সেটাও কিছুটা জানা দরকার।

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এ বছর এপ্রিলের ২ তারিখে বিশ্বের যেসব দেশের সাথে আমেরিকার বাণিজ্যিক বৈষম্য আছে তাদের ওপর ব্যাপক হারে শুল্ক বৃদ্ধির ঘোষণা দেন। এর পরপরই আমাদের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে একটা চিঠি লেখেন। চিঠিতে তিনি এই শুল্ক প্রয়োগ নব্বই দিনের জন্যে স্থগিত করার অনুরোধ করেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই চিঠি গ্রহণ করেন এবং যে সকল দেশের সাথে আমেরিকার বাণিজ্য বৈষম্য আছে তাদেরকে এই নব্বই দিনের মধ্যে বাণিজ্য বৈষম্য দূর করার পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান। বাণিজ্যবৈষম্য বলতে যা বোঝায় তা হলো, আমরা আমেরিকায় যে পরিমাণ টাকার পণ্য রপ্তানি করি, আমেরিকা আশা করে আমরা যেন সেই পরিমাণ টাকার পণ্য আমেরিকা থেকে আমদানি করি। আমেরিকাও আমাদের দেশে সেই পরিমাণের পণ্য রপ্তানি করতে চায়। আমেরিকার পক্ষে এটা খুব স্বাভাবিক এবং ন্যায্য চাওয়া। সেটা না হলেই বাণিজ্য বৈষম্য হয়। ভারতের সাথেও আমাদের বাণিজ্য ঐ একই রকম। তবে পার্থক্যটা হলো ভারত আমাদের দেশে যে পরিমান পণ্য রপ্তানি করে তার মাত্র ২৫ শতাংশ পণ্য তারা আমাদের কাছ থেকে কিনে নেয়। অর্থাৎ দীর্ঘকাল ধরে ভারতের সাথে আমাদের চরম বাণিজ্য বৈষম্য চলছে। কিন্তু এ নিয়ে আমরা কোনো টু শব্দটি পর্যন্ত করতে পারছি না। কেন পারছি না আগে সেটা বোঝা দরকার।

খাদ্য নিরাপত্তা আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার এক নম্বর ইস্যু। আমেরিকা থেকে আমরা গম ও সয়াবিন আমদানি করি। আরো আনি ভুট্টা ও তুলা। কিন্তু আমাদের গম আমদানির প্রধান উৎস হচ্ছে ভারত। এছাড়া ভারত থেকে আমরা তুলাও আনি। পাশাপাশি রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকেও আমরা গম আমদানি করি। রাশিয়ার ওপরে আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা আছে। আর ইউক্রেনে যুদ্ধ চলছে। তাই এই দু দেশ থেকে আমাদের আমদানি বন্ধ। ফলে এই দু দেশ থেকে আমদানির পুরো পরিমাণের পণ্য আমরা ভারত থেকে আমদানি করে আসছি। অর্থাৎ ভারতের প্রতি বাংলাদেশে আমদানি নির্ভরতা আগের চেয়ে অনেক গুণ বেড়ে গেছে। কিন্তু আমরা বিভিন্ন সময়ে দেখি, ভারত বিনা নোটিসে তাদের থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর বাধা আরোপ করে। রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। শুধু তাই নয়, আবার বলে, ভারতই আমাদেরকে খেতে দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে। কিছু হলেই চাল রপ্তানি বন্ধ, পেঁয়াজ বন্ধ, আলু বন্ধ করে দেয়। ভারত বলে, ওরা না দিলে নাকি আমরা চলতেই পারবো না। না খেয়ে মরে যাবো। বিষয়টা এমন যে, আমরা টাকা দিয়ে ভারতীয় পণ্য কিনলেই চলবে না, আমাদেরকে ভারতের প্রতি মস্তক অবনত চিত্তে কৃতজ্ঞ থাকতে হবে। এভাবেই ভারত আমাদেরকে কেবল তাদের পণ্য আমদানির ওপরে নির্ভরশীলই নয়, আমাদেরকে রাজনৈতিক-মনস্তাত্ত্বিক ভাবেও তাদের প্রতি নতজানু করে রেখেছে। এখন প্রশ্ন, ওদের কাছ থেকে আমরা কেন কিনবো? আসলে দীর্ঘ সতের বছর ধরে ভারতের সাথে বাণিজ্য বিষয়ে এমন এক বয়ান তৈরি করে রাখা হয়েছিলো যে, ভারতের পণ্য ছাড়া আমাদের চলবেই না। এটাই ছিল আমাদের ওপর ভারতের বাণিজ্যিক আগ্রাসন। এই আগ্রাসনের মধ্য দিয়ে ভারত আমাদের শোষণ করে আসছিলো। এই শোষণ শুরু হয়েছিলো ১৯৭২ থেকে। দেখা যায়, আমাদের যখন প্রয়োজন ভারত ঠিক তখনই তাদের থেকে আমদানি করা পণ্য বন্ধ করে দেয়। এইতো পানি নিয়েও ভারতের কত নেতিবাচক কাণ্ড দেখলাম। অর্থাৎ স্বাধীনতার পর থেকেই ভারত খাদ্য-পণ্য-পানিকে আমাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে এসেছে।

এবারই প্রথম ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকার ট্রাম্পের কাছে বাণিজ্য শুল্ক নিয়ে চিঠি পাঠানোর দু মাস আগে ড. খলিলুর রহমানকে ওয়াশিংটনে পাঠিয়েছিলেন। ড. খলিলুর রহমান বর্তমানে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা। ড. খলিলুর রহমান আমেরিকাকে জানান যে, বাংলাদেশ আমেরিকার সাথে বাণিজ্য বৈষম্য দূর করতে চায়। ইন্টারেস্টিং বিষয় হলো, এটা বাংলাদেশ নিজে থেকেই বলেছিলো। অরো ইন্টারেস্টিং বিষয় হলো, বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশই সর্বপ্রথম এমন প্রস্তাব দেয়। এর ঠিক দু মাস পরেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নতুন শুল্কনীতি ঘোষণা করেন। তার মানে ট্রাম্পের নতুন শুল্কনীতির দু মাস আগেই ড. ইউনূস এবং ড. খলিলুর রহমান বুঝতে পেরেছিলেন যে, ট্রাম্প তার বাণিজ্য বৈষম্য দূর করতে নতুন শুল্কনীতির অ্যাকশনে যাবেন! ফলে এটা পরিষ্কার, নতুন শুল্কনীতি ঘোষণার আগেই ড. ইউনূস বাংলাদেশের বাণিজ্যের জন্যে আমেরিকার আরোপিত শুল্ক কমিয়ে আনতে কাজ শুরু করে দিয়েছিলেন। ট্রাম্পের কাছে লেখা প্রফেসর ইউনূসের চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন যে, বাংলাদেশ আমেরিকা থেকে অধিক পরিমাণে কৃষি পণ্য ক্রয় করে আমেরিকার সাথে তার বাণিজ্য ঘাটতি পূরণ করতে চায়। এর মাধ্যমে এটা পরিষ্কার, ড. ইউনূসের সরকার ‘আমেরিকার হার্টল্যান্ড’ জয় করতে চায়। ‘আমেরিকার হার্টল্যান্ড’ হলো, আমেরিকার মধ্যপশ্চিমাঞ্চলের কৃষিভিত্তিক রাজ্যগুলো। এই রাজ্যগুলোই আমেরিকার কৃষি পণ্য তৈরি করে। আর এই রাজ্যগুলোই আমেরিকার অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের মূল ভিত্তি। তাদের ভৌগোলিক অবস্থান, কৃষিনির্ভরতা এবং ঐতিহ্যবাহী মূল্যবোধের জন্যে এই রাজ্যগুলোকে ‘আমেরিকার হার্টল্যান্ড’ বলা হয়। আমেরিকার এই রাজ্যগুলোর সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নয়নে অপরিসীম রাজনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে। বিশেষ করে আমেরিকার নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় এবং নীতি নির্ধারণে ‘আমেরিকার হার্টল্যান্ড’-এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তাই প্রফেসর ইউনূস আমেরিকার সাথে বাণিজ্য বৈষম্য দূর করতে ‘আমেরিকার হার্টল্যান্ড’কে টার্গেট করেছেন। কারণ এই টার্গেটের মধ্য দিয়ে এক ঢিলে দুই পাখি শিকার করা যাবে। আমেরিকা বাংলাদেশের ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক ধার্য করে। বিশ্ব সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে বাংলাদেশের লিড নিগোসিয়েটর ড. খলিলুর রহমান বলেন, ‘’অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আমাদের বস্ত্র শিল্পকে রক্ষা করতে হবে। তা সত্ত্বেও আমেরিকা থেকে কৃষি পণ্য আমদানি করা আমাদের গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য। এতে আমাদের খদ্য নিরাপত্তা বৃদ্ধি পাবে এবং আমেরিকার কৃষি পণ্য উৎপাদনকারী রাজ্যগুলোর সাথে আমাদের ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পাবে।’’

১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষসহ বিভিন্ন দুর্যোগকালীন সময়ে খাদ্যপণ্য ঘাটতির পূর্ব অভিজ্ঞতা আমাদেরকে এটা মনে করিয়ে দেয়, খাদ্য নিরাপত্তা আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার এক নম্বর ইস্যু। তাই এটা বোঝাই যায়, আমেরিকা থেকে খাদ্যপণ্য আমদানি করার নীতির পেছনে প্রফেসর ইউনূস ও ড. খলিলুর রহমান ভারতের ওপর বাংলাদেশের খাদ্য পণ্য নির্ভরশীলতা কাটিয়ে ওঠার দিকটা বিশেষভাবে বিবেচনায় নিয়েছেন। আর এটা হওয়াও অতন্ত জরুরি ছিলো। ফলে ভারত আমাদের প্রয়োজনের সময় খাদ্য রপ্তানি বন্ধ করে আমাদের ওপরে চাপ সৃষ্টি করতে পারবে না। সময়ে অসময়ে বাংলাদেশকে টাইট দেয়ার এমন একটা নীরব অস্ত্র ভারতের হাত থেকে সরিয়ে নেয়ার দরকার ছিলো। কারণ, এতে করে ভারত বাংলাদেশের ওপর থেকে অনেকটা নিয়ন্ত্রণ হারালো। বাংলাদেশের সাথে ভারতের যে বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি ছিলো সেটাও অনেক কমে আসলো। অর্থাৎ ট্রাম্প গোটা দুনিয়ার সাথে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে যেটা প্রকাশ্যে করলেন প্রফেসর ইউনূস ও ড. খলিলুর রহমান সেটা ভারতের সাথে অতি নীরবে করলেন। এটাকেই বলে ‘মাইর হবে কিন্তু সাউন্ড নাই’।

পাশাপাশি আমেরিকার কৃষিপণ্যের উৎপাদনের প্রদেশগুলো হচ্ছে সেদেশের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রদেশ। আমেরিকার এই প্রদেশগুলোই সেদেশের রাজনীতি ও নির্বাচনে নিয়ামক ভূমিকা রাখে। ফলে আমেরিকার এই সকল প্রদেশের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য প্রসারতা দুদেশের মধ্যে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরিতে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। এই সম্পর্কটাকে যদি বাংলাদেশ আরো জোরদার করতে পারে, তাহলে তা বাংলাদেশের প্রকৃত উন্নয়নে খুবই বড়ো ভূমিকা রাখবে। আমাদের বুঝতে হবে আমেরিকায় ভারতের যে প্রভাব তা ব্যবহার করেই ভারত এতোকাল আমাদের বিরুদ্ধে আমেরিকাকে কাজে লাগাতে পেরেছে। কিন্তু ‘আমেরিকার হার্টল্যান্ড’-এর সাথে বাংলাদেশের যে সম্পর্ক তৈরি হতে যাচ্ছে তা দিয়ে আমরা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারতের যে কোনো চক্রান্ত নষ্ট করে দিতে পারবো। মোট কথা, এর মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশে পণ্য বাণিজ্যে একতরফা সুযোগ হারালো এবং বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আমেরিকাকে ব্যবহার করার রাজনৈতিক সুযোগও হারাতে বসেছে। প্রফেসর ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের এই বাণিজ্যনীতিকে দুদিক দিয়ে বিবেচনা করলে তা বাংলাদেশের সাথে বিশ্বের সব থেকে শক্তিশালী দেশ আমেরিকার সুদূরপ্রসারী ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিতে যাচ্ছে। পাশাপাশি ভারতের আধিপত্য মোকাবেলায় তা এমন এক শক্তিশালী কৌশল, যাকে আমজনতার ভাষায় বলে, ‘মাইর হবে কিন্তু কোনো সাউন্ড হবে না’।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়